নির্বাচনী প্রচারণা জাতীয় ও স্থানীয়নির্বিশেষে নির্বাচনের একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। প্রচারণার ধরনধারণ দেশে দেশে ভিন্ন হলেও সর্বত্র প্রচারণাই নির্বাচনকে বর্ণিল, আনন্দঘন ও শাসনবিষয়ক তথ্যপ্রবাহের একটি মোক্ষম সুযোগ করে তোলে।
আমাদের মতো কিছু ‘অনুদার গণতান্ত্রিক’ দেশে নির্বাচনী প্রচারকালে নানা সহিংস ঘটনাও ঘটে থাকে। পৃথিবীর দুই শতাধিক দেশে নিয়মিত ও অনিয়মিত স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে নির্বাচন হয়। এসব নির্বাচন সংবিধান ছাড়াও নানা নির্বাচনী আইন ও বিধির অধীনে হয়ে থাকে। সে আইনসমূহের মধ্যে ‘নির্বাচনী প্রচারণা এবং প্রচারণার অর্থ ব্যয়ের জন্যও স্পষ্ট আইনি বিধান রাখা হয়।
এসব আইন লঙ্ঘিত হলে বলা হয় নির্বাচনী আইন ও আচরণবিধি লঙ্ঘিত হয়েছে। তখন নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রার্থী ও লঙ্ঘনকারীর বিরুদ্ধে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তাতে এমনকি প্রার্থিতা বাতিলও হয়ে যায়।
নির্বাচনী প্রচারণায় অর্থ ব্যয় নির্বাচনে সুষ্ঠু ও সমতানীতির একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমাদের দেশের বর্তমান সময়ে তত্ত্বীয়ভাবে নির্বাচনী তহবিল প্রার্থীর নিজস্ব অর্থ বা আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবের প্রদত্ত দান ও সহায়তা থেকে গঠিত বলে ধরে নেওয়া হয়। এ জন্য সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ এ পর্যন্ত সঠিকভাবে হয়নি।
পৃথিবীর অনেক দেশে দলীয় প্রার্থী দলের অর্থসহায়তা, নানা শর্তসাপেক্ষে সরকারি অর্থ এবং গণচাঁদা ও নিজস্ব অর্থ মিলে যে অর্থায়ন, সেভাবে নির্বাচনী ব্যয় নির্বাহ করেন। তবে তা একটি আইনি কাঠামোর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট থেকে স্থানীয় কাউন্সিলর এবং মধ্যখানে সিনেট, কংগ্রেস, রাজ্য গভর্নর, রাজ্য সংসদ, বিচারক, নানা স্তরের স্থানীয় সরকার, স্কুল বোর্ড ইত্যাদি মিলিয়ে ৫,২০,০০০ নির্বাচিত পদ রয়েছে। সে পদগুলোর প্রতিটির নির্বাচনে দেদার অর্থ ব্যয়ের প্রশ্ন জড়িত।
এটি আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে সিনেট ও কংগ্রেস নির্বাচন মেয়র এবং গভর্নর নির্বাচনের চেয়ে অনেক গুণ কম ব্যয়বহুল। ২০১৫-২০১৬ সময়ের পাঁচটি রাজ্যের পাঁচটি ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকানের আসনে বিজয়ী সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানের মোট প্রকৃত নির্বাচনী ব্যয় সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ১,৮০,২০২ থেকে ৩৮,৩৪৬ ডলার মধ্যে সীমিত ছিল। তার মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি গণচাঁদা।
এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচারণায় তেমন কোনো জৌলুশ ও অভিনবত্ব নেই। যদিও বিশ্বব্যাপী আধুনিক প্রযুক্তির কারণে প্রচারণায় অনেক অভিনবত্ব এসেছে। আমাদের এ নির্বাচনে তার কোনো ছোঁয়া লাগছে না। খুবই সাদামাটা ও সনাতনী। সাদাকালো পোস্টার। পুরোনো সে সভা-মিছিলও খুব সীমিত। সমর্থকদের জড়ো করে মিছিল করার চেষ্টা খুব একটা করা হচ্ছে না।
অপর দিকে নিউইয়র্ক সিটির ২০০১, ২০০৫ ও ২০০৯ তিনবারের মেয়র নির্বাচনে ব্লুমবার্গ মোট ৪২০ (গড়ে ১২০) মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেন।
২০১০ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর নির্বাচনে মেগ হুইটম্যান ও হিউলেট পিকার্ড যথাক্রমে ১৭৬ ও ১৪৪ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে জেরি ব্রাউনের কাছে হেরে যান। জেরির মোট ব্যয় ছিল ৪৪ মিলিয়ন ডলার।
২০১৮ সালে ইলিনয়ে ক্ষমতাসীন ব্রুস রউমনি ও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দুজনে যথাক্রমে ৬১ ও ১৭১ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেন।
সব ক্ষেত্রে এখানে মেয়র ও গভর্নর প্রার্থীরা নিজেদের তহবিলের অর্থই ব্যয় করেছেন। নির্বাচন নিঃসন্দেহে ছিল ব্যয়বহুল। কিন্তু হিসাব ছিল অত্যন্ত স্বচ্ছ। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন বাদ দিলে সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্য পদের নির্বাচন আমাদের দেশের তুলনায়ও কম ব্যয়বহুল।
এর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। কারণটি হচ্ছে আইনসভার সদস্যদের কাজকর্ম সংসদের চার দেয়ালে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। তাঁরা নির্বাহী কাজ বা সরাসরি উন্নয়ন ব্যয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এবং ৯৩ শতাংশ ক্ষেত্রে দুই কক্ষের সংসদীয় আসনে খুব একটা রদবদলও হয় না। দলীয় নীতির আলোকে সংসদের দুটি কক্ষের ভোটের ফলাফল নির্ধারিত হয়।
আমাদের এক কক্ষবিশিষ্ট সংসদীয় আসন দেশের পুরো আইন, শাসন ও বিচারব্যবস্থায় এত গুরুত্বপূর্ণ যে আমাদের সংসদ সদস্যরা স্থানীয় ও জাতীয় ক্ষমতার প্রাণভোমরা এবং বৈধ-অবৈধ প্রভাব বিস্তারের প্রধান নির্ভরশীল ব্যক্তি। বরং জাতীয় সংসদের আইন প্রণয়নে মোট কাজ বা সময়ের ১০ শতাংশের কম ব্যয় করে তাঁরা নিজেদের ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থানীয় উন্নয়ন, নানা অর্থ ও মুনাফাসংশ্লিষ্ট তদবির এবং সরকারি-বেসরকারি চাকরি, পদোন্নতি, পদায়ন, তদবির প্রভৃতিতে বেশি সময় ব্যয় করেন।
এখানে ‘রাজনৈতিক প্রভাব’ অনেক বেশি কাঁচা টাকা অর্জনের হাতিয়ার। তাতে আমাদের দেশের জাতীয় সংসদ সদস্য পদ অতি আকর্ষণীয়, মুনাফাবহুল ও লাভজনক বিবেচিত এবং একই কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও এ নির্বাচন ব্যয়বহুল।
যদিও এ পদকে ‘অলাভজনক’ বলে জাতীয় সংসদে ঘোষিত হয়েছে কিন্তু দ্বাদশ সংসদীয় নির্বাচনের মনোনয়নপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া হলফনামার তথ্যে পূর্বতন সংসদের সদস্যদের সম্পদ বৃদ্ধির যে হার, তা জাতীয়-আন্তর্জাতিক যেকোনো ব্যবসার আয়ের হার বৃদ্ধিকে ম্লান করে দেয়। একই কারণে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের নিজস্ব সম্পদ থেকে যে নির্বাচনী ব্যয়, তা-ও আকাশছোঁয়া।
এবারের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রচারণায় তেমন কোনো জৌলুশ ও অভিনবত্ব নেই। যদিও বিশ্বব্যাপী আধুনিক প্রযুক্তির কারণে প্রচারণায় অনেক অভিনবত্ব এসেছে। আমাদের এ নির্বাচনে তার কোনো ছোঁয়া লাগছে না। খুবই সাদামাটা ও সনাতনী। সাদাকালো পোস্টার। পুরোনো সে সভা-মিছিলও খুব সীমিত। সমর্থকদের জড়ো করে মিছিল করার চেষ্টা খুব একটা করা হচ্ছে না।
পেশাদার কণ্ঠশিল্পীদের কণ্ঠে নির্বাচনের গান এবং পেশাদার বিজ্ঞাপনের নাটকীয় সংলাপে কণ্ঠ রেকর্ড করা হয়েছে। সে অডিও রেকর্ড বাজিয়ে সড়কে একটি ভ্যান, ট্যাক্সি বা জিপ নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। চালকসহ দুজন থাকলেই হয়। দূর থেকে শুনলে মনে হবে কোনো প্রার্থীর সমর্থনে একটি বিরাট মিছিল আসছে, আসলে দুজন ব্যক্তি ও একটি অডিও রেকর্ডার। ব্যয়সাশ্রয়ী, কিন্তু জনসম্পৃক্ততাবিহীন একটি প্রচারণা।
সুতায় টাঙানো অসংখ্য পোস্টার। নৌকার প্রার্থী এবং শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী যেসব আসনে আছেন, সেখানে প্রচারণায় কিছু উত্তাপ-উত্তেজনা আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রার্থীকে ভোটাররা চেনেন না। আমার বাড়ি আসা-যাওয়ার পথে এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর অফিস। সব সময় সেটি জনশূন্য দেখেছি। একজনের খালি গ্যারেজ।
কখনো কখনো হাটে-ঘাটে, দোকানে-বাজারে, মসজিদে টুপি মাথায় দোয়া চাইতে দেখা যায়। নৌকা ও স্বতন্ত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্যরা জোর দিয়ে ভোট চান না, দোয়া চান। তবে দুই আওয়ামী লীগসহ কিছু প্রার্থীর মাইনে করা কিছু নারী-পুরুষ কর্মীকে দেখা গেছে। তাঁরা অফিসে বসে, গাড়িতে ঘুরে, মাঝেমধ্যে গান বাজায় ও গলা মেলায় কিন্তু জনসংযোগ বলতে যা, তা খুব একটা করে না। অভিনবত্বহীনতাই বোধ হয় এবারের নির্বাচনী প্রচারের অভিনবত্ব।
ড. তোফায়েল আহমেদ অধ্যাপক, নির্বাচন বিশ্লেষক ও স্থানীয় শাসন বিশেষজ্ঞ।