মায়ের কোল থেকে শিশু গৃহশ্রমিক যেভাবে ফ্রিজিং ভ্যানে

ধরে নিই, ১০ বছরের ছোট্ট মেয়েটির নাম পাখি। পাখির বাবা তাকে ঢাকায় পাঠিয়েছিল তিনবেলা খাবার ও মাথার গোঁজার ঠাঁই পাবে বলে। এর বদলে পাখি পৈশাচিক মার খেয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। তার ছোট্ট দেহখানি লুকিয়ে রেখেছিলেন গৃহকর্ত্রী। কিন্তু দুই দিন পর মগবাজারের একটি হাসপাতালের সামনে ফ্রিজিং ভ্যান থেকে পাখির গলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। শিশুটির শরীরে নির্যাতনের অসংখ্য চিহ্ন ছিল। তাকে গোপনে কবরস্থ করার জন্য ফ্রিজিং ভ্যানে রেখে দেওয়া হয়েছিল।

অসহায় বাবা গ্রাম থেকে ছুটে এসেছিলেন পাখির অসুস্থতার কথা শুনে। কিন্তু এসে মেয়ের দেখা পেলেন না। মেয়ে কোথায় জানতে চেয়ে কোনো উত্তরও পেলেন না। অগত্যা তাঁকে ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশের সাহায্য নিতে হয়েছিল।

পাখি একাই এ নির্মম নির্যাতনের শিকার নয়, এ রকম নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে দেশে। চলতি বছরের শুধু জানুয়ারি মাসেই তিনজন শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের শিকার হয়ে নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজনের বয়স ৭ থেকে ১২-এর মধ্যে এবং একজনের বয়স ১৩ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। (আইন ও সালিশ কেন্দ্র)

মাত্র কিছুদিন আগেই কুমিল্লাতে কিশোরী গৃহকর্মীকে মারধর ও গরম পানি দিয়ে শরীর ঝলসে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। বাঁচার জন্য বাসার দোতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে কিশোরী গৃহকর্মী আত্মরক্ষা করেছে। এরও আগে ১১ বছর বয়সী গৃহকর্মী হাসিনার মৃতদেহ পাওয়া গেল ঢাকার মোহাম্মদপুরে। তার সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। ময়নাতদন্তে বলা হয়েছে, তাকে মৃত্যুর আগে ধর্ষণও করা হয়েছিল।

পাখির বাবার মতো হাসিনার রিকশাচালক বাবাও দুমুঠো খাবারের জন্য মেয়েকে কাজে দিয়েছিলেন। একবারও ভাবেননি, মেয়েটি নির্যাতিত হয়ে মারা যাবে। এরপর তাঁরা ঢাকা ছেড়ে আবার গ্রামে ফিরে গেছেন। হাসিনার বাবার ঘরবাড়ি, জমিজমা, টাকাপয়সা কিচ্ছু ছিল না, ছিল শুধু মেয়েটা। তাকেও হত্যা করল গৃহকর্তা। এ ছবি খুব স্বাভাবিক, অভাবের কারণে গৃহকর্মী হিসেবে ঢাকা শহরের বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করতে আসেন অনেকেই।

বাংলাদেশে অধিকাংশ গৃহকর্মী দাসত্বের শৃঙ্খলে বাধা পড়ে আছেন। তাঁদের অনেকে মারা যান, নির্যাতনের হাত থেকে পালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন, পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েন, যৌনদাসী হয়ে যান। তাঁদের জন্য নিরাপত্তামূলক কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই অভিযোগ জানানোর জায়গা, নেই বিশেষভাবে বিচার পাওয়ারÿক্ষমতা। তাই গৃহশ্রমিক নিয়ে কর্মরত সংগঠনগুলো মনে করে গৃহশ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার না দিলে এর সমাধান হবে না। একই সঙ্গে সংগঠনকে মামলার বাদী হতে আইন করতে হবে।

অসংখ্য শিশু ও নারী গৃহকর্মীর নির্যাতিত হওয়ার কথা লেখা যাবে। পাশাপাশি তাঁদের কেউ যে বিচার পাননি, এ কথাও লিখতে হচ্ছে। শুধু পত্রপত্রিকার মাধ্যমে যেসব ঘটনা আমরা জানতে পারি, বাস্তবে গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনা আরও অনেক বেশি। সব ধরনের পেশাজীবীর বাড়িতেই গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনার খবর ছাপা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকেও নির্যাতিত গৃহকর্মীদের পক্ষে কোনো আইনি ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি কখনো।

গৃহকর্মীদের অধিকার, মর্যাদা ও সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় করা সম্প্রতি এক গবেষণায় উঠে এসেছে যে দেশের গৃহকর্মীরা দিনে গড়ে ১৪ ঘণ্টা কাজ করেন, তাঁদের ৮৭% কোনো সাপ্তাহিক ছুটি পান না। এ ছাড়া ২৬% গৃহকর্মীর কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি কিংবা বিলম্বের কারণে বেতন কাটা হয়ে থাকে। ‘শোভনকাজ ও কর্মক্ষেত্রে জেন্ডার সহিংসতা: বাংলাদেশের নারী গৃহকর্মী’ বিষয়ে বিলস-সুনীতি প্রকল্পের পক্ষে ডিনেট গবেষণাটি করেছে। এতে বলা হয়, প্রায় ৯৯% গৃহকর্মীকে কোনো ধরনের পেশাকালীন ঝুঁকি বা বিপদকালীন সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় না।

গৃহকর্মীরা সামাজিক সুরক্ষা, যেমন চাকরি থেকে বহিষ্কারপরবর্তী সুবিধাদি, প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্র্যাচুইটি, পেনশন, দুর্ঘটনা-সম্পর্কিত সুবিধাদি, চিকিৎসাভাতা—এসব কখনো পানই না; বরং কথায় কথায় মারধর, ভর্ৎসনা, গঞ্জনার মুখে পড়েন। এ ছাড়া যৌন হয়রানি, ধর্ষণের ঘটনাও অনবরত ঘটছে। তবে ঠিক কতজন গৃহকর্মী কাজ করতে এসে মালিকের নির্যাতনে নিহত হচ্ছেন, এর কোনো সঠিক হিসাব নেই। এ নিয়ে কোনো গবেষণা হয়নি, নেই কোনো সরকারি হিসাব। আমরা দেখেছি, কর্মক্ষেত্রে গৃহকর্মী নিহত হলে, সেটা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয় বা অন্যভাবে ধামাচাপা দেওয়া হয়।

গৃহকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন দেখেছে যে অপরাধীরা ধরা পড়লেও শাসিত হচ্ছে না। টাকা, ক্ষমতার প্রভাবে বা আইনের ফাঁক গলে অপরাধীরা বেরিয়ে আসছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫’ প্রণয়নের লক্ষ্যে বহুদিন ধরে সরকারের সঙ্গে কাজ করছে সংস্থাটি। সেই নীতিমালাতে গৃহকর্মীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার, তাঁদের বেতনভাতা ঠিকমতো পরিশোধ, নির্যাতন না করা, শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তা বিধান, ভরণপোষণ, ছুটি, প্রণোদনাসহ আরও সুবিধার কথা স্পষ্ট করে বলা আছে।

‘বাংলাদেশের শিশু পরিস্থিতি’ নিয়ে প্রতিবেদন করতে গিয়ে এমজেএফ লক্ষ করেছে, সারা দেশে যত গৃহকর্মী আছেন, অধিকাংশই নারী এবং শিশু। যাঁরা ধর্ষণ, হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তাঁদের বয়স ১০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ‘আমরা একটা কেসও কিন্তু এখন পর্যন্ত জাজমেন্ট সে রকম দেখিনি যে গৃহশ্রমিককে মারার কারণে শাসিত হয়েছে। যে দিনের ভেতরে ইনভেস্টিগেশন শেষ হওয়া এবং একটা কেস শেষ হওয়ার কথা, সেটাও নেই। এ ধরনের সেনসিটিভ কেসগুলো যদি ফার্স্ট ট্র্যাক কোর্টে শেষ করে ফেলা যায় ১৮০ দিনের মধ্যে, তাহলে কিন্তু অনেকগুলো দৃষ্টান্তমূলক শাসিত আমরা দিতে পারি, কিন্তু সেগুলো হয় না।’ তিনি আরও বলেন, গৃহকর্মীরা সবাই হতদরিদ্র, কিন্তু দোষী ব্যক্তিরা সবাই প্রভাবশালী, ‘এখানে যেহেতু তদন্ত সময়মতো হয় না বলে সেখানে করাপশন থেকে শুরু করে অনেক বিষয় ঢুকে যায়। আর কেস যখন চলতে থাকে একটা পর্যায়ে গিয়ে বাবা-মায়েরা আপস করে ফেলেন বা টাকাপয়সা নিয়ে মিটমাট করে ফেলেন।’ (বিবিসি বাংলা)

মানবাধিকার কর্মীরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছেন যে গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের হার উদ্বেগজনক এবং গৃহকর্মী নির্যাতনের দৃষ্টান্তমূলক বিচার হয় না বলেই এ ঘটনা কমছে না।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) ২০২১ সালে ২৮৭ জন গৃহশ্রমিকের ওপর এক জরিপ করেছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৫০ ভাগ শ্রমিক জানিয়েছেন, তাঁরা শারীরিক বা মানসিক কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গৃহকর্মীদের আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় তাঁরা মামলা করতে চান না বা মামলা করলেও তা চালাতে চান না বলে জানায় বিলস। ডয়েচে ভেলে
ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স রাইট নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে গৃহশ্রমিকেরা আর্থিক ও সামাজিকভাবে দুর্বল হওয়ায় অনেক ঘটনায় মামলাই হয় না। আর মামলা হলেও শেষ পর্যন্ত বিচার পাওয়া যায় না। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সংস্থাটি বলেছে, প্রথমত, মামলার বাদী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হয় পুলিশ। এজাহার থাকে দুর্বল, অভিযোগপত্রও হয় দুর্বল। আর এর মধ্যে আসামিরা অর্থ ও প্রভাব খাটিয়ে আদালতের বাইরে মামলা মিটিয়ে ফেলেন। ঘটনার সাক্ষীও পাওয়া যায় না।

আরও পড়ুন

অনেকেই অভিযোগ করেন, গৃহকর্মীরা চুরি করে, বেয়াদবি করে, ঠিকমতো কাজ করতে চায় না। এ অভিযোগ যদি মেনেও নিই, তাও বলতে হয়, কাউকে পছন্দ না হলে তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়া যায়। নির্যাতন, পুড়িয়ে দেওয়া ও হত্যা করতে হবে কেন? ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি করা হয় কেন? অধিকাংশ গৃহকর্তা বা কর্ত্রী তাঁদের বাড়িতে থাকা সাহায্যকারী ব্যক্তিটিকে পরিবারের সদস্য বলে মনে করতে পারেন না।

গৃহকর্মীদের নাম কোথাও রেজিস্ট্রেশন করা হয় না এবং গৃহশ্রমিক হিসেবে কোনো পরিচয়পত্র বা নিয়োগপত্র থাকে না বলে তাঁদের সম্পর্কে কোনো তথ্য থাকে না। এসব মানুষ সারা দিন কাজ করার পরও তাঁদের শ্রমিক হিসেবে গণ্য করা হয় না। এ কারণে তাঁদের বেতন ও অধিকার রক্ষায় কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

কিন্তু শ্রমিকের জন্য আইন ইস্যুটি সর্বজনীন মানবাধিকার সনদে এবং আমাদের সংবিধানে আছে। যেহেতু তাঁরা ‘শ্রম আইন ২০০৬’-এর বাইরে, তাই তাঁরা অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, তাঁরা শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, কিন্তু বিচার পাচ্ছেন না।

গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি ২০১৫-তে ১৬টি শর্ত বা বিধান দেওয়া আছে, যেখানে গৃহকর্তা, শ্রমিক এবং সরকারের দায়িত্ব সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর অধীনে কোনো রকম মনিটরিং করা হয় না বলে গৃহকর্মীদের প্রতি ক্রমাগত নির্যাতন বাড়ছেই।

আইএলও বহু বছর ধরে গৃহশ্রমিকের স্ট্যাটাস কেয়ারগিভার বা হাউসকিপার হিসেবে গণ্য করার কথা বলে আসছে। ২০১১ সালে এসে হাইকোর্ট জনস্বার্থের কথা বিবেচনা করে ১০টি পয়েন্ট উল্লেখ করে একটি নির্দেশনা দেন, যেখানে শিশুশ্রমিক রাখা নিষিদ্ধ করা হয়।

বাংলাদেশে অধিকাংশ গৃহকর্মী দাসত্বের শৃঙ্খলে বাধা পড়ে আছেন। তাঁদের অনেকে মারা যান, নির্যাতনের হাত থেকে পালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন, পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েন, যৌনদাসী হয়ে যান। তাঁদের জন্য নিরাপত্তামূলক কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই অভিযোগ জানানোর জায়গা, নেই বিশেষভাবে বিচার পাওয়ারÿক্ষমতা। তাই গৃহশ্রমিক নিয়ে কর্মরত সংগঠনগুলো মনে করে গৃহশ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার না দিলে এর সমাধান হবে না। একই সঙ্গে সংগঠনকে মামলার বাদী হতে আইন করতে হবে।

১০ বছরের শিশু পাখিকে এত নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে যে কোনো সুস্থ মানুষ তা কল্পনাও করতে পারবে না। অথচ এরপরও কি পাখিকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ৬৯ বছর বয়স্ক গৃহকর্ত্রী অন্য সবার মতো আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে যাবে যেকোনো মুহূর্তে?

শাহানা হুদা: যোগাযোগকর্মী