লেবাননের জন্য ২০২৪ ছিল ভয়ানক একটা বছর। অনেকগুলো সমস্যা লেবাননকে বছরের পর বছর ধরে জর্জরিত করে রেখেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ২০১৯ সালের অর্থনৈতিক ধস, ২০২০ সালে বৈরুতে বন্দরে বিস্ফোরণ এবং ২০২২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অচলাবস্থা।
২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর শুরু হওয়া গাজা যুদ্ধের অভিঘাত লেবাননের ওপর পড়ে। কারণ, হিজবুল্লাহ সেই সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে। সেপ্টেম্বর মাসে সংঘাতের গতিপথ নাটকীয়ভাবে বদলে যায়। ইসরায়েল সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু করে। শুধু হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটি নয়, সারা দেশেই আক্রমণ শুরু করে ইসরায়েল। একেবারে খাদের কিনারে পৌঁছে যায় লেবানন। প্রশ্ন হচ্ছে, ২০২৫ সালে তারা কি সেখান থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পাবে।
এ বছরটি লেবাননের জন্য রাজনৈতিক অচলাবস্থার বছর। ইসরায়েলি যুদ্ধ ও চরম মেরুকৃত একটা সমাজ দিয়ে এটাকে চিহ্নিত করা যায়।
২০২২ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট মিশেল আউনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর রাজনৈতিক শ্রেণিগুলো তাঁর উত্তরাধিকারের ব্যাপারে একমত হতে পারেনি। হিজবুল্লাহ তাদের প্রার্থী হিসেবে সুলেইমান ফ্যাঞ্জিকে সামনে এনেছিল, কিন্তু হিজবুল্লাহবিরোধী শিবির তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে। এর ফলে লেবাননে কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়নি, দেশটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে। এক বছর পর গাজা যুদ্ধ শুরু হয়, হিজবুল্লাহ একটি ‘সমর্থন ফ্রন্ট’ খোলে। এ সুযোগে হিজবুল্লাহ আরেকবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার অজুহাত পেয়ে যায়।
গাজা যুদ্ধ হিজবুল্লাহর জন্য হুমকি হিসেবে আসে। হিজবুল্লাহ জানত ইসরায়েল যদি সফল হয়, তাহলে তারাই পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু। সে কারণেই হিজবুল্লাহ সমর্থন ফ্রন্ট খুলেছিল। হিজবুল্লাহ এটিকে সংহতির যুদ্ধ বললেও নিরাপত্তার কারণে এটা তাদের দরকার ছিল।
গাজা যুদ্ধ শুরুর আগেই হিজবুল্লাহ জাতিসংঘের ১৭০১ নম্বর রেজল্যুশন মেনে না চলায় তদন্তাধীন ছিল। সে কারণে সংহতি ফ্রন্ট খোলা তাদের জন্য একটা জুয়া খেলার মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যাই হোক সেপ্টেম্বর মাসে এই সংঘাতের গতি পাল্টে যায়।
আরেকটি ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে, লেবানন ছোট একটা দেশ। অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে এবং অর্থনীতির চাকা সচল করার জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলারই যথেষ্ট। লেবানের মানবপুঁজি আছে। তাদের মধ্যে উদ্যোক্তা মনোভাবও আছে। ফলে আমাদের আশার চেয়ে দ্রুতগতিতে পুনরুদ্ধারের কাজ শেষ হতে পারে। আবার একটা স্থিতিশীল সরকার হলে প্রবাসীরাও লেবাননে বিনিয়োগ করতে আসবেন।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ইসরায়েল বহু বছর ধরে এ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিল। ২০০৬ সালের যুদ্ধের ব্যর্থতা থেকে ইসরায়েল বুঝেছিল তাদের প্রধান ব্যর্থতা গোয়েন্দা ক্ষেত্রে। সে কারণে তারা গোয়েন্দাকাজে মনোনিবেশ শুরু করে।
নিজেদের ব্যাংকসহ আরও অনেক ব্যবসার মাধ্যমে হিজবুল্লাহর একটা বাণিজ্য সাম্রাজ্যও আছে। কৃত্রিম মাদক কেপ্টাগন ব্যবসারও অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে।
যাই হোক, হিজবুল্লাহর শীর্ষ কমান্ডারদের তথ্য ইসরায়েলের কাছে প্রকাশ হতে শুরু করে। তেল আবিব তাদেরকে শনাক্ত করতে ও লক্ষ্যবস্তু করতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। সে কারণে গোষ্ঠীটি যোগাযোগের জন্য পেজারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।
এরপর সেপ্টেম্বরে ইসরায়েল পেজারের নেটওয়ার্কে হামলা করে। এই হামলা যুদ্ধের গতি পরিবর্তন করে দেয়। এরপর ইসরায়েল লেবাননে বোমা হামলা ও হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে। এসব কিছু ঘটতে পেরেছে তার কারণ হলো, লেবাননে কোনো প্রেসিডেন্ট নেই, সত্যিকারের কোনো সরকার নেই অথবা কার্যকর কোনো কূটনীতি নেই।
২০০৬ সালে লেবাননের কূটনীতি সে সময়কার ইসরায়েল–লেবানন যুদ্ধ বন্ধে কার্যকর হয়েছিল। এর কারণ হলো, তখনকার প্রধানমন্ত্রী ফুয়াদ সিনিওরা তাঁর অতি যোগ্য মন্ত্রী তারেক মিত্রিকে এ কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। এখন লেবাননের কূটনীতি অসাড়।
২২ নভেম্বর ছিল লেবাননের গৃহযুদ্ধ শুরুর পর সবচেয়ে বাজে স্বাধীনতা দিবস। এর চার দিন পর একটি অস্ত্রবিরতি চুক্তি হয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, লেবানন কি নিজেকে পুনর্জাগরণ ঘটাতে পারবে, নাকি আগামী ৩০ বছর ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে থেকে যাবে। কোন বিকল্পটা বেশি বাস্তব বলে মনে হচ্ছে? আমিরাতের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ আবদুল খালেক আবদুল্লাহ কয়েক দিন আগে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, লেবাননে এরপর কী হবে?
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, পরিস্থিতির উন্নতি হবে। ভালোর দিকে যাওয়ার আগে পরিস্থিতি কিছুটা খারাপ হতে পারে। কিন্তু একেবারে খারাপের দিকেই যাত্রা করবে না; কারণ, আমরা একেবারে খাদের কিনারায় পৌঁছে গেছি। দক্ষিণ লেবাননের চারটির মধ্যে একটি ভবন ধ্বংস হয়েছে অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সুতরাং এরপর কী? একটা ভালো ভবিষ্যৎ পেতে গেলে আমাদের কী করা দরকার?
২০০৬ সালে আরব দেশগুলো লেবানন পুনর্গঠনের জন্য কোনো শর্ত ছাড়াই সহযোগিতা দিয়েছিল। এবার সে রকম কিছু ঘটার সম্ভাবনা নেই। এবার সহযোগিতা তিনটি শর্তের ওপর নির্ভর করবে। প্রথমত, আরব রাষ্ট্রগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় লেবাননে কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর আধিপত্য মেনে নেবে না। দ্বিতীয়ত, পুনর্নির্মাণ প্রকল্পের জন্য তারা একটা গ্রহণযোগ্য সরকারকে দেখতে চাইবে। তৃতীয়ত, পুরো প্রক্রিয়ায় তারা স্বচ্ছতা দেখতে চাইবে।
সর্বোপরি তারা এবার স্থিতিশীলতার স্বার্থে সুশাসনে আপস করবে না।
এখন পর্যন্ত যেটা মনে হচ্ছে, আগামী ৯ জানুয়ারি চাপে পড়ে হিজবুল্লাহ ঐকমত্যের ভিত্তিতে একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করতে পারে। সেই প্রেসিডেন্ট আরব বিশ্ব ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে একটা বিশ্বাসযোগ্য সরকার গঠন করতে পারবেন। এই গ্রহণযোগ্য সরকার সম্ভবত একটা টেকনোক্র্যাট সরকার হতে পারে। তারা লেবাননকে এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে কাজ করতে পারে। আগের সরকারের মতো মন্ত্রীরা বিভিন্ন রাজনৈতিক শ্রেণিগুলোর মধ্যে টাকাপয়সা ভাগ–বাঁটোয়ারায় মনোনিবেশ করবে না বলে আশা করি।
ভালো খবরটা হচ্ছে, সুশাসনের একটা খবর নিউক্লিয়াসের আকারে তৈরি হচ্ছে। লেবাননে যে বিপর্যয় তৈরি হয়েছে, তাতে করে একটা সুযোগ নিয়ে এসেছে। লেবানন একটি জরুরি কমিটি করেছে যেটা স্বচ্ছতা, দক্ষতা ও কার্যকরভাবে ১২ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষকে তদারকি করছে। এ প্রক্রিয়াকে সরকারের অন্যান্য পুনর্গঠন ও সংস্কারকাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।
আরেকটি ইতিবাচক বিষয় হচ্ছে, লেবানন ছোট একটা দেশ। অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে এবং অর্থনীতির চাকা সচল করার জন্য কয়েক বিলিয়ন ডলারই যথেষ্ট। লেবানের মানবপুঁজি আছে। তাদের মধ্যে উদ্যোক্তা মনোভাবও আছে। ফলে আমাদের আশার চেয়ে দ্রুতগতিতে পুনরুদ্ধারের কাজ শেষ হতে পারে। আবার একটা স্থিতিশীল সরকার হলে প্রবাসীরাও লেবাননে বিনিয়োগ করতে আসবেন।
যাহোক আমার কাছে মনে হয়, ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে আমাদের লেবাননের পুনর্জন্ম হবে।
দানিয়া কোলেইলাত খাতিব মার্কিন–আরব সম্পর্কের বিশেষজ্ঞ
আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত