আজকাল প্র্যাঙ্ক বলে একটা ব্যাপার খুব চলে। একে প্র্যাকটিক্যাল জোকও বলা হয়। সোজা বাংলায় একে তামাশা করা বলা যায়। ফেসবুকের যুগে এই প্র্যাঙ্ক চিনতে কারও বাকি নেই। প্র্যাঙ্কের সঙ্গে সঙ্গে শুধু মুখের কথায় ঠাট্টাতামাশার তফাত আছে—এখানে কোনো একটা জিনিস থাকে। সেটা ঘিরে কাউকে বোকা বানানো, অস্বস্তিতে ফেলা—এসব করে মজা পাওয়া হচ্ছে প্র্যাঙ্কের উদ্দেশ্য।
প্র্যাঙ্কের সীমানা খুব ছোট নয়। ২০১৭ সালে একজন ই–মেইল প্র্যাঙ্কস্টার মার্কিন হোমল্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার টম বোসেরকে বোকা বানালেন। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জামাতা জেরাড কুশনারের নাম নিয়ে একজন বোসেরকে মেইল করে বিকেলে খাবারের আমন্ত্রণ দিয়ে রাজি করিয়ে ফেলেন। ব্যাপারটা হালকা নয়। কুশনার তখন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিশেষ পরামর্শদাতা। বোসের এমনকি সেই মেইলের উত্তরে আমন্ত্রণে রাজি হয়ে নিজের ব্যক্তিগত ই–মেইল অ্যাড্রেসও দিয়ে দেন। প্র্যাঙ্ককারী আমেরিকার ইরাক আগ্রাসন নিয়ে সূক্ষ্ম তামাশা করেছিলেন ই–মেইলে—‘কথা দিচ্ছি, ইরাকে আমরা যে খাবার খেয়েছিলাম, তার চেয়ে খারাপ হবে না আমাদের আয়োজন।’
রাজনীতি আবর্তিত হয় যা দেখা যায় এবং যা বলা যায় তাকে ঘিরে। এই যে গণ–অভ্যুত্থানের সময় বিপুলসংখ্যক নারী সংগ্রামে হাজির ছিলেন, তাঁরা কেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন? কেন বেতনের দাবির মিছিলে শ্রমিকের মৃত্যু আমাদের চোখের সামনে ঘটেও অদৃশ্য থেকে যায়? যা দেখা যায়, তা আসলে দেখাতে চাওয়া হয় বলেই দেখা যায়। এর মধ্যে আটকে থাকলে সত্যিকারের কোনো বদল আসবে না।
২০১৬ সালে সান ফ্রান্সিসকো মিউজিয়াম অন মডার্ন আর্টসে ১৬ আর ১৭ বছর বয়সী দুই কিশোর প্র্যাঙ্ক করে হইচই ফেলে দিল। একটা বড় প্রদর্শনী চলছিল সেখানে। সেই দুই কিশোর মিউজিয়ামের ভেতরে দেয়ালের ফাঁকা একটি জায়গায় একটা চশমা মেঝেতে রেখে দিল। একটু পরই দেখা গেল সেই চশমা ঘিরে ভিড় জমে গেছে। এই চশমা কোন শিল্পীর ইনস্টলেশন আর্ট, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হলো। এই শিল্পের অর্থ কী, তা নিয়ে তর্ক জমে উঠল। অনেকেই খুব প্রশংসা করতে লাগলেন। এসবের ছবি তুলে এক কিশোর টুইট করল। এর রিটুইট হলো পঞ্চাশ হাজারের বেশি।
যাঁরা ধোঁকা খেলেন, তাঁদের মধ্যে বড় চিত্রসমালোচক, শিল্পী, অধ্যাপক, বোদ্ধাও ছিলেন। এ রকম কীভাবে হতে পারল। এটা নিয়ে ভাবনার ব্যাপার আছে। তাহলে আমরা কী দেখব, দেখে কী বুঝব তা আমরা নিজেরা ঠিক করি না। সমাজ ঠিক করে দেয় কোন জিনিস দেখব, কোন জিনিস দেখেও দেখব না।
কোনো আর্ট গ্যালারিতে দেয়ালে একটা ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঝুলিয়ে বলে দেওয়া হয় যে এটা একটা শিল্পকর্ম। এটা তোমার উপভোগ করতে হবে। ওই একই জিনিস ফুটপাতে পড়ে থাকলে তা আর শিল্প বলে আমি–আপনি গুরুত্ব দেব না। এ কারণেই মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টসের মেঝেতে রেখে দেওয়া চশমা যে কেউ ঠাট্টা করে রেখে যেতে পারে, তা কেউ ভাবতে পারে না। সেই চশমার শিল্প নিয়ে তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যায়।
এ ব্যাপারটা শুধু জিনিসপত্রের ব্যাপারেই যে সত্য এমন নয়। কখন, কীভাবে, কী নিয়ে আমরা কী বলব, তা–ও সাধারণত আমরা ঠিক করি না। কোনো এক পক্ষ ঠিক করে দেয়, নিয়ম করে দেয়।
এই ভাবনা জ্যাক রাঁসিয়ের নামের এক ফরাসি দার্শনিকের। তিনি মনে করেন, সমাজে ক্ষমতা, রাজনীতি ও শিল্পের পারস্পরিক সম্পর্ক আছে। অনুভবযোগ্য যা কিছু, তা কোথায় আছে তা গুরুত্বপূর্ণ। এর ওপরই নির্ভর করে কারা দেখবে, শুনবে, বলবে এবং কারা নীরব থাকবে। ক্ষমতার কাঠামোতে যার জোর যত বেশি, সে–ই ঠিক করে দেয় কে দৃশ্যমান থাকবে। কার ওপর সামান্য আঁচড় পড়লে তোলপাড় হয়ে যাবে; আবার কেউ কাতারে কাতারে মরে গেলেও শুধু সংখ্যা হয়ে যাবে, অদৃশ্য হয়েই থাকবে।
সমাজে কোনো একটা ব্যবস্থা থাকে। সেই ব্যবস্থা ঠিক করে দেয় কাকে দেখব, কাকে দেখেও দেখব না। ঠিক করে দেয়, কে ঠিক আর কে ভুল। বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে মানুষের কত গোষ্ঠী দৃশ্যমান হয়েছে। আবার কত মানুষ অদৃশ্য থেকে গেছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা গোষ্ঠীগুলো নিজেদের হাজির করেছে। এই দৃশ্যমান থাকার খাতিরে তাদের চেষ্টার কোনো অন্ত থাকে না।
রাজনীতির মধ্যে এই দেখা আর না-দেখার লড়াই চলে। কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আর গণ–অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্য বিলোপের আন্দোলন—যা অদৃশ্য করে রাখা হয়েছিল, তাকে দৃশ্যমান করার চেষ্টা। এই আন্দোলনগুলো বিদ্যমান ক্ষমতার কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং নতুনভাবে দৃশ্য আর অদৃশ্যের বণ্টন ঘটানোর দাবি করেছে।
রাজনীতি আবর্তিত হয় যা দেখা যায় এবং যা বলা যায় তাকে ঘিরে। এই যে গণ–অভ্যুত্থানের সময় বিপুলসংখ্যক নারী সংগ্রামে হাজির ছিলেন, তাঁরা কেন অদৃশ্য হয়ে গেলেন? কেন বেতনের দাবির মিছিলে শ্রমিকের মৃত্যু আমাদের চোখের সামনে ঘটেও অদৃশ্য থেকে যায়? যা দেখা যায়, তা আসলে দেখাতে চাওয়া হয় বলেই দেখা যায়। এর মধ্যে আটকে থাকলে সত্যিকারের কোনো বদল আসবে না।
● জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী