আপনি কি শতকোটি টাকার ক্লাবে যোগ দিতে চান? বিলিওনিয়ারস ক্লাবের সম্মানিত সদস্য হতে চান? কাজটা সহজ। প্রথমে দরকার প্রতিজ্ঞা। হ্যাঁ, আমি যোগ দিতে চাই। আমারও থাকুক এক শ কোটি টাকা, দু শ কোটি টাকা, এক হাজার কোটি টাকা, দুই হাজার কোটি টাকা, দশ হাজার কোটি টাকা, বিশ হাজার কোটি টাকা। ইচ্ছা আপনার থাকতে হবে। ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। অসম্ভব কথাটা শুধু ব্যর্থ, আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল নিয়ে তর্কমুখর, অকর্মণ্য, নিন্দুক, বাতিল আদর্শবাদী, অক্ষম বাঙালির অভিধানে আছে, সোনার বাংলাদেশে অসম্ভব বলে কিছু নেই। ‘ইমপসিবল’ কথাটার মধ্যেই লেখা আছে ‘আই অ্যাম পসিবল’।
এই সব সম্ভবের দেশে আপনি ঘুঁটেকুড়ানির ঘরে জন্মাতে পারেন, আপনার বাবা হয়তো পুরোনো বাসনকোসন কিনে বিক্রি করতেন, ভাঙারির দোকানে বিক্রি করতেন। তাতে কী? আপনিই হতে পারেন এক হাজার কোটি টাকার গর্বিত মালিক! আপনাকেই খুঁজছে একুশ শতকের বাংলাদেশ। আপনি গরিবের ছেলে, এ জন্য আপনি দায়ী নন, কিন্তু আপনার শ্বশুর গরিব, এ জন্য আপনিই দায়ী; আর আপনার বয়স ২৫, কিন্তু এখনো আপনি শতকোটি টাকা করতে পারেননি, সে জন্য আর কেউই দায়ী নয়, দায়ী আপনার অনিচ্ছা, উদ্যোগহীনতা, নিজের গড়িমসি। উঠুন, জাগুন, গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ুন।
এবার প্রথম কাজ হবে, আপনি ভুয়া ঠিকানা দিয়ে একটা কোম্পানি খুলবেন। যেকোনো কোম্পানি, তা তিস্তার বালু চালুনি দিয়ে চেলে সোনা আনার হতে পারে, উপকূলে জেগে ওঠা চরে নিবিড় বনায়ন করে তাকে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা করার প্রকল্প হতে পারে, যমুনার চরে হেলিপ্যাড এয়ারপোর্টসমেত আধুনিক ক্যানসার হাসপাতালের হতে পারে। এইবার আপনি ব্যাংকে যান এবং ঋণ নিন। আপনি যদি সাহসী হন, দক্ষ হন, করিতকর্মা হন, আপনি চাইবেন এক হাজার কোটি টাকা, দুই হাজার কোটি টাকা, দশ হাজার কোটি টাকা। আপনার বুকের পাটা আরেকটু ছোট হলে চান এক শ কোটি টাকা, দুই শ কোটি টাকা। এক শ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার জন্য আপনার খরচ করতে হবে ৫ + ৫ = ১০ কোটি টাকা। ৫ কোটি টাকা দিয়ে আপনি কিনে ফেলুন যেকোনো রাঘববোয়ালকে। এরপরের ৫ কোটি টাকা দিয়ে আপনি কিনতে থাকবেন শোল, পাবদা, পুঁটিদের। কী বলব, বলেন, দেশটাই এমন, একটু তেল না ঢাললে কল চলে না। পদে পদে টাকা ছিটাতে হবে। তো ১০ কোটি টাকা খরচ করে আপনি ১০০ কোটি টাকা তুলে নিয়ে ৯০ কোটি পকেটস্থ করুন। উপরস্থ করুন। এবার পরের প্রকল্পে যান। এটা হবে এক হাজার কোটি টাকার। এক হাজার কোটি টাকা তুলতে আপনার খরচ হবে বিশ থেকে ত্রিশ কোটি। আগের ৯০ কোটি টাকা থেকে খরচ করুন। পেয়ে গেলেন এক হাজার কোটি টাকা। না। এসবের জন্য আপনাকে আগে থেকে দশ–বিশ কোটি টাকা পকেটে নিয়ে নামতে হবে না। সবকিছু আপনি করবেন বুদ্ধি দিয়ে।
কী রকম?
বাবা বিবাহযোগ্য ছেলেকে বললেন, ‘বেটা, তুমি কিন্তু আমার পছন্দমতো মেয়েকে বিয়ে করবে।’
ছেলে বলল, ‘কক্ষনো না।’
বাবা বললেন, ‘করো। কারণ, মেয়েটা আর কেউ নয়, সে হলো বিল গেটসের মেয়ে।’
ছেলে বলল, ‘তাহলে আমি রাজি হতে পারি।’
বাবা গেলেন বিল গেটসের কাছে, ‘আপনার মেয়ের সঙ্গে আমার ছেলের বিয়ে।’
বিল গেটস বললেন, ‘হতেই পারে না।’
‘হতে পারে, কারণ সে বিশ্বব্যাংকের সিইও।’
‘আচ্ছা, তাহলে ঠিক আছে’—বললেন বিল গেটস।
বাবা গেলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের কাছে, ‘আমার ছেলেকে আপনার ব্যাংকের সিইও বানাবেন।’
‘প্রশ্নই আসে না।’
‘আসে। কারণ, সে বিল গেটসের জামাতা।’
‘ওকে। তাহলে হতে পারে।’
এই ব্যাপারটাকে বলা হয় ব্যবসা। আপনি এই ব্যবসা করবেন। চাপা মারবেন, টাকা আনবেন, সেই টাকা থেকে খানিকটা বিলাবেন। যথাস্থানে।
আর আপনার প্রকল্পগুলো? একটাও থাকবে না। একটাও লাগবে না। হাজার কোটি টাকা নিয়ে আপনি এর মাথা কিনবেন, ওর মাথা বিক্রি করবেন। একে বদলি করবেন, ওকে নিয়োগ দেবেন, ওকে পদ দেবেন, ওকে কিনে দেবেন লাস ভেগাসের প্রমোদহোটেলের রুম।আর টাকাগুলো আপনি বিদেশে পাচার করে দেবেন। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে বাড়ি কিনে পাসপোর্ট নেবেন। দুবাই, ইস্তাম্বুল, কুয়ালালামপুর, টরন্টোতে বাড়ি কিনবেন। বিদেশি পাসপোর্ট থাকবে। আপনি এখন শুধু বাংলাদেশের শতকোটি টাকার ক্লাবের সম্মানিত সদস্য নন, আপনি পৃথিবীর বিলিয়ন ডলারস ক্লাবের সম্মানিত সদস্য।
বিপদ হচ্ছে? এবার দশ হাজার কোটি টাকা, বিশ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিন। যত বেশি টাকা ঋণ নেবেন, তত আপনার প্রতিপত্তি বাড়বে। আপনি বিশ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিলে এক শ কোটি দু শ কোটি টাকার কিস্তি ঠিকঠাক পরিশোধ করতে থাকবেন। ব্যাংকাররা আপনার বাড়িতে নিয়মিত ভেট পাঠাবেন, সরকার আপনাকে সিআইপি বলবে, শাহরুখ খান কি অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, মিয়া খলিফা কি ফারনান্দেজ আপনার ছেলের গায়েহলুদে এসে নেচে যাবেন।
আপনি বলতে পারেন, এতই যদি উপদেশ দিতে পারেন, নিজে করেন না কেন? পৃথিবীতে মানুষ দুই প্রকার। একদল লোক উপদেশ দেন। আরেক দল কাজ করেন। যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের জীবনের শিক্ষাগুলোই প্রথম প্রকারের মানুষেরা পরিবেশন করে থাকেন।
আপনার জন্য আদর্শ উদাহরণ সামনেই আছে: ইসলামী ব্যাংকে ভয়ংকর নভেম্বর। ইসলামী ব্যাংক থেকে নভেম্বরে তুলে নেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে তিন ব্যাংকে সন্দেহজনক ঋণ ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সরেজমিন অনুসন্ধানে কোম্পানিগুলোর ঠিকানায় গিয়ে কোম্পানি পাওয়া যায়নি। লিখেছে প্রথম আলো (২৪ নভেম্বর ২০২২)।
এবার পড়ুন যুগান্তরের ৫ দিন আগের খবর: পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল আদালত ৩৭ প্রান্তিক কৃষকের নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। তাঁদের মধ্যে ঈশ্বরদীর ১২ কৃষককে গ্রেপ্তার করে শুক্রবার বিকেলে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের ঋণের মামলায় তাঁদের জেলে পাঠানো হয়েছে। মাত্র ২৫-৩০ হাজার ঋণের টাকা ফেরত না দেওয়ার অভিযোগে ব্যাংকের মামলায় এ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
সমবায় ব্যাংকের ঋণ নিয়ে নিঃস্ব হয়ে মামলার শিকার কৃষি-উদ্যোক্তা সুদসহ ঋণ শোধ করেও মামলার পর মামলায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ঋণ করলে কমপক্ষে শতকোটি টাকা করুন। চেষ্টা করলে এবং একটুখানি বুদ্ধি থাকলে আপনি ব্যর্থ হবেন না। বেস্ট অব লাক।
আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক