জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের কর্মকর্তা জন কিরবি গত ৩০ আগস্ট এক বিবৃতিতে বলেন, অস্ত্র বেচাকেনা নিয়ে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে আলাপ-আলোচনা অনেকটাই অগ্রসর হয়েছে। কেননা, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাঁর যুদ্ধযন্ত্র সচল রাখার জন্য অস্ত্রের সন্ধানে নেমেছেন।
একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপে রাশিয়া ও তাদের সামরিক ঠিকাদার ভাগনার গ্রুপ গত বছর উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র নিয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
সামরিক খাতে উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে বড় সহায়তা পেলে সেটা ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে রাশিয়াকে নিশ্চিতভাবে সহায়তা করবে। উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র ব্যবসা ও কেনাকাটার ওপর আমার যে গবেষণা তাতে বলতে পারি, পিয়ংইয়ং অস্ত্র ও গোলাবারুদ বিক্রির বিনিময়ে রাশিয়ার কাছ থেকে মূলত প্রযুক্তি চাইছে।
রাশিয়ার কাছ থেকে প্রযুক্তিগত সহায়তা পেলে উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা বিপুল পরিমাণ বেড়ে যাবে। জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার কারণে এ ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়াকে ভুগতে হচ্ছে।
সর্বশেষ তথ্য বলছে, ভাড়াটে সেনাদল ভাগনার গ্রুপের প্রধান সদ্য মৃত ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র বেচাকেনা আলোচনার একটি অগ্রগতি ঘটেছে। যদিও উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে সেটি অস্বীকার করা হয়েছে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, রাশিয়াকে উত্তর কোরিয়া বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ দিয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া সীমান্তে থাকা একটি মালবাহী ট্রেনের স্যাটেলাইট ছবি প্রকাশ করেন কিরবি। ট্রেনটিতে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
মার্চ মাসে স্লোভাকিয়ার একজন নাগরিকের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই ব্যক্তি উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে অন্তত ২৪ ধরনের অস্ত্র কেনাকাটা প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার অস্ত্র কেনার চুক্তির জন্য অনেক দূর এগিয়েছে।
রাশিয়ার কাছে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে এই অস্ত্রশিল্প নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে উত্তর কোরিয়া যদি রাশিয়ার কাছ থেকে প্রযুক্তি পায়, তাহলে তারা তাদের থমকে যাওয়া অস্ত্রশিল্পে আধুনিকায়ন ঘটাবে।
জুলাই মাসে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র বিক্রেতা রিম ইয়াংয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। তিনি ভাগনারের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে মধ্যস্থতা করেন।
যা-ই হোক, রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোইগুর পিয়ংইংয়ং সফরের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, দুই দেশের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হতে চলেছে। কোরীয় যুদ্ধ বন্ধের ৭০তম বার্ষিকীর অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলেন শোইগু। সামরিক কুচকাওয়াজসহ অন্যান্য আয়োজনে চীনের প্রতিনিধিরাও শোইগুর কাছে ম্লান ছিলেন।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উনের সঙ্গে একটি সমরাস্ত্র প্রদর্শনীতে শোইগুকে দেখা গেছে। এই প্রদর্শনীতে অন্যান্য অনেক অস্ত্রের মধ্যে আন্তমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, দূরপাল্লার হাইপারসোনিক ক্ষেপণাস্ত্র, অত্যাধুনিক ড্রোনব্যবস্থাও ছিল।
১৯৭০-এর দশকে সমরাস্ত্র-শিল্পের ভিত্তি গড়ে ওঠার পর উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র রপ্তানির সক্ষমতা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। শীতল যুদ্ধকালে মতাদর্শিক বন্ধুদের কাছে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র বিক্রি করে উত্তর কোরিয়া। কিন্তু শত্রুপক্ষের কাছেও তারা অস্ত্র বিক্রি করে। ১৯৮০-এর দশকে ইরাকের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ে উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্রের ক্রেতা ছিল ইরান।
গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরির কর্মসূচির কারণে ২০০৬ সাল থেকে জাতিসংঘ ক্রমাগতভাবে উত্তর কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা বাড়িয়ে চলেছে। ২০০৯ সাল থেকে উত্তর কোরিয়া থেকে সব ধরনের অস্ত্র আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাশিয়া এক দশকের বেশি সময় ধরে উত্তর কোরিয়ার ওপর দেওয়া জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে আসছিল। ২০১৭ সালে সর্বশেষ উত্তর কোরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় জাতিসংঘ।
কিন্তু আরেক স্থায়ী প্রতিনিধি চীনের সঙ্গে রাশিয়াও জাতিসংঘের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার বিধিনিষেধ খুব কার্যকরভাবে মেনে চলেছে, তেমনটা বলা যাবে না। রুশ ভূখণ্ডে উত্তর কোরিয়া অস্ত্র বিক্রির নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে, এমন নজির নেই।
প্রকৃতপক্ষে রাশিয়া ও চীন—দুই দেশই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে উত্তর কোরিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তারে প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে।
উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র কেনার পেছনে রাশিয়ার পরিষ্কার উদ্দেশ্য হলো, ইউক্রেন যুদ্ধে সেগুলোর ব্যবহার করা। কিন্তু এর ফলে উত্তর কোরিয়ার ওপর জাতিসংঘের যে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ আছে, সেটিকে বুড়ো আঙুল দেখানো হবে। অস্ত্র বিক্রি করে কিম জং-উন অর্থ আয় করার সুযোগ পাবেন। উত্তর কোরিয়ার অস্ত্রশিল্পে পুনর্জাগরণ ঘটবে।
খাদ্য, তেল, সার ও অন্যান্য পণ্য কেনার পথ বের করতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে উত্তর কোরিয়া। স্লোভাকিয়ার যে নাগরিকের ওপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাঁর সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার যে চুক্তি হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল, অস্ত্রের বিনিময়ে বাণিজ্যিক বিমান, কাঁচামাল ও অন্যান্য কাঁচামাল দিতে হবে।
কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, উত্তর কোরিয়া দীর্ঘদিন ধরেই অস্ত্র বিক্রির অর্থ নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র আধুনিকায়নের কাজে ব্যবহার করে আসছে। এর মধ্যে পরমাণু ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি রয়েছে।
রাশিয়ার কাছে বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে। ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে এই অস্ত্রশিল্প নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে উত্তর কোরিয়া যদি রাশিয়ার কাছ থেকে প্রযুক্তি পায়, তাহলে তারা তাদের থমকে যাওয়া অস্ত্রশিল্পে আধুনিকায়ন ঘটাবে।
মস্কো যদি এখন থেকে উত্তর কোরিয়া থেকে নিয়মিত অস্ত্র আমদানি করে, তাহলে পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধে টিকে থাকার রসদ পাবেন। এর বিনিময়ে উত্তর কোরিয়া যদি প্রযুক্তি হাতে পায়, তাহলে সেটা দীর্ঘ মেয়াদে বিশ্বের জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। বিশ্ব এটা অবশ্যই উপেক্ষা করতে পারে না।
ডেনিয়েল সলসবুরি কিংস কলেজ লন্ডনের ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত