ট্যাগ দিয়ে যোগ্য লোকের অবমূল্যায়ন কি এখনো চলবে

আমরা একটা অস্থির সময় পার করছি। বৈষম্যহীন বাংলাদেশের প্রত্যাশায় এই তো গত জুলাই-আগস্টে হাজার হাজার ছাত্র–জনতার ত্যাগের বিনিময়ে স্বৈরাচার বিদায় নিয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী বিপ্লব কি সফল হয়েছে? এর উত্তর দেওয়ার সময় এখনো হয়নি। এটি তখনই সফল হবে, যখন এর ফসল হিসেবে আমরা একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ পাব। ফ্যাসিবাদ আর স্বৈরাচারের চিহ্নিত দোসরেরা বাদে দেশের আপামর জনসাধারণ এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নিয়েছে; ঘাম, শ্রম আর রক্ত দিয়েছে। এই আন্দোলনে ছাত্ররা যেমন ছিল, আলেমরাও তেমন ছিল। বিত্তবান ছিল, বিত্তহীনও ছিল। মুসলিম ছিল, অমুসলিমও ছিল। রাজনীতি করা লোকেরা ছিল, রাজনীতি না করা লোকেরাও ছিল। আমরা দেশপ্রেমিকদের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ চাই না, বৈষম্য চাই না।

একটি বৈষম্যহীন সমাজের রূপরেখা মহানবীর (সা.) ঐতিহাসিক বিদায় হজের ভাষণে আমরা পাই। তিনি ঘোষণা করেছেন, ‘কোনো অনারবের ওপর কোনো আরবের; কোনো আরবের ওপর কোনো অনারবের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। তদ্রূপ সাদার ওপর কালোর এবং কালোর ওপর সাদার কোনো প্রাধান্য নেই; আল্লাহভীতিই শুধু শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার মানদণ্ড।’

বৈষম্যহীন সমাজ হবে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ। এখানে কোনো কাজে বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে আগ্রহী মানুষ তাঁর যোগ্যতা অনুযায়ী অবদান রাখার সুযোগ পাবেন। সবার যোগ্যতার সর্বোত্তম ব্যবহার হবে। আমরা যোগ্যতা বলতে কোনো দায়িত্ব পালনের সামর্থ্যকেই বুঝি। কোনো একটি নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনে যার সামর্থ্য বেশি, তিনি সেই দায়িত্ব পাওয়ার হকদার সবচেয়ে বেশি।

কোনো অনুমিত বা কাল্পনিক ইস্যু বানিয়ে কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আধুনিক চীনের জনক দেং শিয়াও পিংয়ের ভাষায়, বিড়াল কালো না সাদা, ওটা বড় কথা নয়। আসল কথা হলো, সে ইঁদুর মারতে পারে কি না। কেউ যোগ্যতার মাপকাঠিতে উপযুক্ত প্রমাণিত হলে তাঁর ধর্ম, বর্ণ, জাতি, রাজনৈতিক মত, পথ বা আঞ্চলিকতা ইত্যাদি ইস্যু বানিয়ে তাঁকে বঞ্চিত করা হলে, সেটা হবে বৈষম্য।

আজ দুঃখের সঙ্গে দেখছি, বিভিন্ন ট্যাগ বা তকমা লাগিয়ে যোগ্য লোককে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে, কখনোবা দায়িত্ব নিতে দেওয়া হচ্ছে না। আবার কোথাও অযোগ্য লোকেরা জোর করে চেয়ার দখল করে নিচ্ছেন। সচিবালয়ে মাত্র ১০ দিনে তিন ধাপ প্রমোশন আমরা দেখেছি। আবার বহু জায়গায় খেলো অভিযোগে শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, অধ্যক্ষ, প্রশাসককে গায়ের জোরে চেয়ার থেকে অপমানজনকভাবে সরিয়ে দিতেও দেখেছি।

