কোরবানিতে প্রাণিকল্যাণ নিশ্চিত করবেন যেভাবে

এবার পবিত্র ঈদুল আজহায় বাংলাদেশে কোটির বেশি পশু জবাই হবে। এ ক্ষেত্রে কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে, যা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন জবাইয়ে পশুর ভোগান্তি কমাতে ধারালো ছুরির ব্যবহার, পশু শোয়ানোর আগে পিঠ এবং মাথায় হাত বোলানোসহ তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা, সে সময় পাটের রশি ব্যবহার, জবাইকালে হইহুল্লোড় এড়ানো, শিশু ও মানসিকভাবে দুর্বল এমন অতিবৃদ্ধ কাউকে সামনে না রাখা, জবাইয়ের জন্য সারিবদ্ধ রেখে একটির সামনে অন্যটি জবাই না করে যথাসম্ভব জবাইস্থল আড়ালে রাখা।

জবাই করার আগে পশুকে ভালোভাবে গোসল করিয়ে নিতে হবে, যাতে পশুর দেহে কোনো ময়লা না থাকে। জবাইয়ের ১২-১৪ ঘণ্টা আগে (আগের রাত থেকে) পশুকে দানাদার খাবার দেওয়া বন্ধ করতে হবে, কিন্তু জবাই করার দুই ঘণ্টা আগে পশুকে প্রচুর পানি পান করাতে হবে। এতে পশুর দেহ থেকে চামড়া ছাড়ানো সহজ হবে। পশু শোয়ানোর আগে জবেহ করার স্থানে ছোট্ট একটি গর্ত করে নিতে হবে এবং শোয়ানোর পর পশুর মাথা গর্তের কাছাকাছি নিয়ে জবেহ করলে রক্ত ঝরে গর্তে গিয়ে জমা হবে।

কোরবানির সময় পশুর প্রতি সদয় আচরণ প্রদর্শন করা ও দায়িত্বশীল হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়

পশুকে মাটিতে শোয়ানোর সময় সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে, যেন পশুর দেহে চোট লেগে চামড়া থেঁতলে না যায়। একটা ১০-১২ হাত মাপের শক্ত দড়ি দুই ভাঁজ করে দড়ির বন্ধ প্রান্ত দাঁড়ানো পশুর পেটের নিচ দিয়ে অপর দিকে নিয়ে পশুর শিরদাঁড়ার কাছাকাছি পর্যন্ত ওপরে ওঠাতে হবে। এরপর দুই ভাঁজ করা দড়ির খোলা প্রান্ত পশুর পিঠের ওপর দিয়ে বন্ধ প্রান্তের মধ্যে ঢুকিয়ে এক প্রান্ত পশুর মাথার দিকে এবং অন্য প্রান্ত পশুর লেজের দিকে নিয়ে দুই প্রান্ত থেকে সজোরে টানলে পশু সহজেই মাটিতে শুয়ে পড়বে।

পশুর গলায় ছুরি চালানোর সময় ধর্মীয় বিধিবিধানের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। ছুরি চালানোর সময় পশুর গলার মূল তিনটি অঙ্গ কেটে দিতে হয়। একটি হচ্ছে খাদ্যনালি, দ্বিতীয়টি শ্বাসনালি, তৃতীয়টি হচ্ছে শ্বাসনালির দুই পাশের দুটি রগ। যদি ঠিকমতো এই অঙ্গগুলো কেটে দেওয়া যায়, তাহলে গরু ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই নিস্তেজ হয়ে পড়বে।

আমাদের দেশে অনেকেই গরু জবাই করতে গিয়ে ছুরির ধারালো বা সুচালো মাথা দিয়ে খোঁচাখুঁচি করেন, মেরুদণ্ডের সঙ্গে ঘাড় পর্যন্ত যে স্পাইনাল কর্ড রয়েছে, সেটির রগ কাটার জন্য চেষ্টা করেন। এ ধরনের খোঁচাখুঁচি কোনোক্রমেই উচিত নয়। বিজ্ঞানীদের মতে, এভাবে খোঁচাখুঁচির ফলে পশুটি মৃত্যুর আগেই একবার হার্ট ফেল করে। এটি অনাকাঙ্ক্ষিত। অনেক সময় কসাই অথবা যাঁরা গরুর গোশত বানানোর জন্য আসেন, তঁারা পশু নড়াচড়া করা অবস্থায় পায়ের রগ কাটা শুরু করে দেন। এটিও ঠিক না। এসবের কারণে কোরবানিতে প্রাণিকল্যাণ নিশ্চিত হয় না এবং আমাদের দেশে এমনটি ঘটতে দেখা যায়, যা মোটেও সমীচীন নয়।

অবশ্যই দক্ষ ব্যক্তিকে দিয়ে চামড়া ছাড়াতে হবে। চামড়া ছাড়ানোর জন্য তুলনামূলকভাবে কম ধারালো ও মাথা বাঁকানো ছোট ছুরি ব্যবহার করতে হবে। জবাই করার পর পশুর দেহ নিস্তেজ হয়ে গেলে চিত করে শুইয়ে দুই পাশে ঠেস দিতে হবে। এতে চামড়ায় ছুরির কাটা দাগ লাগার শঙ্কা থাকে না। প্রথমে ছুরি দিয়ে চার পায়ের খুুরের সামান্য ওপরে রিংয়ের মতো করে চামড়া কেটে দিতে হবে। বড় ছুরির অগ্রভাগ দিয়ে জবাই করার স্থান থেকে গলা, সিনা ও পেটের মাঝখানে বরাবর অণ্ডকোষ বা ওলানের পেছনে মলদ্বার পর্যন্ত চামড়া ফেড়ে সিনার ওপর দিয়ে কাটা অংশের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে হবে।

একইভাবে পেছনের দুই পায়ের হাঁটু থেকে অণ্ডকোষের মাঝ বরাবর চামড়া কেটে প্রথমত লম্বা কাটা দাগের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে হবে। কোনোক্রমেই চামড়ার যেকোনো কাটা দাগ যেন আঁকাবাঁকা না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। ছোট পশুকে গাছের ডালে বা ঝুলনের সঙ্গে ঝুলিয়ে চামড়া ছড়ানো সুবিধাজনক। চামড়া ছড়ানোর সময় চামড়ার সঙ্গে কোনোক্রমেই যেন গোশত, চর্বি বা ঝিল্লি লেগে না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

কোরবানির সময় পশুর প্রতি সদয় আচরণ প্রদর্শন করা ও দায়িত্বশীল হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়।

● ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম

[email protected]