‘এই যে রাস্তাটা দেখতেছেন, এখানে কেউ হাঁটতে পারত না। রমজান ডাকাইতের ১৫-২০ জনের দল ছিল। ভারতে ছিল তার বাড়ি। তাদের অনেক অস্ত্র ছিল। তখন এখানে মাত্র কয়েক ঘর লোক বাস করত। রাতে সোজা ভারতে চলে যাইত, ডাকাতি করি ভোরবেলা চলি আসত। আমাদের ছিটমহলের বড় খাসি-গরু এমনকি মুরগিও ধরি নিয়ে যাইত ডাকাইতেরা।’ কথাগুলো বলছিলেন লালমনিরহাটের পাটগ্রামের সাবেক ভারতীয় ভোটবাড়ি ছিলমহলের নেতা বদির উদ্দিন। পাশেই থাকা বয়স্ক ব্যক্তি যুক্ত করে বলেন, ‘ছিটের বাইরে গরু-ছাগল গেলে কতজন ধরি নিয়া যাইত। আর দিত না। রমজান ডাকাইত ভারত থাকি আসি জোর করি জহরের বাড়িত আশ্রয় নিছিল। একদিন ওই জহরকেও ডাকাইত দল মারি ফেলায়। এটার কোনো বিচার হয় নাই।’ গত সপ্তাহে লালমনিরহাটের ভোটবাড়ি, লোতামারী, পানিশালাসহ কয়েকটি বিলুপ্ত ছিটমহল সরেজমিন পরিদর্শনকালে অনেকের সঙ্গে কথা হয়। বিলুপ্ত হয়েছে ছিটমহল, মুছে গেছে প্রতিদিনের কষ্টের রেখা। কেবল স্মৃতিতে দগদগে ক্ষত।
অসংখ্য দুঃসহ ঘটনা ছিল সাবেক ছিটমহলবাসীর জীবনে। এখন তাঁরা অভিন্ন সুরে জানালেন তঁাদের ভালো থাকার কথা। ভোটবাড়িতে দেখলাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্থান, নিম্নমাধ্যমিক স্কুল আর পুলিশ ক্যাম্পের নির্ধারিত স্থানের সাইনবোর্ড। আমাকে মোটরসাইকেলে নিয়ে বিলুপ্ত বিভিন্ন ছিটমহল দেখাচ্ছিলেন সাবেক বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটির লালমনিরহাট জেলা সভাপতি হাফিজুর রহমান। ভোটবাড়ি থেকে পানিশালার দিকে যেতে যেতে তিনি বলছিলেন, ‘এই যে আমরা পাকা সড়ক দিয়ে যাচ্ছি, এটা সাবেক ছিটমহলের জন্য করা। ছিটমহল বিনিময় হওয়ার পর এখানে ছিটমহলের সংযোগ সব রাস্তাই পাকা হয়েছে।’ ছিটমহলে বেশ কিছু পাকা করা বাড়ি চোখে পড়ল। হাফিজুর রহমান জানালেন, আগে টাকা থাকলেও মানুষ বাড়ি করত না। বাড়ি করলেই ডাকাতের চোখে পড়তে হতো। সে জন্য তারা ছনের ঘর করে থাকত।
পানিশালায় প্রবেশ করতেই ছোট একটি নদ চোখে পড়ল। এ নদ বাংলাদেশ থেকে আলাদা করেছিল সাবেক ছিটমহলটিকে। এখন সেই খেংটি নদে সেতু হয়েছে। সেখানে দেখা হলো দুজনের সঙ্গে। একজন গরু নিয়ে যাচ্ছেন, আরেকজনের হাতে মাছ ধরার জাল। এখন তাঁরা কেমন আছেন জিজ্ঞাসা করতেই তাঁদের চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। জব্বার আলী বললেন,Ñ‘পুল-পাকা রাস্তা আগে আছলো না। অ্যালা হইচে। অ্যালা হামরা খুব ভালো আছি।’
লালমনিরহাটের সাবেক লোতামারী ছিটমহলে কথা হয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন সুবিধাসহ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সবগুলোর শতভাগ সেখানে দেওয়া হয়। চিকিৎসা, যোগাযোগ সবকিছুরই ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দির হয়েছে অনেক। দূর হয়েছে ছিটমহলবাসীর মিথ্যার আলেখ্য। সাবেক ছিটমহলবাসীকে ২০১৫ সালের ১ আগস্টের আগে সবকিছুতে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হতো। বিয়ে, হজের পাসপোর্ট, চিকিৎসা, পড়ালেখা সবকিছুর জন্য মিথ্যা ঠিকানা দিতে হতো।
বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে চাকরি করেন আবদুল আলীম। তঁার বাড়ি ছিল ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের কুড়িগ্রামের বাকালির ছড়া ছিটমহলে। তিনি যখন ছোট ছিলেন, তখন শামুকে তাঁর পা কেটে গিয়েছিল। ভারতে কোথাও কোনো চিকিৎসক দেখাতে পারেননি। পরে তাঁর বাবা পঞ্চায়েতকে ঘুষ দিয়ে একজন হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। এর কয়েক দিন পর তঁার ছোট বোনের মুখ পুড়ে যায়, কিন্তু চিকিৎসা পায়নি। এ রকম অবস্থায় তাঁর বাবা ইউসুফ আলী ভারতের অভ্যন্তরে থাকা তঁাদের সব সম্পত্তি নামমাত্র বিনিময়ে বাংলাদেশ এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আবদুল আলীম সম্প্রতি আমাকে জানিয়েছেন, যেদিন ছিটমহল বিনিময় হয়, সেদিন তঁার মা আনন্দে কেঁদেছেন।
ছিটমহল সমস্যা দূরীকরণে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নেতৃত্বদানকারী ভারত অংশে দীপক সেনগুপ্ত, দীপ্তিমান সেনগুপ্ত এবং বাংলাদেশ অংশে মইনুল হক, গোলাম মোস্তফা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। মইনুল হক বলেন, ‘আমরা যে অমানবিক পরিশ্রম করেছি, ছিটমহলবাসীর জন্য তা সার্থক হয়েছে।’
ছিটমহল হলো পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরে থাকা পার্শ্ববর্তী দেশের ছোট ভূমি, যা অপর দেশের সীমানা দ্বারা সম্পূর্ণ বেষ্টিত। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ছিল ১১১টি ছিটমহল। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ছিল ৫৩টি ছিটমহল। ১৯৭৪ সালের ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির আলোকে দক্ষিণ বেরুবাড়ি ভারতকে দেওয়া হয়। বিনিময়ে তারা তিন বিঘা করিডর দিয়েছে। দহগ্রাম–আঙ্গরপোতা ছিটমহল এবং বেরুবাড়ি ছিটমহলের অভিশাপ দূর হয়েছে আগেই। অবশিষ্ট বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতীয় ১১১টি ছিটমহলের ভূমির পরিমাণ ছিল ১৭ হাজার ১৬০ দশমিক ৬৩ একর। মানুষ ছিল ৩৭ হাজার ৩৬৯ জন। ভারতের অভ্যন্তরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের আয়তন ৭ হাজার ১১০ দশমিক ২০ একর। এখানে মানুষ ছিল ১৪ হাজার ২১৫ জন।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-ভারত দেশবিভাগ হওয়ার সময় তৎকালীন রংপুর জেলা এবং কোচবিহারের সীমানা চিহ্নিত করার সময় ছিটমহলগুলো আমলে নেওয়া হয়নি। প্রথমে ছিটমহল সমস্যা ছিল পাকিস্তান-কোচবিহারের। কোচবিহার ছিল ব্রিটিশদের করদ রাজ্য। ১৯৪৯ সালে কোচবিহার ভারতের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে এ সমস্যা হয়ে ওঠে পাকিস্তান-ভারত ছিটমহল সমস্যা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এ সমস্যা হয়ে ওঠে বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল সমস্যা। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নূন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মধ্যে ১৯৫৮ সালে ছিটমহল সমস্যা দূরীকরণের জন্য চুক্তি করা হয়েছিল। সেটি বাস্তবায়িত হয়নি।
১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে সীমানা নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী ২০১৫ সালে বাংলাদেশ-ভারত ১৬২টি ছিটমহল বিনিময় হয়েছে। এরপর থেকে ছিটমহলবাসীর জীবনে নেমে এসেছে মুক্তির স্বাদ। দেশবিভাগের সময় ব্রিটিশ বিদায় কিংবা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় তাদের বিজয়ের আনন্দ দিতে পারেনি। ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে, অর্থাৎ আগস্টের ১ তারিখ ছিটমহল বিনিময় কার্যকর হয়। প্রতিবছরের মতো এ বছরও ছিটমহলগুলোতে এদিন উদ্যাপিত হচ্ছে মুক্তিদিবস। দীর্ঘ ৬৮ বছরের অবরুদ্ধ জীবনের অবসানই ছিল তাদের এ মুক্তি।
ছিটমহল সমস্যা দূরীকরণে গড়ে ওঠা বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। নেতৃত্বদানকারী ভারত অংশে দীপক সেনগুপ্ত, দীপ্তিমান সেনগুপ্ত এবং বাংলাদেশ অংশে মইনুল হক, গোলাম মোস্তফা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। মইনুল হক বলেন, ‘আমরা যে অমানবিক পরিশ্রম করেছি, ছিটমহলবাসীর জন্য তা সার্থক হয়েছে।’ গোলাম মোস্তফা বলেন, ছিটমহলগুলোতে বিদ্যুৎ–সংযোগ, দ্রুত রাস্তা নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদানের অনুমতি, এমপিওভুক্তসহ অসংখ্য উন্নয়ন হয়েছে। উভয় দেশের সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ ছিটমহলবাসী মনে রাখবে।
● তুহিন ওয়াদুদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক