তাজরীন গার্মেন্টসে আগুন লেগেছিল আজ থেকে ১১ বছর আগে ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সন্ধ্যায়। সেই আগুনে পুড়ে অকালে মৃত্যু হয়েছিল অন্তত ১১১ পোশাকশ্রমিকের।
পরদিন সকালে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের ওই পোশাক কারখানা পরিদর্শনে গিয়ে প্রথম যে বিষয়টি আমার চোখে পড়ে তা হলো, ৯ তলা কারখানাটির বেশ কয়েকটি ফ্লোরের কলাপসিবল গেটের তালা কাটা অবস্থায় ঝুলছে। অর্থাৎ আগুন লাগার সময় কারখানার কলাপসিবল গেটগুলো তালাবদ্ধ ছিল বলেই আগুন নেভানোর কাজে আসা ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীদের গেটের তালা কেটে তারপর ভেতরে ঢুকতে হয়েছিল।
কারখানার ভেতরে ঢুকে দেখি, আগুনের হাত থেকে বাঁচার জন্য শ্রমিকেরা যে ভীষণ লড়াই করেছিলেন, তার সাক্ষ্য ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে কারখানার প্রতিটি ফ্লোরে।
তালাবদ্ধ কলাপসিবল গেট দিয়ে বের হতে না পেরে শ্রমিকেরা বাঁচার আশায় জানালার কাচ, লোহার গ্রিল, এগজস্ট ফ্যান ইত্যাদি ভেঙে, বাঁকিয়ে নানাভাবে বের হওয়ার চেষ্টা করেছেন।
প্রতিটি জানালার নিচে ছড়ানো–ছিটানো রয়েছে শ্রমিকদের স্যান্ডেলগুলো। যাঁরা পেরেছেন, তাঁরা ভাঙা জানালা কিংবা বাঁকানো লোহার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে নিচের টিনের চাল কিংবা পার্শ্ববর্তী ভবনের ছাদে লাফিয়ে, কেউবা নির্মাণাধীন ভবনটির এক পাশের বাঁশের মাচা বেয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেছেন। যাঁরা পারেননি, তাঁরা পুড়ে কয়লা হয়েছেন।
যে ফ্লোরগুলোর কলাপসিবল গেট আগুন লাগার পর দেরিতে হলেও খুলে দেওয়া হয়েছিল, সেই সব ফ্লোরের অনেক শ্রমিকের পক্ষেও নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ, ভবনটিতে কোনো ফায়ার এসকেপ বা বিকল্প সিঁড়ি ছিল না, যা দিয়ে বাইরের দিকে বের হওয়া যায়।
ভবনের সিঁড়িগুলোর মুখ ছিল ভেতরের দিকে নিচতলার গোডাউনের মধ্যে; দাহ্য সিনথেটিক সুতাভর্তি এ গোডাউন থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ফলে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে বা আগুন ছড়িয়ে পড়ার আগেই যাঁরা নামতে পেরেছিলেন, কেবল তাঁদের পক্ষেই এই নরকের সিঁড়ি অতিক্রম করে মূল প্রবেশপথ দিয়ে বের হয়ে যাওয়া সম্ভব হয়েছিল।
মালিকপক্ষের নির্দেশ মোতাবেক যেহেতু প্রতিটা ফ্লোরের কলাপসিবল গেট সব সময় বন্ধ থাকত এবং যেহেতু উৎপাদন ঠিক রাখার চাপ ও মালামালের নিরাপত্তার অজুহাতে কারখানার প্রোডাকশন ম্যানেজার ও নিরাপত্তারক্ষীরা আগুন লাগার পরও বেশির ভাগ ফ্লোরের গেটই খোলেননি (দু–একটা ক্ষেত্রে খুললেও ততক্ষণে দেরি হয়ে যায়), সেহেতু বহু শ্রমিক সময়মতো সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারেননি। ফলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসা ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে, আগুনে পুড়ে কয়লা হতে হয়েছিল তাঁদের।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, তাজরীন কারখানায় ফায়ার এসকেপ না থাকা, কারখানায় সিঁড়ির মুখে দাহ্য পদার্থ স্তূপ করে রাখা এবং কলাপসিবল গেটগুলো সর্বক্ষণ তালাবদ্ধ করে রাখার কারণেই আগুনে পুড়ে এত শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছিল, যা কারখানার মালিকপক্ষের অবহেলাকেই সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে।
কাটা তালার কলাপসিবল গেটের ছবিসহ তাজরীন মালিকপক্ষের এই অবহেলার বিষয়গুলো বর্ণনা করে আমি ২৫ নভেম্বর রাতে ফেসবুক ও ব্লগে একটি লেখা লিখেছিলাম। লেখাটির শিরোনাম ছিল—‘সরেজমিন: যেভাবে কয়লা বানানো হলো গার্মেন্টস শ্রমিকদের’, যা পরবর্তীকালে আমার ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
তাজরীন কারখানার মালিকপক্ষের অবহেলার এই সুস্পষ্ট প্রমাণগুলো দেখে আমার তখন মনে হয়েছিল, গার্মেন্টস কারখানায় শ্রমিকদের তালাবদ্ধ করে রাখার অভিযোগটি অনেক পুরোনো।
এর আগেও অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিক মৃত্যুর পর এ রকম অভিযোগ উঠেছিল, কিন্তু সুস্পষ্ট প্রমাণের অভাবে কারও বিচার বা শাস্তি হয়নি। কিন্তু তাজরীন কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে যেহেতু তালাবদ্ধ করে রাখার প্রমাণ মিলেছে এবং যেহেতু ফায়ার এসকেপ না থাকার বিষয়টিও সামনে এসেছে, তাই এবার নিশ্চয়ই এই নির্মম অবহেলার জন্য কারখানামালিক দেলোয়ার হোসেন ও তাঁর সহযোগীরা ছাড় পাবেন না।
আমার সেই ধারণা যে কত ভুল ছিল, তা অবশ্য বুঝতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। অনেক সমালোচনার পর মামলার মূল আসামি তাজরীনের মালিক দেলোয়ার হোসেনকে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার করা হলেও ২০১৪ সালের আগস্টেই তিনি জামিন পেয়ে যান।
অন্যদিকে শতাধিক শ্রমিক হত্যার এ মামলার অভিযোগ গঠন করতেই পার করা হয় তিন বছর। এরপর শুরু হয় সাক্ষ্য গ্রহণ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতা। ২০১৫ সালের অক্টোবরে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরুর পর গত ৮ বছরে এখন পর্যন্ত মামলার অভিযোগপত্রে উল্লিখিত ১০৪ জনের মধ্যে মাত্র ১১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।
সাক্ষ্য গ্রহণে কেমন দীর্ঘসূত্রতা ও অবহেলা করা হচ্ছে, বোঝা যায় এ বছরের সাক্ষ্য গ্রহণের পরিস্থিতি দেখলে।
বাংলা ট্রিবিউনের সংবাদ অনুসারে, এ বছর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য মোট ৬টি তারিখ ধার্য করা হয়: ১ জানুয়ারি, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ৩০ মে, ১৯ জুলাই, ৩ সেপ্টেম্বর ও ১ নভেম্বর। এর একটি তারিখেও রাষ্ট্রপক্ষ সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। পরবর্তী শুনানির জন্য আদালত তারিখ নির্ধারণ করেছেন ২০২৪ সালের ২৫ মার্চ। এভাবে যদি চলতে থাকে, তাহলে আগামী ১০০ বছরেও এ বিচার শেষ হবে না।
তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দেলোয়ার হোসেনসহ মালিকপক্ষের অবহেলা প্রমাণের জন্য কী কারণে ১০৪ সাক্ষীর সাক্ষ্য প্রয়োজন, সেটাও আসলে স্পষ্ট নয়।
কারখানার অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থায় ত্রুটি থেকে শুরু করে কলাপসিবল গেট তালা দিয়ে আটকে রাখার ঘটনায় মালিক পক্ষের অবহেলার বিষয়টি সরকারি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন, ঘটনার সময়কার বিভিন্ন আলোকচিত্র এবং ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগী কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীর সাক্ষ্য থেকেই প্রমাণ করতে পারা উচিত। এ ক্ষেত্রে ১০৪ জনকে সাক্ষী মানার উদ্দেশ্য কি অভিযোগ প্রমাণ নাকি বিচারে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি করা, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়।
আসলে তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের বিচারকার্যে এই অবহেলা ও দীর্ঘসূত্রতার পেছনে কারখানার মালিক দেলোয়ার হোসেনের অর্থ ও ক্ষমতার ভূমিকা স্পষ্ট। ২০১৮ সাল থেকে তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর মৎস্যজীবী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত এবং ২০২২ সালের মে মাসে তাঁকে সংগঠনটির সভাপতিও নির্বাচিত করা হয়।
কাগজে-কলমে আইন সবার জন্য সমান হলেও বাস্তবে আইন ক্ষমতার হাত ধরে চলে। এ দেশে ক্ষমতাসীন সরকার চাইলে বিচার হয়, না চাইলে বিচার হয় না।
নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন নাশকতার মামলায় বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিচার ত্বরান্বিত করার জন্য রাতের বেলাতেও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার বংশাল থানায় করা এক নাশকতার মামলায় ৩৩ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেই ২০ নভেম্বর বিএনপির ৬৮ নেতা-কর্মীকে সাড়ে তিন বছর করে সাজা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পাঁচ সাক্ষীর মধ্যে একজন মামলার বাদী আর আরেকজন তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা।
অথচ তাজরীন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি কোনো গায়েবি মামলার বিষয় নয়, এ ঘটনায় কারখানার মালিকপক্ষের অবহেলাতেই শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে।
মালিকপক্ষের অবহেলার সুস্পষ্ট সাক্ষ্য দিচ্ছে ফায়ার এসকেপবিহীন কারখানা ভবন, কলাপসিবল গেটে ঝুলতে থাকা কাটা তালার ছবি আর বেঁচে থাকা আহত শ্রমিকের ভাষ্য। সরকারি তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও মালিক পক্ষের অবহেলার বিষয়টি প্রমাণিত। তারপরও এ মামলার বিচার নিয়ে এই দীর্ঘসূত্রতা দেখে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক—সরকার কি আদৌ এ বিচার সম্পন্ন করতে চায়?
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক
[email protected]