তাঁরা দুজন মিলে এক অদ্ভুত জুটি তৈরি করেছেন। একজনের মুখ হাস্যোজ্জ্বল ও নিটল। পাতলা ঠোঁটের অন্য মুখটি অনেক বেশি শীতল ও রূঢ়।
দুজনই স্বৈরশাসক। দুজনই নৃশংস। দুজনই নিজেদের খামখেয়ালি কাজকারবারের জন্য কাউকে কৈফিয়ত দেন না। দুজনই যুক্তরাষ্ট্রকে ১৯৪৫-পরবর্তী বিশ্বব্যবস্থার মোড়ল হিসেবে দেখেন এবং দুজনই যুক্তরাষ্ট্রকে খারিজ করে দিয়ে বিদ্যমান বিশ্ব ব্যবস্থাকে উল্টে ফেলার মিশন নিয়ে জীবন বাজি রেখেছেন। সর্বোপরি দুজনই পশ্চিমের দেশগুলো দ্বারা নিষিদ্ধ, বহিষ্কৃত এবং কিছুটা হলেও ভীত।
পিয়ংইয়ংয়ে এই ‘লরেল অ্যান্ড হার্ডি’ (হলিউড সিনেমার প্রাথমিক যুগের ব্রিটিশ-আমেরিকান কমেডি জুটি। এই জুটির একজন হলেন ইংরেজ অভিনেতা স্ট্যান লরেল এবং অন্যজন হলেন আমেরিকান অভিনেতা অলিভার হার্ডি) জুটির মধ্যে যে শীর্ষ সম্মেলন হয়ে গেল, তারপর সেসব ভয় প্রতীকী ও সারগর্ভ উভয় অর্থেই আরও তীব্র হতে পারে।
উত্তর কোরিয়ার নাদুসনুদুস চেহারার নেতা কিম জং-উন ও রাশিয়ার চর্মসার গড়নের নেতা ভ্লাদিমির পুতিনের একটি অভিন্ন লক্ষ্য রয়েছে। সেটি হলো, চীন থেকে ইরান পর্যন্ত বিস্তৃত একটি শক্তিশালী পশ্চিমাবিরোধী ও গণতন্ত্রবিরোধী জোটে তাঁদের অবস্থান সুসংহত করা।
দুই বছর আগে ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক অভিযান শুরু হওয়ার আগে বেশির ভাগ বিশ্বনেতার মতো পুতিনও কিমের দিকে খুব কমই মনোযোগ দিয়েছেন। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে সব বদলে গেল।
পুতিনের এই সফর কিমের জন্য পুতিনের একটি উপহার ছিল। আন্তর্জাতিক কূটনীতি সম্পর্কে কিমের ধারণা হলো, প্রভাব–প্রতিপত্তি অর্জনের জন্য হুমকি দিয়ে যেতে হবে (যে হুমকি দেওয়ার যথার্থ সামর্থ্য তাঁর নেই)। তাঁর সক্ষমতার দৌড় যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলে (এবং দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানে) আঘাত করতে সক্ষম পারমাণবিক ওয়ারহেড বহনসক্ষম দূরপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পরীক্ষা চালানো এবং সীমিত পরিসরের পারমাণবিক বোমা বানানোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্যন্ত।
২০১৯ সালে হ্যানয়ে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কিম বৈঠক করেছিলেন। ওই বৈঠকের সূত্র ধরে ওয়াশিংটন ও তাদের অংশীদারদের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ, উত্তর কোরিয়ার ওপর থেকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং কোরীয় উপদ্বীপের পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের বিষয়ে যে শম্বুকগতির আলোচনা শুরু হয়েছিল, তা ভেঙে পড়ায় কিম তাঁর কৌশল পরিবর্তন করেন। তিনি মস্কো-বেইজিং অক্ষে সম্পূর্ণরূপে জড়িয়ে পড়েন এবং এর ধারাবাহিকতায় এখন তিনি ইউক্রেন যুদ্ধে পুতিনকে সমর্থন দিচ্ছেন।
২০২২ সালের জুলাই মাসে উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার দখল করে নেওয়া দোনেৎস্ক ও লুহানস্কের রুশপন্থী প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার ভাষ্যমতে, কিম রাশিয়াকে ইতিমধ্যে কয়েক ডজন ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করেছে, যার কয়েকটির ধ্বংসাবশেষ ইউক্রেনের খারকিভে পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কিম লাখ লাখ কামানের গোলাবোঝাই ১১ হাজারের বেশি কনটেইনার রাশিয়াকে দিয়েছে।
পশ্চিমাদের ধারণা, এর বিনিময়ে পুতিন কিমকে পারমাণবিক, ক্ষেপণাস্ত্র ও মহাকাশপ্রযুক্তি উন্নত করতে সাহায্য করছেন।
পুতিন যদিও স্বীকার করবেন না, কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন এবং তাঁর দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। রাশিয়ার দরিদ্র উত্তর কোরিয়ার সমর্থনের প্রয়োজন আছে, এই ধারণাকে বছর কয়েক আগেও সবাই হেসে উড়িয়ে দিত। কিন্তু এখন আর সে বাস্তবতা নেই।
রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার এই ক্রমবর্ধমান সম্পর্ক অস্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি মারণঘাতী। উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে পুতিন লিখেছেন, ‘আমরা বাণিজ্যের এমন এক বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তুলব, যাতে পশ্চিমাদের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না এবং আমরা যৌথভাবে পশ্চিমাদের অবৈধ একতরফা নিষেধাজ্ঞা প্রতিরোধ করব।’ তিনি লিখেছেন, ‘একই সঙ্গে আমরা ইউরেশিয়ায় মার্কিন চাপ, ব্ল্যাকমেল ও সামরিক হুমকিকে প্রতিহত করার মতো নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলব।’
২০২২ সাল থেকে নিষেধাজ্ঞা তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া রাশিয়ার একটি বিশেষত্ব হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রেও কিমের সঙ্গে পুতিনের বৈঠক বাস্তবসম্মত সহায়তা দিচ্ছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে বছরের পর বছর ধরে পিয়ংইয়ংয়ের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাকে রাশিয়া সমর্থন করে এলেও ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে তারা উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা নেওয়ায় ভেটো দেওয়া শুরু করেছে। এখন পুতিন ও কিম ‘হাতে হাত রেখে কমরেডের অটুট সম্পর্ক’ লালন করছেন।
পুতিন সম্ভবত কিমের সঙ্গে এই ঘনিষ্ঠতাকে খুব বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল বলে মনে করছেন। প্রকৃতপক্ষে তাঁর এই পিয়ংইয়ং রাজনীতি তাঁর শক্তিক্ষয় ও হতাশার প্রতিফলন ঘটায়। গত সপ্তাহে সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে ভারত, ব্রাজিল, সৌদি আরব ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো কিছু বড় দেশ ইউক্রেনের পক্ষেই কথা বলেছে এবং সে সম্মেলনে এ বিষয়ে সবাই একমত ছিল যে রাশিয়া অবৈধভাবে ইউক্রেনের দিকে পা বাড়িয়েছে এবং সেখান থেকে তার সরে আসা উচিত।
পুতিন যদিও স্বীকার করবেন না, কিন্তু বাস্তবতা হলো, তিনি কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন এবং তাঁর দেশ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির মধ্যে রয়েছে। রাশিয়ার দরিদ্র উত্তর কোরিয়ার সমর্থনের প্রয়োজন আছে, এই ধারণাকে বছর কয়েক আগেও সবাই হেসে উড়িয়ে দিত। কিন্তু এখন আর সে বাস্তবতা নেই।
এখন এটি প্রমাণিত সত্য যে রাশিয়াকে আমদানি করা কামানের শেলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অর্থাৎ রাশিয়ার অস্ত্রশিল্প দুর্বল হয়ে পড়েছে।
পূর্ব এশিয়ায় পুতিনের প্রভাব কমে যাওয়ার আরও একটি নজির হলো, তাঁর ‘সীমাহীন বন্ধুত্বের বন্ধনে’ থাকা চীনের মস্কো–সংক্রান্ত সন্দিহানসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি।
ঐতিহাসিকভাবে বেইজিং পারমাণবিক হুমকির কারণে তার অস্থিতিশীল প্রতিবেশীদের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক জারি রাখে। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেও চীনের নীতি বদলাবে না। এ কারণে রাশিয়ার সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার ঘনিষ্ঠতাকে চীন ভালোভাবে নেবে না। ফলে পুতিন ও কিমের বৈঠক বেইজিং ও মস্কোর সম্পর্কে দাগ ফেলতে পারে।
এ ছাড়া চীন ভালো করেই জানে যে রাশিয়ার সঙ্গে তার এখন যে সুসম্পর্ক আছে, তা চিরস্থায়ী হবে না। পারমাণবিক শক্তিধর রাশিয়া একসময় তার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
সিমোন টিসডাল অবজারভারের পররাষ্ট্রবিষয়ক ভাষ্যকার