তেল-গ্যাস নিয়ে কথা বলা নিষেধ, মুচলেকা দিন

‘বর্ষাকালে বৃষ্টি নাই। ধানখেতে ধানের চারা শুকিয়ে মারা যাচ্ছ। কৃষকেরা হাহুতাশ করছেন। এখন তাঁরা কী করতে পারেন?’

‘এখন তাঁরা কী করবেন, এটা তাঁরা ভালো জানেন। রবীন্দ্রনাথের “জুতা আবিষ্কার” কবিতা থেকে আমরা শিক্ষা পাই, বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান স্থানীয় মানুষেরাই ভালো জানেন। পণ্ডিতেরা এই সব সমস্যার সমাধান ঠিকঠাক দিতে পারেন না। রাজা বলেছিলেন, তাই যদি না হবে, পণ্ডিতেরা রয়েছে কেন তবে? কিন্তু বাস্তবে পণ্ডিতেরা সবকিছু পণ্ড করেন। আর চর্মকার সমস্যার সমাধান করে দেখাতে পারেন। কৃষকই বলুন না, তারা এখন কী করবেন?’

‘তারা বলছেন, তারা সেচ দেবেন। ধানখেতে পানি সেচতে হবে।’

‘তাহলে তারা পানি সেচের ব্যবস্থা করুক।’

‘সে জন্য তারা পাম্প বসাচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা আছে?’

‘কী সমস্যা?’

‘লোডশেডিং। যদিও বলা হচ্ছে, এক ঘণ্টা লোডশেডিং হবে, গ্রামে-গঞ্জে আসলে লোডশেডিং হচ্ছে অনেক বেশি।’

‘তাহলে তো মুশকিল। সে সমস্যার সমাধান কৃষকেরা কীভাবে করছেন?’

‘তারা ডিজেলচালিত পাম্প বসাচ্ছেন।’

‘এই রে। আবার ডিজেল। আমাদের দেশে তো আমরা এখন ডিজেল কম খরচ করার পলিসি নিয়েছি। এখন যদি ডিজেলই খরচ হলো, তাহলে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করেই-বা রাখা কেন?’

‘সে তো আপনাদের মতো নীতিনির্ধারকদের ভাবার বিষয়। আপাতত কৃষকেরা কাঁদছেন। কারণ, ধানের চারা হচ্ছে তাঁদের সন্তানের মতো। সন্তানকে নিজের চোখের সামনে মারা যেতে দেখলে একজন মায়ের যেমন অকথ্য যন্ত্রণা হয়, কৃষকেরাও এখন সেই যন্ত্রণায় ভুগছেন।’

‘কিন্তু এই না বন্যা হয়ে গেল। আর সে জন্য না উজানে অতিবৃষ্টি দায়ী।’

‘ঠিক। বন্যা হলো। বন্যাতেও খেতের ফসল নষ্ট হয়েছে। মাছের ঘের নষ্ট হয়েছে। এখন আবার চলছে খরা।’

‘এর জন্য দায়ী ক্লাইমেট চেঞ্জ। জলবায়ুর পরিবর্তন। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। দুনিয়া গরম হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবী পুড়ছে। জার্মানি পুড়ছে, স্পেন পুড়ছে, আমেরিকা পুড়ছে। দাবানল হচ্ছে। বন্যা হচ্ছে, খরা হচ্ছে, সাইক্লোন হচ্ছে। সব হবে উল্টাপাল্টা।’

‘তো পৃথিবীর গরম হওয়া রোধ করতে আমরা কী করতে পারি?’

‘আমরা কার্বন নিঃসরণ কমাতে পারি। সে জন্য কয়লার বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে হবে। তেলের বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করতে হবে।’

‘কিন্তু জার্মানির মতো দেশ তো আবার কয়লার বিদ্যুৎকেন্দ্রে ফিরে যাচ্ছে।’

‘যাচ্ছে। কারণ, রাশিয়া তাদেরকে জ্বালানি সরবরাহ গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।’

‘তাহলে তারা যদি আবার কয়লাযুগে ফিরে যেতে চায়, আমরা কী করব।’

‘আমরাও তো রামপাল আর পায়রার মতো কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আছি। এই সুযোগে আমাদের রামপাল আর পায়রার বিষয়ে আপত্তি পানি হয়ে যাবে।’

‘তাহলে এটাকে সুযোগ বলছেন?’

‘লোকে আপনাকে বাঁশ দিলে কী করবেন? হয় পান্ডার মতো বাঁশ খাবেন, না হলে বাঁশ দিয়ে বেড়া বানাবেন, কুলা-ডালা বানাবেন।’

‘তাহলে অক্টোবর থেকে দেশে আর লোডশেডিং থাকছে না?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী করে বলছেন? ওয়াকিবহাল মহল তো বলছেন, সেপ্টেম্বর থেকে রামপাল পায়রার বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে আসবে না।’

‘আসলে অক্টোবরে গরম কমে আসবে। তখন বিদ্যুতের চাহিদা কমবে। আপনি কি ওই কৌতুকটা জানেন: ভাই আমি কি বিয়ে করব? বিয়ে করলে আমি কি সুখী হব? বিয়ে করে ফেলো। প্রথম প্রথম একটু খিটিমিটি লাগবে। তারপর অভ্যাস হয়ে যাবে? আসলে অক্টোবর আসতে আসতে লোডশেডিংয়ে আমরা অভ্যস্ত হয়ে যাব।’

‘আচ্ছা আচ্ছা। ডলারের দামটা বেশি কেন?’

‘ওই যে যুদ্ধ। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে তেলের দাম বেড়ে গেছে। তেলের দাম বেশি হওয়ায় দেশের ডলারে টান পড়েছে। ডলারে টান পড়ায় খোলাবাজারে ডলারের দাম ব্যাংকের চেয়ে বেশি। তাই প্রবাসীরা আর ব্যাংকে ডলার পাঠাচ্ছেন না। ফলে আবার ডলার কমে যাচ্ছে। এটা একটা চক্র। একবার বাজার আর ব্যাংকের রেট সমান হয়ে গেলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। প্রবাসীরা আবার ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার পাঠাবেন। তখন আর সমস্যা থাকবে না।’

‘সেটা কীভাবে হবে?’

আরও পড়ুন

‘আইএমএফের কাছে লোন চাওয়া হয়েছে। ওটা পাওয়া গেলে রাতারাতি সমাধান হয়ে যাবে। বাজারে একবার ডলারের প্রবাহ ভালো হলেই দেখবেন সব ঠিক।’
‘ওটা যদি না পাওয়া যায়? শর্ত যদি কঠিন হয়?’

‘পাওয়া যাবে না কেন। ওরা আমাদের লোন দেওয়ার জন্য পেছনে পেছনে ঘুরছে। আমরাই নিচ্ছি না। আমার কথা না। অর্থমন্ত্রীর কথা।’

‘তো আমরা নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধান না করে তেলের ওপর এত নির্ভরশীল হলাম কেন?’

‘আপনি তো লোকটা জটিল আছেন? সারাক্ষণ টেলিভিশনের টক শো দেখেন নাকি?’
‘জি, তা দেখি। ওরা বলেন, জ্বালানি সেক্টরে বিদ্যুৎ খাতে হরিলুট হয়েছে। কথা কি ঠিক?’
‘আপনার কাছে প্রমাণ আছে?’

‘প্রমাণ? আমার কাছে? আমি সামান্য কেরানিমাত্র। এর প্রমাণ আমার কাছে কোত্থেকে আসবে? আপনারা নীতিনির্ধারক, প্রমাণ আপনারা রাখবেন বা গোপন করবেন। আমি তো এসবের মধ্যে নাই।’

‘তাহলে এখতিয়ারের বাইরে কথা বলবেন না। হিরো আলমের নজরুলসংগীত রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া নিষেধ, জানেন তো? আপনারও তেল-গ্যাস নিয়ে কথা বলা নিষেধ। নিন। মুচলেকা দিন।’

‘তা দিচ্ছি। আচ্ছা বাজেটে অর্থমন্ত্রী যে পাচার হওয়া ডলার দেশে আনার উদ্যোগ নিলেন, তাতে কি কোনো ফল ফলল? শোনা যাচ্ছে সুইস ব্যাংকে নাকি বাংলাদেশিদের টাকা আরও গেছে?’

‘আপনি কি সুইস ব্যাংকের খবরও রাখেন। আপনি তো মশায় ডেঞ্জারাস। আপনি বললেন আপনি কেরানি। আপনি কোন অফিসের কেরানি?’

‘আমাদের জিনজার ড্রিংকসের কোম্পানি। আদা দিয়ে আমাদের কোম্পানি পানীয় বানায়।’

‘পারফেক্ট। আপনি আমাদের বরং জাহাজের খবর দিন। বলেন ভারত থেকে ক্রুড অয়েল আসার কথা। কত দূর এল?’

‘তা জানি না। তবে বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমার কথা। তেমনটা কমেনি। তা বলতে পারি।’
‘কেন কমেনি?’

‘কারণ, তেল দেওয়া তো কমেনি। ওরা আমাদের বাঁশ দিচ্ছেন। আর আমরা তেল দিয়েই চলেছি। এই হলো হিসাব। বুঝলেন?’

‘না। আর বুঝতে চাই না। খোদা হাফেজ।’

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক