পরাজয় মেনে নিয়ে ইউক্রেনের নেতাদের উচিত শান্তির সাদা পতাকা উড়িয়ে আলোচনার টেবিলে বসা—পোপ ফ্রান্সিসের এই বক্তব্যে কিয়েভ ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোয় যৌক্তিকভাবেই ক্ষোভের সঞ্চার হতে দেখছি। ইউক্রেন পরাজিত হয়েছে, তাঁর এই ধারণাই ভ্রান্ত। তা ছাড়া তিনি মস্কোর অবৈধ আগ্রাসন এবং যুদ্ধাপরাধের কোনো সমালোচনা না করে বরং উপেক্ষাই করেছেন। তারপরও কথা থাকে। আসলে এই সংঘাতের সমাপ্তি কীভাবে ঘটবে, তা নিয়ে শুধু পোপ ফ্রান্সিস নন, দ্বিধাগ্রস্ত আরও অনেকেই।
দুই বছর হয়ে গেল, তবে এখনো এই যুদ্ধে বিজয়ী কে, তার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। এই অচলাবস্থা একদিক থেকে ভালো। কোনো একটি পক্ষ জয়লাভ করলে আর সবার জন্য বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। গত সপ্তাহে এমানুয়েল মাখোঁ ইউক্রেনে ন্যাটো বাহিনী পাঠানো উচিত, এমন মন্তব্য করার পরপরই ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগের হুমকি দেন।
পুতিন যা বলছেন, তার কিছুটা বাগাড়ম্বর, তবে তিনি লক্ষ্যে পৌঁছাতে যা খুশি তাই করতে পারেন, এমন আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাঁর বিশ্বাস, সময় এখন তাঁর পক্ষে আছে। তিনি যুদ্ধ জিইয়ে রাখছেন, একই সঙ্গে নির্বাচনের আড়ালে আবারও ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা করছেন।
রাশিয়ার হার, নানা কারণে বিপজ্জনক। পুতিন ইউক্রেনের এই যুদ্ধকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলে উপস্থাপন করেছেন এবং ভোটাভুটিতে দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ রুশ তাঁর এই কথা বিশ্বাস করেন। তাঁর জন্য, পরাজয় অগ্রহণযোগ্য। কারণ, এর অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে রাশিয়ার পরাজয় এবং পুতিনের সরে যাওয়া। যদি তিনি একঘরে হয়ে পড়েন, তাহলে এই লোকটা পশ্চিমাদের দায়ী করবেন এবং অন্যদেরও টেনে নামাবেন।
ইউক্রেনের হারও নানা কারণে বিপজ্জনক। মানবিক বিপর্যয় ঘটবে সাংঘাতিকভাবে। বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ মানুষ পশ্চিমের দিকে ছুটবেন। বুচা ও মারিউপোলের কথা যদি স্মরণে থাকে, তাহলে নির্যাতন, যুদ্ধাপরাধ ও অপহরণের হার কোথায় পৌঁছাবে, তা অনুমান করা যায়।
যুদ্ধবিরতির এই প্রস্তাব লোভনীয়। অন্তত একটা সাময়িক বিরতিও হতে পারে। মাখোঁ পোপকে ধমকে যেমনটি বললেন, ইউক্রেনের শান্তির অর্থ আত্মসমর্পণ নয়। এই যুদ্ধকে স্থায়ীভাবে শেষ করতে হলে আইনগত উপায়ে ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। এই স্বৈরাচারের পতন ছাড়া শান্তির প্রত্যাশা দূর অস্ত।
বিজয়ী পুতিন পুরো দেশ দখল করে নিতে পারেন বা বসতি স্থাপন করে একটা পুতুল সরকারকেও বসিয়ে যেতে পারেন। যা-ই হোক না কেন, ইউক্রেনের স্বাধীন-সার্বভৌম সত্তা আর থাকবে না। দেশটির গণতন্ত্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে যুক্ত হওয়ার আশাও আর পূরণ হবে না।
ইউরোপের ওপর যে প্রভাব পড়বে, তা–ও হবে ভয়াবহ। রাশিয়ার এই বিজয় পোল্যান্ড এবং অপর তিন বাল্টিক রাষ্ট্রের জন্য ভীতিজাগানিয়া। তারা মনে করছে, রাশিয়া এখন সম্প্রসারণের দিকে যাবে। পশ্চিমা রাষ্ট্রপন্থী দেশ মলদোভা হয়তো রাশিয়ার নিশানায় চলে গেছে ইতিমধ্যে। ইউরোপের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন সমরাস্ত্র সংগ্রহে জোর দেবে, যার প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে।
ইউক্রেনের পরাজয়ের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে বিশ্বে। চাইলেই অপর একটি দেশকে জবরদখল এবং বেসামরিক জনগণকে নিশানা করা যায়, এমন একটা ভয়ংকর দৃষ্টান্ত তৈরি হবে।
এ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে চীনও কি তাইওয়ানকে আক্রমণে আগ্রহী হয়ে উঠবে? বা অন্য কোনো দেশ? খুবই সম্ভাবনা আছে। জাতিসংঘ সনদ, জেনেভা কনভেনশন ও মানবাধিকার আইনের মৌলিক নীতিগুলোও তখন আবর্জনার মতো ছুড়ে ফেলা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্ব এবং ন্যাটোও তীব্র ধাক্কা খাবে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন গত মাসে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘যদি পুতিন সফল হন, তাহলে তিনি অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠবেন। এর ফল হবে বিধ্বংসী।’ তিনি আরও বলেন, ‘যদি আমরা গণতন্ত্রকে সমর্থন দিতে না পারি, তাহলে বিশ্বের অন্য নেতারা, অন্য স্বৈরাচারীরা উৎসাহিত হবেন। আরও খোলাখুলিভাবে বললে, যদি ইউক্রেন হেরে যায়, আমার বিশ্বাস ন্যাটো রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে জড়াবে।’
যদি পশ্চিমা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো একজোট হয়ে রাশিয়ার হার নিশ্চিত করতে না পারে, তাহলে আপস ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না। পোপ ফ্রান্সিস যেভাবে বলেছেন, সেভাবে না হলেও। তুরস্কের শান্তি সম্মেলনের প্রস্তাব কিয়েভ আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। সমঝোতার দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক যাঁরা তাঁরাও কোনো দিশা পাচ্ছেন না। ইউক্রেনের ১০ দফা প্রস্তাবও ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে মস্কো।
তবে একটা মধ্যপন্থী সমাধানের সন্ধান দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ রিচার্ড হাস ও চার্লস কাপচান।
তাঁরা বলছেন, ইউক্রেনের উচিত হবে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতি নিয়ে সমঝোতায় বসা। কিয়েভ সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার চেষ্টা করছে এবং আগ্রাসী মনোভাবের কারণে রাশিয়ার জবাবদিহি চায়। এ নিয়ে তারা একচুলও ছাড় দিতে রাজি নয়। তবে কিয়েভের উচিত হবে এই মুহূর্তে তার অগ্রাধিকার ঠিক করা। আরও বেশি অঞ্চল স্বাধীন করার চেষ্টা ছেড়ে দিয়ে তাদের উচিত হবে নিয়ন্ত্রণে থাকা ৮০ শতাংশের বেশি ভূমি মেরামত করা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
পশ্চিমা সমর্থিত যুদ্ধবিরতি মৃত্যু ও ধ্বংস থামাবে। এতে করে কূটনৈতিক আলোচনার পথ খুলে যাবে এবং ইউক্রেনের যে উদ্দেশ্য, তা বাধাগ্রস্ত হবে না। তবে সমস্যাটা হলো, পুতিন মনে করেন তিনি বিজয়ী হতে চলেছেন। তাঁকে অবশ্যই যুদ্ধবিরতিতে সম্মতি দিতে হবে। এরপর যদি কোনো একটি পক্ষ অথবা দুই পক্ষই বিরতিকে সেনা পুনর্গঠন ও অস্ত্র সংগ্রহ এবং আবারও যুদ্ধে যাওয়ার বিরতি হিসেবে ধরে নেয়, তাহলে আলোচনা ভেস্তে যাবে।
যুদ্ধবিরতির এই প্রস্তাব লোভনীয়। অন্তত একটা সাময়িক বিরতিও হতে পারে। মাখোঁ পোপকে ধমকে যেমনটি বললেন, ইউক্রেনের শান্তির অর্থ আত্মসমর্পণ নয়। এই যুদ্ধকে স্থায়ীভাবে শেষ করতে হলে আইনগত উপায়ে ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। এই স্বৈরাচারের পতন ছাড়া শান্তির প্রত্যাশা দূর অস্ত।
● সাইমন টিসডল কলাম লেখক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত