যুদ্ধের প্রথম শিকার হচ্ছে সত্য। যুদ্ধে লিপ্ত বিভিন্ন পক্ষ এবং তাদের সাঙাতেরা যুদ্ধের ময়দানে অস্ত্র নিয়ে লড়াই করার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্ব যার ওপর আরোপ করে থাকে, তা হলো সত্যকে বধ করা। কেননা, তা করতে পারলে যুদ্ধের ময়দানে ক্রমাগত পশ্চাদপসারণকেও নিজেদের নাগরিক আর অনুসারীদের সামনে বিজয় হিসেবে তুলে ধরা সম্ভব হবে না এবং নিশ্চিত পরাজয় ত্বরান্বিত হবে।
ঠিক এমনটাই এখন ঘটে চলেছে ইউক্রেনের যুদ্ধের ময়দানে, বিভ্রান্ত এক পক্ষ যেখানে সত্যকে মাটিচাপা দিয়ে রাখতে এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে দিনকে রাত বলে তুলে ধরতেও দ্বিধা করছে না তারা। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সাম্প্রতিক আচরণ অবশ্যই এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ নিয়ে আমাদের সামনে উপস্থিত। গত এক সপ্তাহে নিজ দলের বেশ কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকেই ভলোদিমির জেলেনস্কি কেবল চাকরিচ্যুত করেননি, তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগও তিনি উত্থাপন করছেন।
ইউক্রেনের এই বাস্তবতা আমাদের জার্মানিতে হিটলারের শেষ বছরটির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে, রাইখ ফ্যুরোর যখন চারদিকে শত্রুর উপস্থিতি দেখতে পেয়ে সবাইকে দোষারোপ করে চলছিলেন। যুদ্ধের মোড় নাটকীয়ভাবে ঘুরে গেলে সমরনায়কদের অবস্থা ঠিক সে রকম হয়ে দাঁড়ায়। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকেও এখন দেখা যাচ্ছে সেই একই পথে হাঁটতে। ফলে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় না গিয়ে এখন দেখা যাক বাক্স্বাধীনতা এবং মতামত প্রকাশের অধিকারের সবচেয়ে বড় রক্ষক হিসেবে দাবি করা পশ্চিম এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে কী করছে নিজের দেশের নাগরিকদের নিয়ে। কেননা, জেলেনস্কির মতোই পশ্চিমের অনেক দেশও এখন বাস্তবতা আঁচ করতে পারার বিভ্রান্তি থেকে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করেছে, ডুবন্ত মানুষের বিলাপের সঙ্গে সেটাকে সহজেই তুলনা করা যায়।
আলিনা লিপ হচ্ছেন জার্মানির একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। ইউক্রেনের দনবাসে অবস্থান করে সেখানকার পরিস্থিতি–সংক্রান্ত প্রতিবেদন জার্মানিসহ অন্য কয়েকটি দেশের মূলধারার বাইরের কিছু সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরা ছাড়াও নিজের ইউটিউব চ্যানেলেও তা তিনি সংযুক্ত করছেন। ‘মূলধারার বাইরে’র সংবাদমাধ্যম বাক্যটির ওপর এ কারণে আমি গুরুত্ব আরোপ করতে চাই যে, ইউক্রেনের যুদ্ধ আমাদের অনেকের চোখে ‘দেবতা’ হিসেবে গণ্য মূলধারার সংবাদমাধ্যমের আসল চেহারা উন্মোচন করে দিয়ে রীতিমতো নগ্ন অবস্থায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ইউক্রেন নিয়ে শুরু থেকে সব রকম বানোয়াট প্রচার ও সংবাদ পরিবেশন করার মধ্যে দিয়ে তারা সবাই দেখিয়ে দিয়েছে যে, স্বার্থের সংঘাত দেখা দেওয়ার সময় গুণগত সব রকম পার্থক্য তাদের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। আর এই মূলধারার সংবাদমাধ্যমের বস্ত্রহরণ করার মতো সাহসী ভূমিকা যাঁরা রেখে যাচ্ছেন, আলিনা লিপ হলেন সেই মুষ্টিমেয়দের দলের একজন।
যুদ্ধের একেবারে শুরুতেই মারিউপোলের মেয়র ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গিয়ে হাজার মাইল দূরে গিয়ে বসে আছেন এবং সেখান থেকে অসম্ভব শক্তিশালী কোনো দুরবিন চোখে লাগিয়ে পরিষ্কার দেখছেন কী ঘটে চলেছে সেসব জায়গায়। আর সেই বার্তাই সিএনএন, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান ও অন্যরা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়ে রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধের ‘প্রামাণ্য’ দলিল আমাদের সামনে হাজির করছে।
অন্যদিকে গ্রাহাম ফিলিপস হলেন ব্রিটিশ নাগরিক, ইউক্রেনের মারিউপোল থেকে যিনি নিয়মিতভাবে যুদ্ধের বাস্তব অবস্থার সচিত্র প্রতিবেদন ইউটিউবে সংযুক্ত করা ছাড়াও বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও প্রচার করছেন। এখন তিনি অবস্থান করছেন দনবাসে এবং সেখান থেকে জানাচ্ছেন দনবাসের স্থানীয় লোকজন কীভাবে দেখছেন যুদ্ধকে। গ্রাহাম এবং আলিনা—দুজনেই শীতল কক্ষের আরামকেদারায় বসে থেকে গোয়েন্দা সংস্থার সরবরাহ করে যাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সংবাদ প্রচারের দায়িত্ব পালন করে যাওয়া সাংবাদিক নন; বরং তাঁরা হলেন সেই সাংবাদিক, ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে সেখানে সত্যিকার অর্থে কী ঘটে চলেছে সেই বার্তা যাঁরা পৌঁছে দিচ্ছেন নিজেদের ভক্ত আর অনুসারীদের কাছে। বিনিময়ে বড় অঙ্কের কোনো রকম অর্থপ্রাপ্তি তাঁদের কপালে অবশ্যই জুটছে না, বরং যা তাঁরা পাচ্ছেন তা হলো, নিজ নিজ দেশের যুদ্ধবাজ সরকার আর প্রশাসনের তিরস্কার।
জার্মানির একটি আদালত সম্প্রতি আলিনা লিপকে রাষ্ট্রদ্রোহী ঘোষণা করে তার সব রকম সম্পদ জব্দের ঘোষণা দিয়েছে। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার দোহাই দিয়ে আমাদের মতো দেশে নিজেদের পোষ্য তৈরি করে নেওয়ার খেলায় দুই হাতে অর্থ বিলিয়ে যাওয়া দেশটি নিজের দেশের একজন সত্যভাষী নাগরিকের কণ্ঠ রোধ করতে এমন কোনো পদক্ষেপ নেই, যা কাজে লাগাচ্ছে না। আলিনার অনুপস্থিত বিচার যেভাবে করা হয়, ইংরেজি ভাষায় সেই প্রক্রিয়ার একটি নামকরণ করা আছে—‘স্টার চেম্বারের’ রায়। অভিযুক্ত ব্যক্তির কথা বলা কিংবা আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ সেখানে নেই এবং অভিযোগ, বিচার ও রায়—সবই হচ্ছে একতরফা।
শুধু যে রাষ্ট্র এবং বিচারব্যবস্থাই আলিনাকে দোষারোপ করছে, তা–ই কেবল নয়। একই সঙ্গে মিথ্যার পসার বিলিয়ে যাওয়া মূলধারার সংবাদমাধ্যমও তাকে তুলে ধরছে পুতিনের কাছ থেকে আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করে যাওয়া ব্যক্তিত্ব হিসেবে যদিও অভিযোগের পক্ষে কোনো রকম প্রমাণ তারা একেবারেই উপস্থিত করছে না।অন্যদিকে গ্রাহাম ফিলিপসকে নিয়ে ব্রিটেনের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন পার্লামেন্টে রাখা বক্তব্যে তাঁকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করেছেন এবং একহাত দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছেন। বরিস জনসনের অভিযোগ, বানোয়াট সংবাদ প্রচারে গ্রাহাম ফিলিপস নিয়োজিত। অথচ ঘটনাস্থলে নিজে উপস্থিত থেকে ধারণ করা তাঁর বিভিন্ন ভিডিওতে আমরা যা দেখি তা হলো সেসব জায়গার স্থানীয় লোকজনের দিয়ে যাওয়া বিবরণ, যেখানে তাঁরা প্রায় সবাই বলছেন ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর বর্বর আচরণের কথা এবং রুশ বাহিনীর আগমনে কতটা তাঁরা স্বস্তি বোধ করছেন সেই বার্তা। অন্যদিকে পশ্চিমের মূলধারার সংবাদমাধ্যম সেই একই মারিউপোলের অবস্থার যে বর্ণনা সম্মিলিত কন্ঠে প্রচার করে চলেছে, তাতে যে এক ব্যক্তির উদ্ধৃতি দিয়ে ঘটনাস্থলের বর্ণনা দেওয়া হচ্ছে সেই ব্যক্তি হলেন মারিউপোলের ইউক্রেনের নিয়োগ দেওয়া মেয়র।
সংবাদমাধ্যম যে সত্য এড়িয়ে গিয়ে তাঁর উদ্ধৃতি দিয়ে চলেছে তা হলো, যুদ্ধের একেবারে শুরুতেই মেয়র ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে গিয়ে হাজার মাইল দূরে গিয়ে বসে আছেন এবং সেখান থেকে অসম্ভব শক্তিশালী কোনো দুরবিন চোখে লাগিয়ে পরিষ্কার দেখছেন কী ঘটে চলেছে সেসব জায়গায়। আর সেই বার্তাই সিএনএন, বিবিসি, নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান ও অন্যরা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়ে রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধের ‘প্রামাণ্য’ দলিল আমাদের সামনে হাজির করছে। গ্রাহাম ফিলিপসরা প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও ক্ষমতাবান সেসব মিথ্যাবাদীর বিরুদ্ধে চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের নিঃসঙ্গ লড়াই।
বরিস জনসনকে উদ্দেশ করেও একটি ভিডিও গ্রাহাম ফিলিপস তৈরি করেছেন, যেখানে তিনি আমাদের দেখাচ্ছেন দোনেৎস্কের স্টেডিয়ামের সামনে বড় অক্ষরে লিভারপুল লেখা সাইন পোস্টের সামনে দাঁড়িয়ে দোনেৎস্কের কিছু তরুণ বলছেন তাঁদের সংগ্রাম পশ্চিমের বিরুদ্ধে নয়, বরং পশ্চিমের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে। আর এর ঠিক পর গ্রাহাম নিজে বরিস জনসনকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘দেশপ্রেমের অর্থ তোমার জানা আছে, বরিস? আমি নিশ্চিত জানা নেই বলেই অন্যকে রাষ্ট্রদ্রোহী আখ্যায়িত করে পার্লামেন্টে তুমি বক্তব্য রাখছ। ভুলে যেয়ো না আমার নিজের দেশপ্রেম তোমার চেয়ে কোনো অংশে কম নয় এবং সেই দেশপ্রেমে অনুপ্রাণিত হয়েই মানুষের কাছে সত্যের বার্তা পৌঁছে দিতে এই বিদেশ–বিভুঁইয়ে আমি কাজ করে চলেছি।’
সুখের কথা আলিনা লিপ কিংবা গ্রাহাম ফিলিপসরা এখন আর একা নন। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা থেকে শুরু করে পর্তুগাল, ইতালি, ফ্রান্স হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এদের আবির্ভাব এখন লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ভিডিও বার্তা এবং সাক্ষাৎকার ও আলাপ-আলোচনার মধ্যে দিয়ে সত্যিকার অবস্থার ছবি তারা বিশ্বের সামনে হাজির করছেন এবং সেই সঙ্গে ভাঙছেন প্রচলিত পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমের বলদর্পী আচরণ। সত্যের পক্ষ অবলম্বন করে যাওয়া একঝাঁক সেই নব্য সাংবাদিকের দলে আরও আছেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্লেইটন ও নাটালি মরিস, ব্রিটেনের আলেক্সান্ডার মার্কিউরিস, গ্রিসের আলেক্স ক্রিস্তোফোরু, রুমানিয়ার এমিল কসম্যান, কানাডার এভা বার্টলেট, চিলির গঞ্জালো লিরা, ব্রিটেনের প্যাট্রিক ল্যাঙ্কেস্টার, যুক্তরাষ্ট্রের জ্যাকসন হিঙ্কেল এবং আরও অনেকে। ইউক্রেনের যুদ্ধকে ঘিরে পশ্চিমের মূলধারার সংবাদমাধ্যমের চালিয়ে যাওয়া মিথ্যা প্রচারের লাগামহীন তৎপরতা চলতে থাকার মুখে সত্যকে বাঁচিয়ে রাখাই কেবল নয়, একই সঙ্গে মিথ্যাবাদীর মুখোশ খুলে দিতেও তাঁরা রেখে যাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
মনজুরুল হক জাপান প্রবাসী শিক্ষক ও সাংবাদিক