একুশ শতকে এসে গণতন্ত্রের অবনমনের সূচনা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে চালানো জরিপের জনমতে দেখা যাচ্ছে, আধা গণতান্ত্রিক অথবা একদলীয় শাসনের দেশের মানুষের চেয়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জনগণ তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক বেশি হতাশাগ্রস্ত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেই হতাশার ব্যবধান অনেক বেশি।
নিজেদের সরকার সম্পর্কে তাদের আস্থার মাত্রার ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অর্থাৎ অগণতান্ত্রিক দেশগুলোর চেয়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর আস্থাশীলতার স্কোর অনেক নিচুতে। নিজ দেশের নাগরিকদের আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সরকার যত স্কোর অর্জন করেছে, চীনের স্কোর তাদের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি।
আজ অগ্রসর গণতন্ত্রের দেশগুলোতে লাখ লাখ শিশু দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হচ্ছে। দারিদ্র্যের কারণে সেখানকার বহু প্রবীণকে খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। পশ্চিমের অগ্রসর গণতন্ত্রের বেশির ভাগ নাগরিকই তাঁদের জীবনমান আরও নিচের দিকে পড়ে যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
এর মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ভারত। জাতপাতের সংঘাত, সাম্প্রদায়িক বিভেদ ও মেরুকরণ এবং দারিদ্র্য থাকার পরও ভারতই একমাত্র বড় গণতন্ত্র, যেখানে নাগরিকেরা তাদের দেশের পরিচালন পদ্ধতি ও সরকারের প্রতি আশাবাদের ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার স্কোর অর্জন করেছে।
৫০ বছর আগেও পশ্চিমে বেশির ভাগ পরিবারে একজন উপার্জনকারী সদস্য ছিল এবং তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে ছিল। আজ অসংখ্য পরিবারে মা–বাবা দুজনই উপার্জন করেন। তবু তাঁরা কুলিয়ে উঠতে পারছেন না। শুধু বাবা অথবা শুধু মা আছেন—এমন বহু পরিবারের কপালে ‘কর্মজীবী দরিদ্র’ পরিবারের তকমা জুটছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমের ধনী দেশগুলো যে শিল্প ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের স্বাদ উপভোগ করছিল, ১৯৮০–এর দশকে এশিয়ার অর্থনীতিগুলো তাদের পশ্চিমের সেই আধিপত্য বলয় থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়।
ওই সময়টাতে জাপান কার্যত পশ্চিমাদের খুচরা ইলেকট্রনিকস শিল্পকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। জাপান একইভাবে পশ্চিমাদের গাড়িশিল্পকেও ‘বাড়ি পাঠিয়ে’ দিচ্ছিল। তবে মাঝপথে এসে জাপান পশ্চিমা গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের কারখানাগুলো পুনরায় চালু করতে সময় দেওয়ার জন্য নিজের ওপর ‘স্বেচ্ছাসেবী’ রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এর ফলে পশ্চিমা গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো বেঁচে গিয়েছিল।
পশ্চিমের শিল্প খাত থেকে এশিয়া মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমা বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদন কারখানা এশিয়ায় স্থানান্তরিত করে। এটি পশ্চিমা দেশের শিল্প খাতে কর্মসংস্থান কমিয়ে দেয় এবং সরকারগুলোর করের উৎস ভিত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নব্য উদারবাদের উত্থান সম্পদের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য বাড়িয়ে তোলে এবং সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীকে সংকুচিত করে ফেলে।
আজ অগ্রসর গণতন্ত্রের দেশগুলোতে লাখ লাখ শিশু দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হচ্ছে। দারিদ্র্যের কারণে সেখানকার বহু প্রবীণকে খাদ্যতালিকায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। পশ্চিমের অগ্রসর গণতন্ত্রের বেশির ভাগ নাগরিকই তাঁদের জীবনমান আরও নিচের দিকে পড়ে যাবে কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
বেশির ভাগ গণতন্ত্রে প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল দলগুলো পালা করে ক্ষমতায় আসে। এসব দেশের সরকারগুলো ঋণের বোঝায় নুয়ে পড়েছে। অনেক দেশের সরকারি ঋণের পরিমাণ জিডিপির ১০০ শতাংশের বেশি। জাপানের সরকারি ঋণের পরিমাণ তার জিডিপির ৩০০ শতাংশের বেশি।
এ ঋণের বোঝা পরবর্তী প্রজন্মের ঘাড়ে চাপিয়ে যাওয়া হচ্ছে। অথচ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের এ ঋণের অর্থ শিক্ষা, অবকাঠামো ও স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয় করা হচ্ছে না।
এ অবস্থা এসব দেশের ভোটারদের মনে প্রশ্ন জাগাচ্ছে, কেন তারা বছরের পর বছর ধরে এমন রাজনৈতিক নেতাদের ভোট দিয়ে গদিতে বসাচ্ছে, যাঁদের বানানো নীতির কারণে অসাম্য, দারিদ্র্য ও ঋণ উত্তরোত্তর বেড়েই যাচ্ছে।
জনগণের এ ক্রমবর্ধমান হতাশা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিক দুর্বলতা হিসেবে উন্মোচিত হচ্ছে।
বেশির ভাগ গণতন্ত্রে একজন রাজনৈতিক প্রার্থীর পক্ষে সরকারি ব্যয় কমানো ও বরাদ্দ সংকোচনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। সে কারণে প্রায়ই রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি ব্যয়সাধ্য প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দেন। তার সঙ্গে প্রতিরক্ষা, সবুজ প্রযুক্তি অথবা ক্রয়সাধ্য আবাসনের মতো অতিরিক্ত প্রতিশ্রুতিও তাঁরা দিয়ে থাকেন।
এ সমস্যা ইউক্রেন সংঘাতকে আরও তীব্র করেছে। রাশিয়ায় অবরোধ আরোপের খেসারত দিতে গিয়ে ইউরোপের কোটি কোটি মানুষকে কষ্ট করতে হচ্ছে। তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। তাদের ঋণসংকট আরও প্রকট হয়েছে।
ইউক্রেন সংঘাত গণতন্ত্রের বিদ্যমান আরেকটি বড় সমস্যাকে সামনে নিয়ে এসেছে।
কয়েক দশক আগে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে বড় ধরনের সংহতি ছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্রে চারটি গোষ্ঠী দেশটির গোটা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করে। ইন্টারনেটের কারণে প্রায় উঠে যাওয়া যে ছাপা পত্রিকাগুলো আছে, তাকে সরকারের তোষামোদ করা যন্ত্র হিসেবে কিছু কোটিপতি বাঁচিয়ে রেখেছে।
ইউরোপে বিবিসি ও ডয়চে ভেলে জনমতের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো ঢালাওভাবে প্রথম থেকে এক সুরে ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। প্রায় সব মিডিয়া এ যুদ্ধের ঐতিহাসিক পটভূমিকে চেপে যাচ্ছে, পূর্ব দিকে ন্যাটোর সম্প্রসারণ চেষ্টার কারণেই যে এ যুদ্ধ শুরু হয়েছে, সেটি তারা মুখে আনছে না।
বাস্তবতা হলো, যে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো অগণতান্ত্রিক রাশিয়ার বিরুদ্ধে একজোট হয়েছে, সেই গণতান্ত্রিক দেশগুলোর নিজেদের জনগণের অনেক বড় অংশ তাদের ওপর ততটা ভরসা পাচ্ছে না, যতটা পুতিনের সরকারের ওপর রাশিয়ার জনগণ ভরসা পাচ্ছে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
জ্যান ক্রিক্কি হংকংভিত্তিক পত্রিকা এশিয়া ২০০০–এর সাবেক ব্যবস্থাপনা সম্পাদক