প্রবীণদের জন্য আমাদের কি কিছুই করার নেই?

বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য শুধু সরকারি সাহায্যই সীমিত নয়, বেসরকারিভাবেও প্রবীণদের নিয়ে খুব বেশি কাজ হয় না।
ফাইল ছবি

এককালে আমার নানুর পাঁচ মেয়ে তিন ছেলের বিশাল সংসার ছিল। বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে তাঁরও সামান্য অবদান আছে বললে ভুল হবে না, অথচ নানার মৃত্যুর পর তাঁকে ১৭ কোটি জনসংখ্যার ছোট্ট ভূখণ্ডে ভয়াবহ নিঃসঙ্গ জীবন কাটাতে হচ্ছে।

বর্তমানে উচ্চশিক্ষার জন্য তরুণ প্রজন্মের বিদেশে পারি জমানোর এবং সেখানেই স্থায়ী হওয়ার ঝোঁক দিন দিন বেড়েই চলেছে। অপর দিকে যাঁরা বাংলাদেশে থাকছেন, তাঁরাও আর বাপ-দাদার উত্তরাধিকারে পাওয়া কৃষিকাজকে পেশা হিসেবে বরণ করে না নিয়ে অন্যান্য চাকরিমুখী হচ্ছেন। নিজ নিজ কাজের জন্য কর্মস্থলের কাছে ছোট বাসা নিয়ে থাকায় যৌথ পরিবার একরকম বিলুপ্তির পথে। ওদিকে গ্রামে বৃদ্ধ মা-বাবাকে শেষ বয়সে এসে একাকী জীবন যাপন করতে হচ্ছে।

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের দেশে পারিবারিক বন্ধন অত্যন্ত সুদৃঢ়। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এসব বন্ধন ধীরে ধীরে ঢিলে হয়ে যাচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে ছোট হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে প্রবীণেরা আরও বেশি একাকিত্বের যন্ত্রণা ও অবহেলার শিকার হচ্ছেন।

এশিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশ জাপানে প্রবীণদের আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। এ প্রবণতা যাতে আমাদের মধ্যে বিস্তৃত না হয়, সেদিকে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানীসহ সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। আমাদের চারপাশে প্রবীণদের নিয়ে কিছু কিছু ঘটনা মনটাকে বিক্ষিপ্ত এবং অনেক ভারী করে তোলে।

উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুবিধা ও সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম না থাকায় এ দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠী পারিবারিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শারীরিক সমস্যায় প্রতিনিয়ত ভুগছেন।

পরিবার ও সমাজে তাঁরা অবহেলিত। পুষ্টিকর খাদ্য, চিকিৎসার সুবিধা, নাগরিক সুবিধা, পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদাসহ বিভিন্ন ধরনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে প্রতিনিয়ত তাঁরা মানসিক যন্ত্রণার শিকার হচ্ছেন। আমাদের এ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই জীবনধারণের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

বর্তমান বাংলাদেশে প্রবীণের সংখ্যা ১ কোটি ৪০ লাখ বলা হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। আমরা তাঁদের প্রয়োজনই ঠিকমতো মেটাতে পারছি না। অন্যদিকে একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বাংলাদেশে ২০৩০ সালের আগেই প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দুই কোটি ছাড়িয়ে যাবে, যার একটি বিশাল প্রভাব পড়বে শ্রমবাজারের ওপর।

জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ কে এম নুর-উন-নবী বলছেন, ২০৪৭ সাল নাগাদ বাংলাদেশে অপ্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় প্রবীণদের সংখ্যা বেশি থাকবে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে এখন ৬৮ শতাংশের বেশি মানুষ কর্মক্ষম। কিন্তু তিন দশক পর প্রবীণদের সংখ্যা আরও বেড়ে গেলে দেশের সার্বিক উৎপাদনেও একটি বড় ঘাটতি দেখা দেবে।

আমাদের কি প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য কিছুই করার নেই?

প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের কিছু কার্যক্রম রয়েছে। সবচেয়ে বড় কার্যক্রমটি হচ্ছে বয়স্ক ভাতা, যার আওতায় সাড়ে ৩১ লাখ প্রবীণকে মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে।

এ ছাড়া ২০১৩ সালে ষাটোর্ধ্বদের সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে চিকিৎসাসহ নানা ক্ষেত্রে প্রবীণদের অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পাওয়ার কথা। যদিও এখনো এটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।

২০১৩ সালেই সন্তানের জন্য মা-বাবার দেখভাল বাধ্যতামূলক করে মা-বাবার ভরণপোষণ আইনও পাস হয়েছে। কিন্তু সেটির প্রয়োগও খুব কম এবং এ নিয়ে সচেতনতারও অভাব রয়েছে।

বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য শুধু সরকারি সাহায্যই সীমিত নয়, বেসরকারিভাবেও প্রবীণদের নিয়ে খুব বেশি কাজ হয় না। অন্তত যতটা হওয়া উচিত ততটা যে হচ্ছে না, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রায় সবাই একমত।

বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পেনশন সুবিধা না থাকায় বৃদ্ধ বয়সে গিয়ে তাঁরা চরম অর্থকষ্টে পড়েন। সারা জীবনের অর্জিত অর্থ ব্যয় করে হয়তো সন্তানদের পড়াশোনা করিয়েছেন। তাঁরাও পড়াশোনায় সফলতার স্বাক্ষর রেখে বাবা-মাকে একাকী ফেলে রেখে ইউরোপীয় কোনো দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে...।

বাংলাদেশে বর্তমানে প্রবীণদের জন্য সরকারিভাবে বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে মাত্র একটি। এর বাইরে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা কিছু বৃদ্ধাশ্রম মিলিয়ে খুব অল্প কিছু প্রবীণের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।

বাংলাদেশে বৃদ্ধ বয়সে সেবা দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাদানকারীও নেই। যেটা ভবিষ্যতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে।

এশিয়ার সবচেয়ে ধনী দেশ জাপানে প্রবীণদের আত্মহত্যার হার সবচেয়ে বেশি। এ প্রবণতা যাতে আমাদের মধ্যে বিস্তৃত না হয়, সেদিকে সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানীসহ সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। আমাদের চারপাশে প্রবীণদের নিয়ে কিছু কিছু ঘটনা মনটাকে বিক্ষিপ্ত এবং অনেক ভারী করে তোলে।

প্রবীণদের প্রতি আমাদের আরও সদয় এবং যত্নশীল হওয়া প্রয়োজন এবং ভবিষ্যতে বিপুল প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যকর পরিবেশ প্রদানের লক্ষ্যে এখন থেকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, তাদের একাকিত্ব লাঘবের চেষ্টা হিসেবে নানা ধরনের বিনোদনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

ভুলে গেলে চলবে না আজকের নবীন আমরাই কালকের প্রবীণ...

আফসানা সাথী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়