আমাদের ঈদ-জীবন আর সম্পর্কের উদ্‌যাপন

এগুলো আসলে শুধু উৎসব বা একটা বিশেষ দিনের খণ্ড স্মৃতিচারণ নয়। সম্পর্কের উদ্‌যাপন।

তিনি সারা বছর সন্ধ্যায় আসতেন। শুধু একটা দিন আসতেন দিন-দুপুরে। ঈদের দিনে। নামাজ শেষ করে। সাইকেলে। সাদা পাঞ্জাবি আর পায়জামা পরে। তিনি শামসুর রহমান খান। আমার ছোটবেলার শিক্ষক। শিক্ষকতা তার পেশা ছিল না। ভকেশনাল ইনস্টিটিউটে চাকরি করতেন।

বর্ণ আর সংখ্যা দুটোর পরিচয়ই তাঁর কাছে। শহর থেকে কিছুটা দূরে বাড়ি। সাইকেলের চড়ে আমরা দু ভাই বোন তার বাড়ি যেতাম। বাড়ির সবাই আমাদের অনেক যত্ন করে খাওয়াতেন। আমরাই থাকতাম মনোযোগের কেন্দ্রে। স্যারের ফিনিক্স সাইকেলটা অত্যন্ত যত্নে থাকত। তার অত্যন্ত প্রিয় ছিল। দিনে কয়েকবার মুছতেন। সামনে পেছনে ব্যাটারিচালিত লাইট। বসবার জায়গাটাও বেশ আরামের।

বছরে শুধুমাত্র ঈদের দিন আমাকে উনি সাইকেলটা কিছু সময়ের জন্য চালাতে দিতেন। সাইকেল করেই স্যার আমাদের আবার বাড়িতে দিয়ে যেতেন। চলন্ত সাইকেলে গরমের দুপুরের হালকা রোদ মাখা বাতাস মুখে এসে লাগত। পাঞ্জাবি থেকে উড়ে আসত মিষ্টি একটা আতরের গন্ধ। হয়তো পারস্যের কোনো ফুল থেকে তৈরি। এখন ভাবতে অবাক লাগে সব থেকে বড় উৎসবে গোটা পরিবার আমাদের জন্য দিনের একটা বড় অংশ বরাদ্দ করতেন। আসলে শুধুমাত্র কয়েক ঘণ্টা নয়, উনি বছরের পর বছর দিয়েছেন আমাকে গড়বার জন্য।

বাড়িতে এসে দেখতাম আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন হাকিম কাকা।  পুরো নাম শরিফ আব্দুল হাকিম। আমার বাবার অগ্রজ সহকর্মী। আইনজীবী ছিলেন, সঙ্গে সাংবাদিকতাও করতেন। অগাধ পড়াশোনা। তখন সবার বাড়িতে ল্যান্ড ফোন ছিল। কাকা আগে থেকেই আমাদের ফোনে ঈদে তার বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে রাখতেন। তারপরেও শত ব্যস্ততার মাঝে আমাদের নিজেই বাড়িতে নিয়ে যেতেন। আমার বড় বেলায় কাকার সঙ্গে অনেক কথা হতো - নতুন বের হওয়া গল্প আর উপন্যাস নিয়ে।
আমার ঠাকুমা-দাদুর অতি কাছের মানুষ ছিলেন কালাম কাকা। তাদের দেখাশোনার অনেকটাই কালাম কাকা করতেন। বেঁচে থাকার আগ পর্যন্ত।

ছয় ফুটের মতো লম্বা। মেদহীন শরীর। আস্তে আস্তে কথা বলতেন। দেখতে অনেকটা পাঠানদের মতো। কাকা যেকোনো কাজই অত্যন্ত নিখুঁতভাবে করতেন। ছোটবেলায় অবাক বিস্ময়ে আমি তার কাজ করা দেখতাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নাদের আলীর মতো কালাম কাকাও আমাকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিতেন। ঈদের শত ব্যস্ততার মধ্যেও দিনের মধ্যে কয়েক বার আমার ঠাকুমা আর দাদুর খবর নিতেন। তাদের দেওয়া ঈদ উপহারের পোশাক পরে সন্ধ্যা হলে, প্রতিদিনের মতো তাদের সঙ্গে বারান্দায় বসে বিবিসি বাংলার সান্ধ্য অধিবেশন প্রভাতি  শুনতেন।

এগুলো আসলে শুধু উৎসব বা একটা বিশেষ দিনের খণ্ড স্মৃতিচারণ নয়।  সম্পর্কের উদ্‌যাপন। আমাদের বেড়ে ওঠার গল্প, জীবন-যাপনের গল্প। ভালোবাসা আর সরল সম্পর্কের গল্প। যে সম্পর্কগুলো গড়ে ওঠে প্রত্যাশা ছাড়াই। এই উদ্‌যাপনের অভিজ্ঞতা আমাদের সমৃদ্ধ করে, তৈরি করে সুখস্মৃতি। মজবুত হয় মানুষের প্রতি বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসে ভর রেখে সবাইকে বলি, ‘ঈদ মোবারক।’

দিনের শেষে আমরা যেতাম আমাদের নিকট প্রতিবেশী ইউসুফ স্যারের বাড়িতে। তাঁর স্ত্রী রাবেয়া ইউসুফও আমার শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের বাড়িতে আমার অবাধ যাতায়াত ছিল। একদম ছোটবেলা থেকে। তাদের সন্তানেরাও আমাদের বন্ধু। খাবার পরে গল্পের ঝাঁপি নিয়ে আমরা সবাই বসতাম। শুধু ঈদের দিন নয়। সারা বছরই এই দম্পতি অগণিত মানুষকে খাইয়ে অবাধ তৃপ্তি পেতেন। এ দুজনকে হাসিমুখে ছাড়া কোনো দিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এখনো আমার প্রতি তাদের অপত্য স্নেহ।

তখন আমি কলকাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। আমাদের বন্ধু জিয়ার বাড়ি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশ দূরে। ট্রেনে যেতে হতো। প্রচণ্ড গরম। হঠাৎ দেখি এক ঈদে দুপুরে জিয়া খাবার নিয়ে আমাদের জন্য হোস্টেলে চলে এসেছে। ঘামে তাঁর শরীর ভেজা। আমরা যখন খাচ্ছিলাম জিয়ার মুখের সেই তৃপ্তির হাসি, আমার এখনো মনে আছে। ইউরোপ ঘুরে জিয়া এখন ভারতের বেশ বড় বিজ্ঞানী।

আরও পড়ুন

এ প্রবাসেও আমরা একইভাবে ঈদ উদ্‌যাপন করি। আমাদের বন্ধু কামাল ভাই আর মিতা ভাবি অথবা শাকিল ভাই আর পারভিন ভাবি নিয়ম করে আমাদের ডাকেন। কয়েক বছর আগে ঈদে কামাল ভাই আর মিতা ভাবি বাংলাদেশে গেলেন। আমার ছেলে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল আমাদের ঈদের উদ্‌যাপন কীভাবে হবে। আসলেই তাই বন্ধু ছাড়া উৎসবের উদ্‌যাপন ঠিকমতো হয় না।

এগুলো আসলে শুধু উৎসব বা একটা বিশেষ দিনের খণ্ড স্মৃতিচারণ নয়।  সম্পর্কের উদ্‌যাপন। আমাদের বেড়ে ওঠার গল্প, জীবন-যাপনের গল্প। ভালোবাসা আর সরল সম্পর্কের গল্প। যে সম্পর্কগুলো গড়ে ওঠে প্রত্যাশা ছাড়াই। এই উদ্‌যাপনের অভিজ্ঞতা আমাদের সমৃদ্ধ করে, তৈরি করে সুখস্মৃতি। মজবুত হয় মানুষের প্রতি বিশ্বাস।
সেই বিশ্বাসে ভর রেখে সবাইকে বলি, ‘ঈদ মোবারক।’

  • ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট
    [email protected]