‘আমি যার কথা ভাবি, তার কাছে আমি কেউ নই। এটা আসলে একপক্ষীয় ভালোবাসার মতো।’ কথাগুলো সিনেমার সংলাপের মতো শোনায়। কিন্তু এর পরের অংশটুকু বলে দেয় সিনেমার রঙিন পর্দা নয়, কোনো কঠিন বাস্তবের বিবর্ণ প্রেক্ষাপটে কথাগুলো বলা হচ্ছে—‘কিন্তু কী করব, মিয়ানমার আমি চোখে দেখিনি, আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বাংলাদেশে। আপনাদের মতো আমিও বাংলাদেশকে “আমার দেশ” বলে ফেলি; কিন্তু এটাও জানি যে আমি এ দেশের নাগরিক না। তবু আমি বাংলাদেশের সঙ্গে মানসিক ও আবেগীয় বন্ধনে বাঁধা।’
কক্সবাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শফিক (ছদ্মনাম) একজন রোহিঙ্গা। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত চলে এসেছে। সে কাগুজে বাংলাদেশি। কিন্তু বুকের ভেতর রোহিঙ্গা পরিচয় সদা জাগ্রত। কাগজগুলো তাকে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত যেতে সহায়তা করলেও বাংলাদেশ তাকে নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। কিন্তু মিয়ানমারকে ‘নিজের দেশ’ ভাবার সুযোগ বা যুক্তি কোনোটাই নেই। বরং পরিচয় গোপন করে যদি লেখাপড়া শিখে আরেকটা পরিচয় সৃষ্টি করা যায়, তাহলে অন্তত পরিচয় সংকট ঘোচানো যেতে পারে। এ ভাবনা থেকে শফিকের লক্ষ্য, উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার জন্য ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার কোনো স্থানে চলে যাওয়া।
এসব কাহিনি নিয়ে হয়তো সিনেমা বা টেলিফিল্ম বানানো যেতে পারে, তাতে শরিফদের পরিচয় সংকট মোচনের কোনো সম্ভাবনা যে নেই, তা বেশ বলা যায়। পরিচয় সংকটের শিকার হয়েছিলেন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্যের অধ্যাপক এবং পোস্টকলোনিয়াল স্টাডি নামের অধ্যয়নের নতুন একটি ক্ষেত্রের স্থপতি এডওয়ার্ড সাইদ। ফিলিস্তিনি মা আর জেরুজালেমের বাবার সন্তান সাইদের জন্ম জেরুজালেমে। বাবার কাজের সূত্রে তাঁর বেড়ে ওঠা কায়রোতে। গ্রীষ্মকালে পরিবারের সঙ্গে সাইদ লেবাননেও বাস করতেন। কিন্তু একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে কায়রো ও লেবানন—দুই জায়গাতেই নিজের কাছে নিজেকে মনে হতো ‘আউট অব প্লেস’।
বাংলাদেশে বর্তমান সময়ের তীব্র বিদ্যুতের সংকটের কারণে উখিয়ায় যখন কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না, সেই উখিয়াতে জেনারেটর দিয়ে দিব্যি চলছে নর্থএ্যান্ডের কফি শপ। ক্যাম্পে যাওয়া-আাসার পথে এ রকম একটি স্থানে এ রকম একটি কফি শপ দাতা সংস্থার কর্তা-কর্মীদের চাঙা রাখার জন্য আবশ্যক বটে। সেই সঙ্গে উখিয়া-কক্সবাজার নিত্য সফরের ক্লান্তি ঘোচাতে বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে খাবারের আয়োজন, বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকতে সন্ধ্যাকালীন ভ্রমণ ইত্যাদি তাদের দিয়েছে রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা।
পরিচয়ের বহুবিধ মাত্রায় নিজের কাছে নিজের প্রকৃত পরিচয় অনির্ধারিত থেকে গেলেও সাইদকে শফিকদের মতো প্রকৃত পরিচয় প্রকাশে বিপদের আশঙ্কায় থাকতে হয়নি। আমেরিকান পাসপোর্টধারী সাইদকে আমেরিকান বা আরব পরিচয় গোপন করতে হয়নি। কিন্তু শফিকরা বাংলাদেশি পাসপোর্ট ম্যানেজ করতে পারলেও বাংলাদেশি বা রোহিঙ্গা দু-দুটি পরিচয় নিয়েই সংকটে থাকেন।
শফিকের পূর্বপুরুষেরা বাংলাদেশে এসেছিল কয়েক দশক আগে। এক সময় তারা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে স্বীকৃতিপ্রাপ্তও হয়। কিন্তু যে রোহিঙ্গারা পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল এবং যাদের ভাগ্যে জুটেছে ‘এফডিএমএন’ (ফোর্স ফুলি ডিসপ্লেসড মিয়ানমার ন্যাশনালস) তকমা, তারা না পারছে মিয়ানমারে ফিরে যেতে, না পারছে একটা বাংলাদেশি পাসপোর্ট ম্যানেজ করতে, না পারছে তাদের অনেক আগে এ দেশে আসা তাদেরই জনগোষ্ঠীর মতো ‘শরণার্থী’ হিসেবে স্বীকৃতি নিয়ে বাংলাদেশে বাস করতে।
গত বছর সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ নিহত হওয়ার পর অনেকেই ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন যে বাংলাদেশে শিগগিরই আরসা এবং অন্যান্য সন্ত্রাসী দল আক্রমণ করবে, এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি হবে। রোহিঙ্গা বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের প্রতিবেদন প্রকাশের পর এবং আইসিজে থেকে মিয়ানমার সম্পর্কে সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর কেউ কেউ উল্লসিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে এবার বুঝি বাংলাদেশে বাস করা রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার দুয়ার খুলবে।
দিন গত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ সত্য পরিষ্কার হয়েছে যে গণহত্যার শিকার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা ভূরাজনীতির নিয়ন্ত্রক নয়, বরং ঘুঁটি। সে কারণে তাদের অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসী দলগুলোর শক্তি নিজেদের মধ্যে সন্ত্রাসজনক কাজ বা খুন করার মধ্যে সীমিত। অপর দিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও সংস্থাগুলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নয়, মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বড়জোর গণহত্যা সংঘটনের বিষয় নিয়ে কথা বলে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আসলে কারও কিছু বলার বা করে দেখানোর হিম্মত নেই বলেই রোহিঙ্গাদের ধৈর্য ধরার পরামর্শ দেওয়া হয়।
তাহলে সহজ সমীকরণে শফিকদের মতো নিবন্ধিত শরণার্থীদের জন্য বাংলাদেশি পাসপোর্ট ম্যানেজ করা ছাড়া এবং এফডিএমএনদের জন্য অনিশ্চয়তায় প্রহর গোনার পাশাপাশি ‘অবৈধ’, ‘সন্ত্রাসী’ ইত্যাদি কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা থাকে কি? তবে রোহিঙ্গাদের জন্য সব পথ বন্ধ হলেও বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি অবস্থানে কেউ কেউ যে বিশেষভাবে লাভবান হচ্ছে, তা দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট। এর মধ্যে বৈদেশিক অর্থ দ্বারা পুষ্ট ও বৈদেশিক নীতি দ্বারা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থাগুলোর কথা বলা যায়। কক্সবাজার পাঁচ বছর আগেও ছিল বাংলাদেশের পর্যটনের রাজধানী। এখন একে এনজিও বা ইউএন সংস্থার নগরী বললে ভুল হবে না।
বাংলাদেশে বর্তমান সময়ের তীব্র বিদ্যুতের সংকটের কারণে উখিয়ায় যখন কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে না, সেই উখিয়াতে জেনারেটর দিয়ে দিব্যি চলছে নর্থএ্যান্ডের কফি শপ। ক্যাম্পে যাওয়া-আাসার পথে এ রকম একটি স্থানে এ রকম একটি কফি শপ দাতা সংস্থার কর্তা-কর্মীদের চাঙা রাখার জন্য আবশ্যক বটে। সেই সঙ্গে উখিয়া-কক্সবাজার নিত্য সফরের ক্লান্তি ঘোচাতে বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে খাবারের আয়োজন, বিশ্বের দীর্ঘতম সৈকতে সন্ধ্যাকালীন ভ্রমণ ইত্যাদি তাদের দিয়েছে রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় নতুন মাত্রা।
ড. ইশরাত জাকিয়া সুলতানা সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।