ট্যাগিং একটি ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। মিথ্যা ট্যাগিং করে শহীদ আবরার ফাহাদকে খুন করা হয়েছে। বহু ছাত্রকে ক্যাম্পাস থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, না হয় পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের ওপর হামলা করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। আমি নিজে এই ট্যাগিংয়ের শিকার। আমি নামাজ পড়ি, রোজা রাখি; আমি মুসলিম—এই পরিচয় দিতে দুনিয়ার কোনো জায়গায় আমার অসুবিধা হয়নি। তবে এই দেশে হয়, বুয়েটে হয়েছে। আমি বিশ্বাসী মানুষ, তকদিরে বিশ্বাস করি। আলহামদুলিল্লাহ, আমার না পাওয়ার কোনো আক্ষেপ নেই। তবে গত এক যুগের বঞ্চনার কথা ভুলে যাব কেন।

জুলাই বিপ্লবের শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের বেশিরভাগই ছিলেন স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয় আর মাদ্রাসার ছাত্র, ঠিক ছাপোষা মানুষ নন। এই বয়স বিপ্লবী হওয়ার বয়স। পৃথিবীকে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ার স্বপ্ন দেখার বয়স। নতুন পৃথিবী গড়তে হলে অনেক যোগ্য মানুষের দরকার হয়। যাঁরা সরাসরি স্বৈরাচারের অপকর্মের সাথী নন এবং নিজ দায়িত্ব পালনে সক্ষম, সেসব ছাপোষা মানুষের সীমাবদ্ধতার কথা মাথায় রেখে সতর্ক করে দিয়ে দায়িত্ব চালিয়ে নিতে দেওয়াই হবে দেশের জন্য কল্যাণকর।

বিভিন্ন খাতে জোঁকের মতো বসে থাকা দোসরেরা স্বৈরাচারের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে কার্যত অরাজকতার জন্ম দিয়ে বিদায় হয়েছে। দেশের অনেক বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান এখনো অভিভাবকশূন্য। এসব প্রতিষ্ঠানে সর্বনাশ ঘটে যাওয়ার আগে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য যে গতিতে কাজ করা দরকার, সেই গতির কোনো চেষ্টা চোখে পড়ছে না। চারদিকে চলছে ক্ষমতা দখল আর পদ ভাগাভাগির মহোৎসব। বৈষম্যহীন সমাজের যাঁরা স্বপ্ন দেখেন, তাঁরা সরকারকে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতার সর্বাত্মক চেষ্টা করে চলেছেন। তবু মনে হচ্ছে, কোথায় যেন বাঁধা; কারা যেন স্যাবোটাজ করে বিপ্লবের সুফল ভন্ডুল করে দিতে চায়। স্বজনপ্রীতি আর আত্মীয় কোটায় অযোগ্যদের জায়গায় জায়গায় বসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠছে। কার ইঙ্গিতে এই অরাজকতা চলছে? সত্বর তা বন্ধ করতে হবে।

বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাইলে যোগ্যতাই হতে হবে কোনো প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব নির্বাচনের মাপকাঠি। সবার আগে দেখতে হবে তিনি বৈষম্যহীন বাংলাদেশের চেতনায় বিশ্বাস করেন কি না। তিনি কি আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে কাজ করবেন, নাকি তলেতলে দেশকে পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার ষড়যন্ত্র করবেন। দ্বিতীয়ত, দেখতে হবে তাঁর ইথিকাল রেকর্ড কেমন। তিনি কি সত্যনিষ্ঠ মানুষ, নাকি মিথ্যার স্রোতে গা ভাসিয়ে চলা দুর্নীতিপরায়ণ ও সুবিধাবাদী ব্যক্তি। তিনি কি লোভ–লালসার ঊর্ধ্বে উঠে চেয়ারের মর্যাদা রক্ষা করবেন, নাকি চেয়ারের দখল রাখার জন্য দলবাজিতে লিপ্ত হবেন। দল আর চেয়ার আলাদা করে দেখার নীতি যিনি মনেপ্রাণে ধারণ করেন, তাঁর স্বজনপ্রীতি আর গোষ্ঠীস্বার্থের রাজনীতিতে লিপ্ত হওয়ার কথা নয়। তিনি হবেন দলমত-নির্বিশেষে সবার প্রতি উদার, কারও প্রতি বিদ্বেষী নন।

তারপর দেখতে হবে যে পদের জন্য তাঁকে বিবেচনা করা হচ্ছে, সেই পদে বসার জন্য দরকারি জ্ঞান, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা তাঁর আছে কি না। বিগত বছরে নিজেকে সেভাবে বিকশিত করে তুলতে সমর্থ হয়েছেন কি না। টিম–ওয়ার্কে তিনি কতটা সফল? তিনি কি শুধু ব্যক্তিগত কাজকর্মেই পারঙ্গম? নাকি তাঁর অধীনস্থ পুরো টিমকে নিয়ে সফলতার পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম। বসদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি এবং বজায় রাখার আদব–লেহাজ তিনি জানেন কি না? তিনি কি রুটিন–ওয়ার্ক নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, নাকি কীভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠানের বিকাশ হয়, উন্নতি হয়, সুনাম বাড়ে; সেই ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করেন। তিনি কি প্রকল্প প্রণয়ন, অনুমোদন ও বাস্তবায়নে সক্ষম?

কারও মধ্যে ওপরের শর্তগুলো ঠিকঠাক পাওয়া গেলে তিনি অবশ্যই দায়িত্ব পাওয়ার মতো যোগ্য লোক। সরকার সার্বিক বিবেচনায় যোগ্য কাউকে কোনো পদে নিয়োগ দিলে সবার উচিত হবে তাঁকে দায়িত্ব পালনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা।

অনেক সময় দেখা যায়, যথাযথ মনোনয়নের প্রক্রিয়ায় যাঁকে যোগ্য হিসেবে সুপারিশ করা হয়েছে, তাঁকে নানা ছুতায় ল্যাং মেরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এ রকমের একটি ছুতা হলো ‘জামায়াত কার্ড’। সাক্ষীসাবুদ ছাড়াও যদি কারও দিকে আঙুল তুলে রটিয়ে দেওয়া যায় যে এই লোক জামায়াতের; তবেই চাঞ্চল্য তৈরি হয়। কেউ খতিয়ে দেখার প্রয়োজনও মনে করে না, আসলে এই জামায়াতের লোক জিনিসটা আসলে কী। কী কী কাজ করে থাকলে কেউ জামায়াতের লোক হয়। একজন সার্বিক বিবেচনায় যোগ্য বলে বিবেচিত হওয়ার পরও কেবল জামায়াত কার্ডটা খেলে দিলেই পাশা উল্টে যায়। বৈষম্যহীন বাংলাদেশে এটা চলতে দেওয়া যায় না। এর অবসান হওয়া উচিত।

সমাজে বৈষম্য থাকলে অরাজকতা তৈরি হয়, সংঘাতের পরিবেশ তৈরি হয়। বৈষম্যে থাকলে আইন–আদালত পর্যন্ত মজলুমের পক্ষে দাঁড়ান না। বৈষম্য ও নিপীড়ন প্রকট আকার ধারণ করলে দুর্বল মানুষও আইন হাতে তুলে নেন, নিজেকে বাঁচানোর জন্যই সশস্ত্র হন, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও যুদ্ধে জড়ান। খুনোখুনি আর গণহত্যায় মেতে ওঠেন। শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যৎ চাইলে সমাজে যার যার প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করতেই হবে। বৈষম্যের মূলোৎপাটন করতে হবে। আশা করি, গত জুলাই-আগস্টের বিপ্লবের ফসল হিসেবে এই দেশে আমরা একটি বৈষম্যহীন শান্তিপূর্ণ সমাজ তৈরি করতে সমর্থ হব, ইনশা আল্লাহ।

  • ড. মাহবুবুর রাজ্জাক অধ্যাপক, যন্ত্র কৌশল বিভাগ, বুয়েট।
    ই-মেইল: [email protected]