ভারতের জাতীয় নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় এটিকে দেশি–বিদেশি সংবাদ মাধ্যম হিন্দুত্ববাদের পরাজয় হিসেবে দাবি করছে। তাদের এই দাবি যে কত অবান্তর, তা একটিমাত্র উদাহরণ দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করব।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এই প্রথম ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় কোনো মুসলমান মন্ত্রীর স্থান হয়নি। ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই লোকসভায় মুসলমান জনপ্রতিনিধির সংখ্যা কমছিল। এরপরও ২০১৪ ও ২০১৯ সালে সংখ্যালঘুবিষয়ক মন্ত্রণালয়টি পেয়েছিলেন দুজন মুসলিম এমপি। ২০১৪ সালে নাজমা হেপতুল্লাহ এবং ২০১৯ সালে মুখতার আব্বাস নাকভি। এবার কেউ নেই।
ভারতে ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচন থেকে মুসলমান এমপির হার ৫ শতাংশের নিচে যায়নি। ১৯৫৭ সালে দেশভাগ ও সাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার কারণে মুসলমান এমপির হার ৪ দশমিক ৬৬ এবং বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী পর্যায়ে ১৯৯৬ সালে ৪ দশমিক ৯৭ শতাংশ হয়েছিল। এ ছাড়া প্রতিবারই ভারতে মুসলমান এমপির সংখ্যা লোকসভায় ছিল ৫ শতাংশের ওপরে।
এখানে লক্ষণীয়, কংগ্রেসের আমলেও লোকসভায় মুসলমান প্রতিনিধির হার সব সময়েই ঘোরাফেরা করেছে ৫ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে, এমনকি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর প্রধান প্রবক্তা জওহরলাল নেহরু প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়েও। যদিও ১৯৫২ সালের প্রথম নির্বাচন থেকে ভারতে মুসলমান জনসংখ্যা কখনোই ১০ শতাংশের নিচে যায়নি, জানিয়েছেন জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া অধ্যাপক আদনান ফারুকি (পলিটিক্যাল রিপ্রেজেন্টেশন অব আ মাইনরিটি, রুটলেজ)।
কিন্তু ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে এই হার দ্রুত কমতে শুরু করে। ২০১৪ সাল থেকে পরপর তিনটি নির্বাচনে লোকসভায় মুসলমান এমপির গড় হার ৪ দশমিক ৪৮। ১৯৫২ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত এই গড় ছিল ৫ দশমিক ৮ শতাংশ। অর্থাৎ বিজেপি ক্ষমতায় আসার পরে লোকসভায় মুসলমান জনপ্রতিনিধিত্ব গড়ে দেড় শতাংশ কমে গিয়েছে।
প্রার্থীর সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে সব দল
২০১৪ সাল থেকে আরও উদ্বেগজনক একটা ঘটনা ঘটছে। বিজেপিবিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ ও তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোও লোকসভায় মুসলমান প্রার্থীদের মনোনয়ন দেওয়া সাংঘাতিক হারে কমিয়ে দিয়েছে।
২০১৪ সালে মোট ৩ হাজার ২৪৫ প্রার্থীর মধ্যে ৩২০ জন, অর্থাৎ ৯ দশমিক ৯ শতাংশ মুসলমান ছিলেন বলে ‘মেজরিটেরিয়ান স্টেট’ বইতে লিখেছেন ফরাসি অধ্যাপক ও ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ক্রিস্টোফ জেফ্রোলে। ভারতের নির্বাচনে প্রার্থী বিশ্লেষক সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মস জানিয়েছে, ২০২৪ সালে অন্তত ৮ হাজার ৩৩৭ জন (এটা চূড়ান্ত সংখ্যা নয়, আরও বাড়তে পারে, কিন্তু কখনোই কমবে না) প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, যার মধ্যে মুসলমান প্রার্থীর সংখ্যা ৭৮, অর্থাৎ শূন দশমিক ৯৩ শতাংশ। মানে, ভারতে গত ১০ বছরে মুসলিম প্রার্থীর হার ৯ দশমিক ৯ থেকে কমে শূন্য দশমিক ৯৩ হয়ে গিয়েছে।
দিল্লির গবেষক আসিফ মুজতবাকে উদ্ধৃত করে ‘মক্তব মিডিয়া’ই সম্প্রতি জানিয়েছে, এ মুহূর্তে যে আসনে মুসলমান জনসংখ্যা ও ভোটার বেশি রয়েছে, সেই আসন পরবর্তী সময়ে তফসিলি জাতি ও উপজাতির জন্য সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ডিলিমিটেশনের কারণে।
কিন্তু ওপরের তথ্য থেকে পরিষ্কার, ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো বিজেপি বা হিন্দুত্বের ভয়ে মুসলমান প্রার্থী দেওয়া অসম্ভব হারে কমিয়ে দিয়েছে। যেমন কংগ্রেস ২০১৯ সালে দিয়েছিল ৩৪ জন, এবারে দিয়েছে ১৯। তৃণমূল কংগ্রেস তেরো থেকে নেমেছে ছয়ে, সমাজবাদী পার্টি আট থেকে চারে, লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল পাঁচ থেকে দুইয়ে এবং বিজেপি তিন থেকে একে। তবে বিজেপি দু-একজনের বেশি মুসলমান প্রার্থী কোনোবারই দেয় না, এবারও দেয়নি।
ভারতে ২০১১ সাল থেকে মুসলমান জনসংখ্যার হার ১৪ দশমিক ২, অর্থাৎ ১৭ কোটির কিছু বেশি। ভারতে দীর্ঘদিন ধরে সেন্সাস বা আদমশুমারি রিপোর্ট প্রকাশ করা হয় না, ফলে এ সংখ্যা সম্ভবত আরও বেড়ে থাকতে পারে। মুসলমান সমাজ জনসংখ্যার অন্তত ১৪ দশমিক ২ শতাংশ হলেও এবার তাদের লোকসভায় প্রতিনিধিত্ব ৪ দশমিক ৪২ শতাংশ। যাবতীয় তথ্য প্রমাণ করে, মুসলমান সমাজের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ দ্রুতগতিতে কমছে।
এর অর্থ, ২০২৪ সালে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও ভারতের রাজনীতির ‘প্লুরালিস্ট’ বা বহুত্ববাদী চরিত্র হারিয়ে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের কাঠামো প্রতি নির্বাচনেই শক্তপোক্ত হচ্ছে। ওপরের পরিসংখ্যানই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ।
হিন্দুত্ববাদী দক্ষিণপন্থী দলের শক্তি কমুক বা বাড়ুক, বিজেপিবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলো বিজেপির মোকাবিলা করতে গিয়ে আরও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে কমসংখ্যক মুসলমান প্রার্থী দিচ্ছে। তারা ধরেই নিচ্ছে যে, হিন্দু অঞ্চলে বা এমনকি সেখানে বড়সংখ্যক মুসলমান ভোটার রয়েছেন, সেখানেও মুসলমানদের জেতার সম্ভাবনা কম। এর ফলে মুসলমানরা শুধু সেই অঞ্চলেই মনোনয়ন পাচ্ছেন, যেখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা ৫০ শতাংশ বা তার বেশ খানিকটা বেশি।
এটা চলতে থাকলে নিশ্চিতভাবে ভারতে মুসলমান সমাজ ভারতের কয়েকটি অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। এখনো যেমন কিছু অঞ্চলে, যেখানে হিন্দু ভোটার বেশি, সেখানে মুসলমান প্রার্থীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বা জিতছেন, সেটা আর ভবিষ্যতে হবে না।
এবারেই পশ্চিমবঙ্গে মোট ছয়জন এমপির মধ্যে পাঁচজন এসেছেন মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলা থেকে। ভবিষ্যতে এই ‘ট্রেন্ড’ সম্ভবত আরও বাড়বে। রাজ্যস্তরের নির্বাচনগুলোকে বিশ্লেষণ করলেও মোটামুটিভাবে একই ফল পাওয়া যাবে।
এখানে এটাও উল্লেখ্য, বিজেপি নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্সের (এনডিএ) একজন মুসলমান প্রার্থী এবারের নির্বাচনে জেতেননি। বস্তুত, এনডিএর ২৯৩ জন এমপির মধ্যে মুসলিম, খ্রিষ্টান বা শিখ সমাজের সংখ্যালঘু এমপি একজনও নেই। শুধু উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশ থেকে বিজেপির এক বৌদ্ধ এমপি এবারেও জিতেছেন।
মুসলমান জনপ্রতিনিধিত্ব কমার আরও কারণ
ভারতের লোকসভায় মুসলমান প্রতিনিধিত্ব ভবিষ্যতে আরও কমবে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকেরা। সে কারণেই মুসলমান সম্প্রদায়ের বিষয় নিয়ে ভারতে যে ওয়েবসাইটটি নিয়মিত লেখালেখি করে, সেই ‘মক্তব মিডিয়া’য় গত বছরে এক উপসম্পাদকীয়তে সমাজকর্মী ও সাংবাদিক শার্জিল ইমাম আনুপাতিক হারের ভিত্তিতে মুসলমান জনপ্রতিনিধি ভারতের পার্লামেন্টে পাঠানোর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছিলেন।
পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, আগামী দিনে যখন কেন্দ্রীয় স্তরে ভোটার বৃদ্ধির কারণে নতুন করে নির্বাচনী কেন্দ্র ভাগ হবে (ডিলিমিটেশন), তখন মুসলমান প্রতিনিধিত্ব আরও কমবে।
দিল্লির গবেষক আসিফ মুজতবাকে উদ্ধৃত করে ‘মক্তব মিডিয়া’ই সম্প্রতি জানিয়েছে, এ মুহূর্তে যে আসনে মুসলমান জনসংখ্যা ও ভোটার বেশি রয়েছে, সেই আসন পরবর্তী সময়ে তফসিলি জাতি ও উপজাতির জন্য সংরক্ষিত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ডিলিমিটেশনের কারণে।
পর্যবেক্ষকদের মতে, এ ঘটনা সম্প্রতি ঘটেছে আসামে। ফলে, ভবিষ্যতে ভারতে বিজেপি হারতে বা জিততেও পারে, কিন্তু পার্লামেন্টে মুসলমান প্রতিনিধিত্ব যে কমবে, তা নিয়ে বিশেষ সন্দেহ পর্যবেক্ষকদের নেই।
বিজেপি এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাক বা না পাক, এটা যদি হিন্দুত্ববাদের বিজয় না হয়, তাহলে কী?
শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা