তিস্তা নদীকে ঘিরে একটি মহাপরিকল্পনার কথা প্রায় সাত বছর ধরে আমরা শুনে আসছি। এই মহাপরিকল্পনা আদৌ আলোর মুখ দেখবে কি না, এ নিয়ে বিস্তর সন্দেহ ছিল। সম্প্রতি চীনের রাষ্ট্রদূত এবং ‘পাওয়ার চায়না’ নামক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা নীলফামারীর ব্যারাজ, রংপুরের মহিপুর এবং গাইবান্ধার হরিপুর এলাকায় তিস্তা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। ‘পাওয়ার চায়না’ ২০১৬ সালে তিস্তা মহাপরিকল্পনার সমীক্ষার কাজ করেছিল। তিস্তা পরিদর্শনকালে চীনের রাষ্ট্রদূত মহাপরিকল্পনার বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, তিস্তা মহাপরিকল্পনা দ্রুত আলোর মুখ দেখবে। সম্প্রতি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকও একটি বেসরকারি টেলিভিশনে মহাপরিকল্পনার বিষয়ে আশাজাগানিয়া বক্তব্য দিয়েছেন। ফলে তিস্তাপারের মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে।
২০০৯ সাল থেকে রিভারাইন পিপল, ২০১৬ সাল থেকে ‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ’ তিস্তা সুরক্ষার দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। অনেক সংগঠন তিস্তা নিয়ে কাজ করলেও এ সংগঠনের মতো এত তীব্র নয়। তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের তিস্তা সুরক্ষার আন্দোলন এখন তুঙ্গে। এ সংগঠনের কাজে তিস্তা রক্ষার দাবিতে তিস্তা-তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকায় এবং অনেক চরাঞ্চলে গিয়েছি। দেখেছি এই আন্দোলনের ফলে তিস্তাপারে যেমন গণজাগরণের সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি মানুষের মধ্যে একটি আকাঙ্ক্ষাও তৈরি হয়েছে। তিস্তাপারের মানুষ এখন তিস্তা মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন চায়।
চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং তিস্তা পরিদর্শন করার পর থেকেই তিস্তাপারে বইছে উৎসবের আমেজ। নদীপারের মানুষের মুখে মুখে তিস্তা মহাপরিকল্পনার কথা। তিস্তা মহাপরিকল্পনা অনেক রকম আশার সঞ্চার করেছে। তিস্তাপারের সাধারণ মানুষ মনে করে, মহাপরিকল্পনা হলে তিস্তার ভাঙন বন্ধ হবে, কম পানিতে বন্যা দূর হবে। জেলেরা মনে করে, নদীতে গভীর পানি সারা বছর থাকবে। ফলে আগের মতো প্রচুর মাছ থাকবে। রিভারাইন পিপলের তিস্তা শাখার আহ্বায়ক মঞ্জুর আরিফ বলেন, ‘তিস্তায় পানির গভীরতা কমে যাওয়ার কারণে তিস্তা নদী থেকে গভীর পানির অনেক মাছ হারিয়ে গেছে। তিস্তার গভীরতা ফেরানো গেলে আবারও গভীর পানির মাছগুলো পাওয়া যাবে।’ মাঝিরা মনে করেন, সারা বছর নৌকা চালিয়ে তাঁরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন।
তিস্তা বাংলাদেশ-ভারত আন্তসীমান্তীয় নদী। নদীটির পূর্ণ পরিচর্যার জন্য অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনা জরুরি। তিস্তা নদীতে ন্যায্য হিস্যার ভিত্তিতে ভারত থেকে বাংলাদেশকে পানি পেতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সরকার যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তা অন্তর্দেশীয় ব্যবস্থাপনা। আন্তর্দেশীয় এবং অর্ন্তদেশীয় দুই ব্যবস্থাপনায় তিস্তা পূর্ণরূপে ভালো থাকবে। আন্তর্দেশীয় ব্যবস্থাপনার চেষ্টাও সরকারকে অব্যাহত রাখতে হবে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনার যথাযথ বাস্তবায়ন হলে রংপুর অঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় রকম ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশের ১০টি গরিব জেলার ৫টিই রংপুর বিভাগে। তার চারটি জেলা তিস্তার ভাঙন ও বন্যার কারণে গরিব। তিস্তার ভাঙন রোধ হলে, কম পানিতে বন্যা বন্ধ হলে এবং লাখ লাখ হেক্টর পরিত্যক্ত জমি চাষাবাদযোগ্য হয়ে উঠলে দারিদ্র্যের কলঙ্কতিলক থেকে রক্ষা পাবে এসব জেলা। তিস্তার দুই ধারে উদ্ধার জমিতে সরকার কোনো শিল্পকারখানা গড়ে তুললে এ অঞ্চলের মানুষের প্রচুর কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে।
‘তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ’ থেকে আমরা সুনির্দিষ্ট ছয় দফার দাবিতে আন্দোলন করছি। এই ছয় দফার মধ্যে তিস্তা নদী, নদীপারের কৃষক, কৃষি, জীববৈচিত্র্য, যোগাযোগব্যবস্থা, শাখা নদী, উপনদী সবকিছুরই সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে। মহাপরিকল্পনা যাতে পরিবেশবান্ধব হয়, বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর অভিঘাত প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে পারে, সে দাবিও আছে। উন্নত বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তিস্তা নদীর বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যা আমাদের দাবি। তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নজরুল ইসলাম হক্কানী চীনা রাষ্ট্রদূতকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানোর পর তিস্তাপারে উপস্থিত সংগঠকদের উদ্দেশে বলেন, দীর্ঘ অপেক্ষার পর চীনের রাষ্ট্রদূতের এ সফরের মধ্য দিয়ে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অর্থায়ন ও কারিগরি সহযোগিতায় যে আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে, তা যেন জাগরুক থাকে। মহাপরিকল্পনা বিজ্ঞানসম্মতভাবে কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন অব্যাহত রাখার কথাও তিনি বলেন।
বাংলাদেশে তিস্তা নদীতে যে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে, এমন কোনো প্রকল্প দেশের অন্য কোনো নদীতে গ্রহণ করা হয়নি। তাই আমরা চাই, এ নদীতে যে প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে তা যেন নদী পরিচর্যার মাইলফলক হতে পারে। এই প্রকল্প জনবান্ধব, নদীবান্ধব এবং পরিবেশবান্ধব হলে দেশের অপরাপর বড় বড় নদীতেও তা অনুসরণ করা যাবে। তিস্তা নদীতে এক বছরে ভাঙন-বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকার বেশি। মহাপরিকল্পনায় মাত্র আট-দশ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করলে এক বছরেই সাশ্রয় হবে তার বহুগুণ।
২০১৬ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী তিস্তা নদীর এই মহাপরিকল্পনার জন্য যে সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন, তা বাংলাদেশ সরকার ঋণ হিসেবে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছে চেয়েছিল মর্মে আমরা জেনেছি। এই টাকা চীন সরকার দিতে সম্মত হয়েছে। তিস্তা নদীকে ঘিরে বাংলাদেশ-ভারত-চীন ভূরাজনৈতিক কিছু বিষয়ও আছে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করে এসেছেন। যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে যান, তখন রংপুরে বিশাল সমাবেশ করেছিল তিস্তা বাঁচাও, নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ। সেখানে ন্যায্য হিস্যার ভিত্তিতে পানি চাওয়ার সঙ্গে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দাবি জানানো হয়। কোনো দেশ থেকে অর্থ পাওয়া না গেলে নিজস্ব অর্থায়নে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবি উঠেছিল। সেটিও সম্ভব না হলে বিকল্প ‘তিস্তা কর্তৃপক্ষ’ গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছিল। এরই মধ্যে জানা যাচ্ছে, সরকার চীনের কাছে ঋণসহায়তা চেয়েছে এবং চীনও সহায়তা দিতে সম্মত হয়েছে।
তিস্তা মহাপরিকল্পনায় কোন কোন বিষয় অন্তর্ভুক্ত আছে, সেটি পরিষ্কার জানা যায়নি। নিশ্চয়ই এমন কোনো কিছুই থাকবে না যা গণবিরোধী। তিস্তা মহাপরিকল্পনায় তিস্তার শাখা নদী এবং উপনদীগুলোকে পূর্বের প্রাণপ্রবাহে ফেরানোর ব্যবস্থা থাকতে হবে। আউলিয়াখান, কুমলাল, ধুম, সানিয়াজান, কালীবাড়ী, সতী, বুড়াইল, কোটেশ্বর, চাকিরপশা হচ্ছে তিস্তার উপনদী। তিস্তার শাখা নদী হচ্ছে ঘাঘট, মানাস, বাইশাডারা। তিস্তার প্রশাখা তথা ঘাঘটের শাখা নদী শ্যামাসুন্দরী, শালমারা নদী। ঘাঘটের উপনদী খোকসাঘাঘট, অলাইকুমারী এবং বুড়াইল নদী। শালমারার উপনদী কাফ্রিখাল নদী। তিস্তার শাখা-উপনদী এমনকি এর শাখা এবং উপনদীগুলোর শাখা উপনদীগুলোরও প্রাণপ্রবাহ পূর্বের ন্যায় ফেরাতে হবে।
তিস্তা বাংলাদেশ-ভারত আন্তসীমান্তীয় নদী। নদীটির পূর্ণ পরিচর্যার জন্য অভিন্ন নদী ব্যবস্থাপনা জরুরি। তিস্তা নদীতে ন্যায্য হিস্যার ভিত্তিতে ভারত থেকে বাংলাদেশকে পানি পেতেই হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ সরকার যে মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তা অন্তর্দেশীয় ব্যবস্থাপনা। আন্তর্দেশীয় এবং অর্ন্তদেশীয় দুই ব্যবস্থাপনায় তিস্তা পূর্ণরূপে ভালো থাকবে। আন্তর্দেশীয় ব্যবস্থাপনার চেষ্টাও সরকারকে অব্যাহত রাখতে হবে।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক