কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ–সহিংস পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) সন্ধ্যার পর থেকে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু করা হয়। এ কয়দিনের প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার সম্পাদকীয়, লেখা ও সাক্ষাৎকার ধাপে ধাপে অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। সোমবার (২২ জুলাই ২০২৪) এ লেখা ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
খবরের কাগজ প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাওয়া যায় না। আমি যেখানে থাকি, সেখানে এখন খবরের কাগজ পাই না। ইন্টারনেট বন্ধ। টেলিভিশনে যে সংবাদ দেখি, সেগুলো অনেকটা নিয়ন্ত্রিত বলে মনে হয়। আসল পরিস্থিতিটা বুঝতে পারছি না।
শুরুটা হয়েছিল নিরীহ একটা আন্দোলন দিয়ে। ২০১৮ সালেও একবার কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল। তখন ছাত্রদের দমন করতে ছাত্রলীগের হেলমেট বাহিনীকে পথে নামতে দেখেছি। সে বছরে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন দমনেও হেলমেট বাহিনী নেমেছিল। তারা ছাত্রদের, সাংবাদিকদের পিটিয়েছিল। এই হেলমেট বাহিনী কারা, সেটা সবাই জানে। এবারও আমরা একই ঘটনা দেখলাম।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ছাত্রদের প্রথম কয়েক দিনের আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত উক্তিকে কেন্দ্র করে ছাত্ররা বিক্ষুব্ধ হলো। মধ্যরাতে হলগুলো থেকে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ করল।
এরপর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগ প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিলেন। এরপরই আমরা দেখলাম ছাত্রলীগ, যুবলীগ শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করল। পিটিয়ে ছাত্রদের আহত করল।
এখনকার ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে অনেকেই ছাত্র নয়। তারা অনেকে জোর করে ক্যানটিনে খায়, তারা রুম দখল করে রাখে। সাধারণ ছাত্রদের গণরুম নামের একটা জেলখানায় থাকতে বাধ্য করে। মিছিল–মিটিংয়ে না গেলে পেটায়।
এগুলো তো বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে। কোটা সংস্কার তো একটা উপলক্ষ, ছাত্রদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের কারণেই আন্দোলনটা এত বড় হয়েছে। সেই ক্ষোভ থেকেই ছাত্ররা বেরিয়ে এল। হেলমেট বাহিনী তাদের পেটাল। আন্দোলন ক্যাম্পাসের বাইরে চলে এল। আন্দোলন যাঁরা করছিলেন, তাঁদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ সেখানে সম্পৃক্ত হয়ে গেল।
অনেকে বলছেন যে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছাত্র কোথায়? লুঙ্গি পরা লোকজন কেন আন্দোলনে আসছে? এ ধরনের প্রশ্ন উদ্দেশ্যমূলক। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ তো লুঙ্গি পরে। রিকশাওয়ালা, মুটে, মজুর, দোকানদার, পরিবহনশ্রমিক—সব ধরনের লোকই আন্দোলনে নেমে গেছেন। দীর্ঘদিনের অনাচার, দুর্নীতি, শোষণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে তাঁরা নেমেছেন। এখন আর আন্দোলনটা ছাত্রদের হাতে নেই। আমরা এর আগে সব আন্দোলনেই এ রকমটা দেখেছি।
’৯১ সাল থেকেই আমরা দেখতে শুরু করলাম গণতন্ত্রের রূপটা আসলে কেমন! বিএনপি ক্ষমতায় এল। দুই বছর যেতে না যেতেই আওয়ামী লীগ, জামায়াত মিলে গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর শুরু করল। এরপর ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিএনপি ও জামায়াত মিলে গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর শুরু করে দিল। এভাবেই এ দেশের রাজনীতি চলছে।
আন্দোলনে জ্বালাও–পোড়াও, ভাঙচুর এ দেশে সব সময়ই হয়ে আসছে। এরশাদের আমলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম দলগুলো ও জামায়াতে ইসলামী সবাই মিলেঝুলে কত গাড়ি পুড়িয়েছে, কত ভবনে আগুন দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। কেন করেছে তারা এগুলো? তারা মনে করেছে গাড়ি পোড়ালে, ভবনে আগুন দিলে দেশে গণতন্ত্র আসবে।
’৯১ সাল থেকেই আমরা দেখতে শুরু করলাম গণতন্ত্রের রূপটা আসলে কেমন! বিএনপি ক্ষমতায় এল। দুই বছর যেতে না যেতেই আওয়ামী লীগ, জামায়াত মিলে গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর শুরু করল। এরপর ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে বিএনপি ও জামায়াত মিলে গাড়ি পোড়ানো, ভাঙচুর শুরু করে দিল। এভাবেই এ দেশের রাজনীতি চলছে।
আন্দোলন হলেই মানুষ গাড়ি পোড়ায়, ভাঙচুর করে। এর একটা কারণ হলো নানা বিষয় নিয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ থাকে। আবার আন্দোলনের মধ্যে নানা মতলববাজ গোষ্ঠী ঢুকে যায়। মতলববাজদের মধ্যে যেমন রাজনৈতিক দল থাকে, আবার বিভিন্ন সংস্থার লোকও থাকে। তারা ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে।
এবারের আন্দোলনেও অনেকগুলো সরকারি স্থাপনায় আগুন দেওয়া হয়েছে। অনেক গাড়ি পোড়ানো হয়েছে। জনগণের এসব সম্পত্তির রক্ষক সরকার। কিন্তু তারা সেটা রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ধরনের জ্বালাও-পোড়াও থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে, ক্ষমতাসীনদের আচার-আচরণে সংযত হওয়া।
১৯৬৯ সালে পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও বামপন্থী কর্মী আসাদ নিহত হওয়ার পর গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল। পুলিশ কিন্তু খুব কাছ থেকে আসাদকে গুলি করেছিল। সেই পুলিশের কিন্তু বিচার হয়নি। আসাদকে যিনি গুলি করেছিলেন, তিনি বাঙালি পুলিশ।
এরপর ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় একটা গণবিস্ফোরণ হয়েছিল। তিন–চারজন মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছিল, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান যে গেস্টহাউসে ছিলেন, সেখানে আগুন দেওয়া হয়েছিল, দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ–এর অফিসে আগুন দেওয়া হয়েছিল। এর সবই ছিল ছাত্র-জনতার পুঞ্জীভূত ক্ষোভের প্রকাশ। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনাবলিকে পরবর্তীকালে আমাদের রাজনীতিবিদেরা গৌরবান্বিত করেছেন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে ষড়যন্ত্র হচ্ছে—এমনটাই বলছে সরকার। ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে সরকার পরিচালনা করছে আওয়ামী লীগ। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা তাদের হাতে। তাহলে ষড়যন্ত্রটা তারা কেন আগে থেকে ধরতে পারে না? প্রকৃতপক্ষে আমরা একটা স্থূল রাজনৈতিক লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে গেছি। তার কারণ হচ্ছে, ১৫ বছর ধরে দেশে সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন হয়নি। সরকারের বিরুদ্ধে তাই লোকের ক্ষোভ থাকবেই। রাজনৈতিক দলগুলোও উপলক্ষ খুঁজবে আন্দোলন করার।
আন্দোলনে পুলিশ নির্বিচার কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ছুড়েছে, গুলি করেছে। গুলি, কাঁদানে গ্যাসের শেল, সাউন্ড গ্রেনেড—এগুলো কাদের টাকায় কেনা? জনগণের ট্যাক্সের টাকায় সেগুলো কেনা। আওয়ামী লীগ কি ভুলে গেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের সেই কথা, ‘আমার জনগণের টাকায় অস্ত্র কেনা হয়, সেই অস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়, আমার জনগণের বুকের ওপরে?’
গত কয়েক দিনে নির্বিচার গুলি করে মানুষ হত্যা করা হয়েছে। দেড় শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন, যদিও এটা পূর্ণাঙ্গ তথ্য নয়। একদিন না একদিন এটা নিয়ে কথা উঠবে। তদন্ত হবে, বিচার হবে।
মানুষ যে রাস্তায় নেমে এসেছে, ধ্বংসাত্মক কাজ করেছে, এগুলো তাদের কারা শিখিয়েছে? আমাদের রাজনীতিবিদেরাই সেটা শিখিয়েছেন। গাড়ি পোড়ানো, ভবনে আগুন দেওয়া, এটাই তো আমাদের এখানে রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। সরকারে থাকা আওয়ামী লীগ কোনো দিন বিরোধী দলে গেলে তারাও এটাই করবে। সরকার বলছে, দুর্বৃত্তদের ঠেকাতে ইন্টারনেট বন্ধ করেছে। কিন্তু দেশের লাখ লাখ মানুষ রুটিরুজির জন্য ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল। তাদের কথা সরকার কি বিবেচনা করেছে?
আমরা একটা অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমরা কেউ জানি না পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে। মানুষের রুজিরোজগার বন্ধ হয়ে গেছে। একদিক থেকে আন্দোলনকারীরা কমপ্লিট শাটডাউনের কথা বলছেন। আর সরকার দিয়েছে কারফিউ। ফলে দুই দিক থেকেই সবকিছু বন্ধ। এর মধ্যেই বিক্ষিপ্ত সংঘাত, গোলাগুলি চলছে।
সরকার যদি আক্রমণাত্মক ভূমিকা থেকে সরে না আসে, তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। সরকার, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, পুলিশ, র্যাব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী খুব বাড়াবাড়ি করেছে। কী এমন পরিস্থিতি তৈরি হলো যে রংপুরে আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে মেরে ফেলা হবে? এ সব কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন ও উসকানিমূলক কাজ।
আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ফসল ছিনতাই হয়ে গেছে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়নি। গণতন্ত্র আসেনি।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক