জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) একেকটি বইয়ে লেখক-সম্পাদক হিসেবে ১০-১৫ জনের নাম পর্যন্ত দেখা যায়। বই প্রকাশের আগে কয়েকজন বিষয়-বিশেষজ্ঞের কাছেও পাণ্ডুলিপি পাঠানো হয় দেখার জন্য। এমনকি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষা বোর্ডের বিভিন্ন উচ্চতর কর্তাব্যক্তির কাছে বই পৌঁছে দেওয়া হয় মূল্যায়ন করতে।
এরপরও পাঠ্যবইয়ে কেমন করে ভুল থাকে, সেই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। প্রতিবছর নতুন বই প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এসব ভুল নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় শিক্ষক-অভিভাবকদের মধ্যে। যাদের জন্য এসব বই, তাদের মধ্যেও প্রতিক্রিয়া কম হয় না।
প্রথম আলোর ‘ভাষা প্রতিযোগ’ করতে গিয়ে সারা দেশের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি আলাপের সুযোগ ঘটেছে। তারা পাঠ্যবইয়ের ভুল নিয়ে সব সময় কথা বলেছে। ‘ভাষা প্রতিযোগের’ একটি অংশে শিক্ষার্থীরা মঞ্চে বসে থাকা শিক্ষকদের প্রশ্ন করার সুযোগ পায়। একে বলা হয় প্রশ্নোত্তর–পর্ব। এই প্রশ্নোত্তর–পর্বের বড় অংশজুড়ে থাকে পাঠ্যবইয়ের ভুল নিয়ে তাদের মন্তব্য। সেসব মন্তব্যে ঝরে পড়ে বেদনা, ক্ষোভ ও হতাশা। প্রশ্ন হলো, যে পাঠ্যবই লাখ লাখ শিক্ষার্থীর হাতে গিয়ে পৌঁছায়, সেখানে ভুল থাকে কীভাবে? তাহলে কি শিক্ষার্থীরা ভুল জেনেই বড় হবে?
প্রথমেই বলে নিতে হয়, পাঠ্যবইয়ের ভুলের সংখ্যা সীমাহীন নয়। তবে যে ধরনের ভুল থাকে, তা কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। ভুল সীমিত হলেও প্রাথমিক শিক্ষার গণ্ডি পার হওয়ার আগেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই ধারণা জন্মায় যে বইয়ের তথ্য সব সময় প্রামাণ্য নয়। যেমন কবি জসীমউদ্দীনের জন্ম কত সালে কিংবা তাঁর নাম কোন বানানে লিখতে হবে, এটি পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের বই দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় না। কারণ, সব শ্রেণির বইয়ে তা একভাবে লেখা নেই। তথ্যগত অসংগতির কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বিধা তৈরি হয়। এই দ্বিধা ভবিষ্যতে তাদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে।
এতজন অভিজ্ঞ লোক একটি বই দেখার পরও ভুল থাকে, কারণ তাঁদের কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকে না, দায়িত্বজ্ঞানেরও অভাব থাকে। এসব ভুল এড়ানোর সহজ উপায়, লেখকদের মধ্যে এবং লেখক-সম্পাদকের মধ্যে কাজের সমন্বয় ঘটানো। সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি তৈরি হওয়ার পর লেখক-সম্পদককে একসঙ্গে বসতে হবে এবং পুরো বই পড়ে দেখতে হবে।
পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকা অপরাধও বটে। যে কারণে এ নিয়ে আদালতে পর্যন্ত দাঁড়াতে হয়েছে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডকে। তবু ভুল করা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারেনি। তাহলে কি ধরে নিতে হবে পাঠ্যপুস্তকে ভুল থাকা অবধারিত কোনো ব্যাপার? এনসিটিবির কাজ করতে গিয়ে পাঠ্যবইয়ে ভুল থাকার কারণ বুঝতে পেরেছি। এই লেখায় এসব কারণ তুলে ধরার পাশাপাশি সেগুলো এড়ানোর উপায় নিয়েও বলতে চাই।
কিছু ভুল এমন থাকে, যেগুলো ভালো প্রুফ রিডার দিয়ে পড়ালেই সংশোধন করে নেওয়া সম্ভব। দুঃখজনক হলেও সত্য, এনসিটিবির নিজেদের ভালো প্রুফ রিডার নেই। এনসিটিবির বইয়ে ভাষা-সম্পাদনার কাজটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হওয়া উচিত। প্রাথমিক শাখার জন্য এটি আরও বেশি প্রযোজ্য। পাঠ্যবইয়ের ভাষা—তা বিজ্ঞান হোক আর গণিতই হোক, ওই শ্রেণির উপযোগী কি না, তা বিবেচনা করা দরকার। এ জন্য প্রতিটি বইয়ে ভাষা-সম্পাদনার কাজে আলাদাভাবে ভাষাদক্ষ শিক্ষককে যুক্ত করা প্রয়োজন।
সম্পাদিত লেখার ক্ষেত্রেও কিছু ভুল ঘটে। পাঠ্যবইয়ের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কোনো লেখা বাছাইয়ের পর প্রায় ক্ষেত্রেই তা সম্পাদনার প্রয়োজন হয়। এসব ক্ষেত্রে পুরোনো বানানকে বর্তমান বানানে রূপান্তর করে দেওয়া হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বড় লেখাকে কেটে ছোট করা হয়। এসব কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ত্রুটি থেকে যায়। তবে গুরুতর সমস্যা তৈরি করে তথ্যগত ভুল। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত তথ্যেও ভুল থাকে। মানতেই হয়, ইতিহাসের কোনো কোনো তথ্য ও বিবরণ তর্কসাপেক্ষ। কিন্তু যেসব তথ্য ও বিবরণে তর্ক নেই, পাঠ্যবইয়ে লেখার সময়ে সেগুলোতেও ভুল থাকবে কেন?
পাঠ্যবইয়ে আরেক ধরনের ভুল থাকে, যাকে বলা যায় অসংগতি। একেক বইয়ে একেক ধরনের তথ্য থাকায় শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হয়। এ ধরনের ভুলের বড় কারণ, বিভিন্ন শ্রেণির বইয়ের লেখকদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা। এমনকি একই বইয়ের লেখক-সম্পাদকদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে এক বইয়েই দুই রকম তথ্য পাওয়া যায়। এর কারণ, পাঠ্যবই লেখার দায়িত্ব পেয়ে লেখকেরা যার যার মতো অংশ ভাগ করে নেন। এরপর নিজেদের মতো করে লেখার কাজ শেষ করেন। কিন্তু পরে তা একসঙ্গে বসে মেলান না।
এসব ভুলের জন্য প্রধান দায় কার? অবশ্যই পাঠ্যবইয়ের ভুলের জন্য প্রধান দায় লেখক-সম্পাদকের। বই চূড়ান্ত করার আগে যেসব শিক্ষক, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও বিশিষ্টজনের হাতে বইয়ের পাণ্ডুলিপি পাঠানো হয় এবং কর্মশালায় ডাকা হয়, তাঁদেরও দায় আছে। এতজন অভিজ্ঞ লোক একটি বই দেখার পরও ভুল থাকে, কারণ তাঁদের কাজের মধ্যে সমন্বয় থাকে না, দায়িত্বজ্ঞানেরও অভাব থাকে। এসব ভুল এড়ানোর সহজ উপায়, লেখকদের মধ্যে এবং লেখক-সম্পাদকের মধ্যে কাজের সমন্বয় ঘটানো। সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি তৈরি হওয়ার পর লেখক-সম্পদককে একসঙ্গে বসতে হবে এবং পুরো বই পড়ে দেখতে হবে।
পাঠ্যবইয়ের ভুলের জন্য দায় এনসিটিবি কর্তৃপক্ষেরও আছে। তাঁরা পুস্তক প্রণয়নের জন্য যতটুকু সময় দেন, ততটুকু সময়ে ভালো কাজ তুলে আনা কঠিন। ফলে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষের উচিত, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও সংশোধনের জন্য যথেষ্ট সময় হাতে রাখা। তা ছাড়া এত বড় কাজের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকে, তা এককথায় হাস্যকর। এখানে অনেক বিশিষ্টজনের নামই উল্লেখ করা যাবে, যাঁরা লেখক-সম্মানী ফিরিয়ে দিয়েছেন!
জানিয়ে রাখা ভালো, এনসিটিবি প্রতিবছর নিজ উদ্যোগে বই সংশোধনের কাজ করে থাকে। এ কাজে অভিজ্ঞ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের যুক্ত করতে হবে। তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বইয়ের দু-একজন লেখককেও রাখতে হবে। নইলে সংশোধন করতে গিয়ে আরও বড় ধরনের ত্রুটি ঘটতে পারে।
তারিক মনজুর অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়