জানালাগুলো খুলতেই হবে, অন্তত চোখের আর মনের

এই অনুভূতি ঝকঝকে রোদেলা শীতের এক সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেও আসতে পারেছবি : প্রথম আলো

আশপাশের সব গাছই প্রায় পাতাহীন। বেশ কয়েক মাস হলো। অক্টোবর থেকেই পাতা ঝরতে শুরু করে বিলাতে। তীব্র ঠান্ডা। সঙ্গে হিমেল হাওয়া। বৃষ্টি লেগেই আছে। রুক্ষ প্রকৃতি। দিনের আলো বেশিক্ষণ থাকে না। ক্রিসমাসের ছুটিও শেষ। সবদিক দিয়েই এ সময় বেশ মন খারাপ করা। লন্ডনে আমাদের বাড়ির পাশের ছোট্ট পার্ক। হাঁটতে হাঁটতে বিস্ময়ে হঠাৎ থমকে গেলাম। পাতাহীন কালো গাছ, ঝাঁকড়া ডালপালা। গোলাপি ছোট ছোট চেরি ফুলে ছেয়ে গেছে। পাপড়িগুলো নিচের দিকে হালকা সাদা, ওপরের দিকটা গাঢ় গোলাপি। রেণুগুলো গাঢ় হলুদ। মনে হয় পৃথিবীর কোনো নামকরা চিত্রকর প্রতিটি পাপড়ি নিখুঁতভাবে রাঙিয়েছেন। বিস্ময়কর সুন্দর। চেরি সাধারণত এপ্রিল মাসে দেখা দেয়। তবে শীতকালে ফোটে—এ রকম কিছু চেরিও আছে। আপাতসাধারণ চেরি ফুলের মোহনীয় সৌন্দর্য দেখে কিছু মুহূর্তের বিস্ময়। ঘোর বলতে পারেন।

একই রকমের বিস্ময় লেগেছিল গত ছুটিতে। বাংলাদেশে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় কাকডাকা ভোরে হঠাৎ কদম ফুলের দেখা পেয়ে। এমন নয় যে প্রথম আমি কদম ফুল দেখেছিলাম। ইট-পাথরের শহরে বিলুপ্তপ্রায় দেশি ফুলের দেখা, তা-ও আবার মাত্র কয়েক বছর আগের লাগানো, ছোট গাছ থেকে। আসলে বিস্মিত হয়েছিলাম এই ভেবে, এখনো এই শহরে দেশি ফুলের গাছ রাস্তার ধারে লাগানো হয়। পরে জেনেছিলাম, দুই ব্যক্তি নিজের উদ্যোগে শহরজুড়ে রাস্তার দুই পাশে দেশি ফুলের গাছ—কৃষ্ণচূড়া, পলাশ আর কদম লাগাচ্ছেন।

হঠাৎ কিছু দেখে এই যে অবাক বিস্ময়, বলতে পারেন গা শিউরে দেওয়া বিস্ময়, সাম্প্রতিক বিজ্ঞান গবেষণার এক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। একের পর এক গবেষণা বলছে, এ ধরনের গা শিউরে দেওয়া বিস্ময় আমাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজনীয়। এই বিস্ময় দারুণ ভালো লাগা থেকে হতে পারে অথবা কিছুটা ভয় থেকে। ঠিক পড়ছেন। ভয় থেকেও হতে পারে। আমাদের ছোটবেলায় প্রতিবছর নিয়ম করে শহরে সার্কাস আসত। কোনো বছর বৈশাখে, কোনো বছর শীতে। বড় গোলাকার লোহার খাঁচার ভেতরে মোটরসাইকেল নিয়ে মাধ্যাকর্ষণকে পরাজিত করে, মাঝবয়সী লোকটি যখন প্রচণ্ড গতিতে ওপর-নিচ করত, ভয়ে, শ্রদ্ধা আর বিস্ময়ে আমার গা হিম হয়ে যেত। একজন মানুষ এ রকম কিছু করতে পারে—এটা ভেবেই ভালো লাগত।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের বিস্ময়ের অনুভূতি নিতে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যেতে হবে। রাতে আকাশের তারা দেখলে বা সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে মহাবিশ্বের বিশালতার কাছে আমাদের বেশ ছোটই মনে হয়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ছোট্ট একটা মাকড়সার জালও যদি আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলেও আশ্চর্য হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। নিজের কিছু শখ রাখতে হবে। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সুর সম্পর্কে ভালো জ্ঞান ছিল। দারুণ পিয়ানো বাজাতেন। পাশ্চাত্য সংগীতের ভক্ত ছিলেন।

গবেষকেরা বলছেন, এই বিস্ময়কর অনুভূতি আমাদের দৈনন্দিন জীবন, হাতের কাছের পারিপার্শ্বিক, অসাধারণ কিছু দেখার বা শোনার অভিজ্ঞতা থেকেই হতে পারে। এই অনুভূতির অভিজ্ঞতা আমাদের সবারই আছে, কিন্তু সহজে একে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। এই অনুভূতি ঝকঝকে রোদেলা শীতের এক সকালে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখেও আসতে পারে অথবা হতে পারে আপনার সন্তানের প্রথম হাঁটতে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে।

আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এই অভিজ্ঞতার ফলে আমাদের শরীরে অক্সিটোসিন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়। অক্সিটোসিনকে বলা হয় ভালোবাসার হরমোন। অক্সিটোসিনের প্রভাবে অন্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার বা বোঝার ক্ষমতা বেড়ে যায়। এই অনুভূতি আমাদের মেরুদণ্ডের ভেগাস স্নায়ুতন্ত্রকে উজ্জীবিত করে হৃৎপিণ্ডের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ভেগাস স্নায়ুতন্ত্র শরীরের অন্য বেশ কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সচলতাকেও প্রভাবিত করে।

আমেরিকার শিকাগোর নর্থ-ওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা বলছেন, হঠাৎ বিস্মিত হওয়ার এই অভিজ্ঞতা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চাপ মোকাবিলার ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়। বাড়িয়ে দেয় আমাদের ধৈর্য। দূর করে আমাদের মানসিক হীনম্মন্যতা। কমে যায় নেতিবাচক চিন্তা আর অবসাদ, এমনকি ক্যানসার, উচ্চ রক্তচাপ আর ডায়াবেটিসের মতো রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রদাহের মাত্রা।

বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, অবাক হওয়ার এই অভিজ্ঞতার জন্য আমাদের সব সময় বিখ্যাত কোনো স্থাপনা বা প্রাকৃতিক আশ্চর্যের সামনে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এর সঙ্গে অর্থ, প্রতিপত্তি বা ক্ষমতার কোনো সম্পর্ক নেই। আশপাশেই অনেক কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে, যা থেকে এ ধরনের অভিজ্ঞতা হতে পারে।

আমাদের শহরে বই বাঁধাই করতেন নাথ দাদু। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে নতুন ক্লাসের বই কিনে তাঁর কাছে রেখে আসতাম। কয়েক দিন পরে বাঁধানো বইগুলো হাতে পেয়ে গায়ে কাঁটা দিত। অবাক হতাম সামান্য এক সিমেন্টের বস্তার ফেলে দেওয়া কাগজ দিয়ে কীভাবে অতি উঁচু মানের শিল্পকর্ম তিনি তৈরি করতেন। অথচ প্রথমবার প্যারিসের লুভ মিউজিয়ামে মোনালিসার পেইন্টিং দেখে বিস্ময়ের ঘোর লাগেনি; হয়তো আগে বহুবার শিল্পকর্মটির ছবি দেখেছি বলে।

বিজ্ঞানীরা ক্যালিফোর্নিয়ার একটি জেলে বন্দীদের ওপর গবেষণা করে দেখেছেন, বদ্ধ ছোট্ট ঘরে একফালি জানালা দিয়ে সকালবেলার আলো দেখে বা সকালে পাখিদের ডাক শুনেও বন্দীদের আশ্চর্য ভালো লাগার অনুভূতি হয়।

আশার কথা হলো, এ অভ্যাস তৈরি করা যায়। কীভাবে? বিজ্ঞানীরা বেশ কয়েকটি উপায়ের কথা বলেছেন। অপরের ভালো কিছু দেখার অভ্যাস করতে হবে।

আমেরিকার রাইট স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা দেখতে পেয়েছেন, অন্যের কোনো ভালো কাজ দেখেও আমাদের নিজেদের মধ্যে একধরনের আশ্চর্য রকমের ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হয়। যেমন ধরুন, আপনি দেখলেন, কোনো একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে অপরিচিত কেউ রাস্তা পার হতে সাহায্য করছে। গবেষকেরা বলছেন, আপনি প্রতিদিন যে দোকানে কেনাকাটা করতে যান, ওই দোকানের যে কর্মী যত্ন করে আপনাকে সাহায্য করছে, তার কাজটি মন দিয়ে দেখলেও আপনার ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হবে।

ইতালির ফ্লোরেন্সের শান্তা মারিয়া ক্যাথিড্রাল। ৬০০ বছরের। অসামান্য স্থাপনা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দেখা যায়। সামনের রাস্তায় দুপাশে শিল্পীরা ছবি আঁকছেন। বিক্রি করছেন। এ রকমই একজন শিল্পী সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম, রাস্তার পাশে এই আঁকিয়েদের অনেকেই বেশ বিখ্যাত। নামমাত্র মূল্যে তাঁদের আঁকা ছবি ভিনদেশি পর্যটকদের কাছে বিক্রি করার পরে তাঁরা নিজের খ্যাতির কথা বলেন। টাকাপয়সা নয়, ক্রেতার বিস্ময় দেখার জন্যই তাঁরা স্টুডিও থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় ছবি আঁকেন। অন্যকে আনন্দ দেওয়ার এ নিঃস্বার্থ আয়োজন দেখে দারুণ লেগেছিল।

আরও পড়ুন

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ ধরনের বিস্ময়ের অনুভূতি নিতে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যেতে হবে। রাতে আকাশের তারা দেখলে বা সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে মহাবিশ্বের বিশালতার কাছে আমাদের বেশ ছোটই মনে হয়। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ছোট্ট একটা মাকড়সার জালও যদি আমরা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তাহলেও আশ্চর্য হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

নিজের কিছু শখ রাখতে হবে। বিখ্যাত চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের সুর সম্পর্কে ভালো জ্ঞান ছিল। দারুণ পিয়ানো বাজাতেন। পাশ্চাত্য সংগীতের ভক্ত ছিলেন।

কলকাতার নিউমার্কেটের পাশে ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে বেশ কয়েকটি পুরোনো রেকর্ডের দোকান ছিল। প্রায়ই সত্যজিৎ রায়কে সেই পুরোনো রেকর্ডের দোকানগুলোয় হাঁটু গেড়ে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা রেকর্ড ঘাঁটতে দেখা যেত। এক সাক্ষাৎকারে এর কারণ জানতে চাইলে সত্যজিৎ বলেছিলেন, হঠাৎ দুর্লভ কোনো রেকর্ডের সন্ধান পাওয়ার যে আনন্দ, তা দোকানে গিয়ে নতুন রেকর্ড কিনলে পাওয়া যায় না।

এই গবেষণার ফলগুলো এমন সময়ে আসতে শুরু করেছে, যখন আমরা সবাই কিনা নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত। সবাই বলছে, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও। মুঠোফোন বন্দী। পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখার সময় কোথায়? বেরিয়ে পড়ুন। না পারলে ঘরে বসেই চোখটা অন্তত খুলুন।

  • ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট
    [email protected]