চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের ইস্যুতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম মন্তব্যটিতে তিনি যখন বাংলাদেশ নীতিতে কেন্দ্রীয় সরকারকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়েছিলেন, সেটা দেখতে আমাদের নিশ্চয়ই ভালো লাগেনি। তবে মন্দের ভালো ছিল, তিনি যুক্ত করেছিলেন এই কথাও—বিষয়টি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
কংগ্রেস নেতা শশী থারুর ছাড়া আর কোনো রাজনীতিবিদ বিষয়টিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলেছেন, তা আমার অন্তত চোখে পড়েনি। কিন্তু সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি রীতিমতো যুদ্ধংদেহী হয়ে বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর আহ্বান জানালেন। তাঁর এই মারাত্মক ইউটার্ন কেন?
চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার করার পর থেকেই আমরা অনেকে মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই অনুমান করতে পেরেছিলাম, এটা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে ভারতে।
দেশটির ক্ষমতাসীন বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি আমরা বুঝি। সে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন নেতার ওপরে কথিত অন্যায়কে কীভাবে ব্যবহার করতে চাইবে, সেটা অজানা নয়। তাই পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির নেতা শুভেন্দু অধিকারী যখন বাংলাদেশকে লক্ষ্য করে নানা রকম হুমকি দেন, তখন আমরা খুব বেশি অবাক হই না। কিন্তু ভারতের মূলধারার মিডিয়া যেভাবে আচরণ করেছে, সেটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করব আমরা?
সম্প্রতি বাংলাদেশের মানুষ একটি ভারতীয় চ্যানেলের যে বাংলা ভার্সন নিয়ে কৌতুক দেখার মতো আনন্দ পেয়েছে, সেই চ্যানেলের কথা বাদই দিই, ভারতের একেবারেই মূলধারার মিডিয়ার আচরণ রীতিমতো একাডেমিক গবেষণার বিষয় হবে।
সত্য-উত্তরকালে, পরিচয়বাদী রাজনীতির ডামাডোলে মিডিয়া কেমন আচরণ করে এবং কীভাবে সেটা রাজনীতির গতিপ্রকৃতি পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, শেখ হাসিনার পতন এবং পলায়নের পর ভারতের মিডিয়ার আচরণ সেটা সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা দিতে পারে।
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে ভারতের মিডিয়ায় যেসব আলোচনা হয়েছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে এই অভিযোগ—ড. ইউনূসের সরকার হিন্দু সম্প্রদায়ের একজন নেতার ওপরে নিপীড়ন করছে। ভারতীয় মিডিয়ার বয়ানে তাঁর ‘অপরাধ’ হচ্ছে হিন্দুদের অধিকার আদায়ের জন্য অহিংস কর্মসূচি দেওয়া।
শুধু সেটাই নয়, তিনি ইসকনের একজন ধর্মগুরু এই আলাপটাও খুব গুরুত্ব দিয়ে সামনে আনা হয়েছে। এটা সামনে আনার কারণ বোধগম্য—বিশ্বজুড়ে ভক্তিবাদী একটি সংগঠন হিসেবে ইসকনের পরিচিতি আছে, পরিচিতি আছে বিনা মূল্যে খাদ্য বিতরণ, স্কুল পরিচালনা, দুর্যোগের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মতো মানবিক সব কর্মকাণ্ডের বহু উদাহরণ। ফলে এ রকম সেবামূলক একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত একজন ধর্মগুরু কোনোভাবেই কোনো অপরাধ করতে পারেন না।
চিন্ময় দাস অভিযুক্ত হয়েছেন, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে তদন্তসহ বিচারিক প্রক্রিয়া কোনো কিছুই হয়নি এখনো। তাই এটা নিশ্চিতভাবে বলা যাবে না, তিনি আদতে কোনো বড় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত আছেন বা ছিলেন কি না।
কিন্তু আমরা এটুকু স্মরণ রাখব কোনো একটি ধর্মের গুরু হওয়াটা কোনো অপরাধ না করার গ্যারান্টি নয়। যে ধর্ম মানুষ তো বটেই কোনো প্রাণী হত্যার বিরুদ্ধে, সেই ধর্মেরই এক ধর্মগুরু আসিন উইরাথু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের মানুষকে কচুকাটা করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তাঁকে নিয়ে টাইম সাময়িকীর প্রচ্ছদ এবং তাতে লেখা ‘দ্য ফেস অব বুড্ডিস্ট টেরর’ আমাদের অনেকের মনে আছে নিশ্চয়ই। তেমনি অনেক ইসলাম ধর্মের গুরুর বিরুদ্ধেও আছে সন্ত্রাসবাদের গুরুতর অভিযোগ।
ইসকনের নেতা বলে চিন্ময়কে নিয়ে যে বয়ান তৈরির চেষ্টা, তা যে অসত্য, সেটা আমাদের সামনে এসেছিল গোড়াতেই। তাঁর গ্রেপ্তার নিয়ে প্রথম প্রতিবেদনেই প্রথম আলো জানিয়েছিল, তিনি ইসকনের সদস্য নন, কিছুদিন আগেই বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের অন্যান্য মিডিয়ায় এসেছে, চিন্ময়কে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাজ্যে অবস্থিত ইসকনের আন্তর্জাতিক শিশু সুরক্ষা কার্যালয় (ইসকন ইন্টারন্যাশনাল চাইল্ড প্রোটেকশন অফিস—সিপিটি) সাময়িক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল গত বছরের ৬ অক্টোবর।
শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতীয় মিডিয়ায় যেভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপরে অত্যাচারের বয়ান তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে, প্রত্যাশিতভাবেই, সেটা আরও কয়েক গুণ বেড়েছে এ ঘটনার পর। বর্তমান বাংলাদেশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য কতটা বাসের অযোগ্য, সেই আলোচনা সেখানে আছে। তাঁদের মতে, প্রতিমুহূর্তে নাকি হিন্দুদের জানমাল হামলার হুমকির মুখে। অবিশ্বাস্যভাবে কেউ কেউ প্রচুর হিন্দু নারীর ধর্ষিত হওয়ার তথ্যও সামনে আনছেন, যা এমনকি বাংলাদেশের কোনো হিন্দু নেতাও করেননি।
সিপিটির পরিচালক কমলেশ কৃষ্ণ দাস স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছিল, নিষেধাজ্ঞার ফলে চিন্ময় ইসকনের কোনো ব্যবস্থাপনা বা নেতৃত্বের পদে থাকতে পারবেন না। কোনো কীর্তনে নেতৃত্ব বা ক্লাস নিতে পারবেন না। প্রকাশ্যে শ্রীল প্রভুপদের কোনো পূজা অর্চনায় অংশ নিতে পারবেন না। ১৮ বছর বয়সের নিচে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। বাংলাদেশের ইসকনের কোর কমিটি এবং সিপিটির কোনো পদধারী ব্যক্তি ছাড়া ইসকনের কোনো সম্পত্তিতে রাত যাপন করতে পারবেন না।
মজার ব্যাপার চিন্ময়কে গ্রেপ্তারের দুই দিন পর বাংলাদেশের ইসকন যখন তাঁকে আগেই বহিষ্কার করার কথা জানায়, তখন কয়েকটি জায়গায় এই বয়ান প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা হয়েছে যে ইসকন তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য চিন্ময়ের সঙ্গে তাদের বিযুক্ত করছে।
শেখ হাসিনার পতনের পর ভারতীয় মিডিয়ায় যেভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের ওপরে অত্যাচারের বয়ান তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে, প্রত্যাশিতভাবেই, সেটা আরও কয়েক গুণ বেড়েছে এ ঘটনার পর। বর্তমান বাংলাদেশ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য কতটা বাসের অযোগ্য, সেই আলোচনা সেখানে আছে। তাঁদের মতে, প্রতিমুহূর্তে নাকি হিন্দুদের জানমাল হামলার হুমকির মুখে। অবিশ্বাস্যভাবে কেউ কেউ প্রচুর হিন্দু নারীর ধর্ষিত হওয়ার তথ্যও সামনে আনছেন, যা এমনকি বাংলাদেশের কোনো হিন্দু নেতাও করেননি।
হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর কথিত নির্যাতনের ক্ষেত্রে প্রচুর ব্যবহার করা হচ্ছে ‘সিস্টেমেটিক’ শব্দটি। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে কেউ কেউ হিন্দুদের ওপরে কথিত নিপীড়নের ব্যাপ্তি এবং তীব্রতা বোঝাতে গিয়ে ‘রিলিজিয়াস ক্লিনজিং’ শব্দযুগলও ব্যবহার করছেন।
ভারতের মিডিয়ার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অপরাধ এতটাই বড়, সেখানে এই আলাপও হচ্ছে বাংলাদেশকে ভারতের চাওয়া মানতে বাধ্য করার জন্য বাংলাদেশের ওপরে নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
ভারতীয় মিডিয়ার এই সিস্টেমেটিক প্রোপাগান্ডার ফল আমরা দেখতে পাচ্ছি দেশটির সাধারণ জনগণের মানসিকতায়। উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা যখন বাংলাদেশের কলকাতা এবং মুম্বাই ডেপুটি হাই কমিশনে ভীষণ উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে, এমনকি ভাঙচুর করে, পতাকা পোড়ায় আগরতলার সহকারী হাইকমিশনে, তখন সেটার নিন্দায়, প্রতিবাদে এগিয়ে আসতে দেখি না আমরা ভারতীয় নাগরিকদের (কিছু ব্যতিক্রম বাদে)।
মিথ্যা বা অর্ধসত্যের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা প্রোপাগান্ডা ইতিহাস মানুষের সভ্যতার সমান বয়সী। এই প্রোপাগান্ডা চলত সত্যকে সরিয়ে রেখে বা অর্ধসত্যকে সামনে এনে। মানুষ যদি কখনো সেই বিষয়ের সত্যকে সামনে পেত, তখন অনেকেই তাদের পূর্ববর্তী অবস্থান থেকে সরে আসত। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। পোস্ট-ট্রুথ এরা বা সত্য-উত্তরকাল এমন একটা পরিস্থিতি, যখন মানুষ সঠিক তথ্য ও প্রকৃত ঘটনার ওপর নয়, বরং তার বিশ্বাস ও আবেগের ওপর ভিত্তি করে কোনো বিষয়কে গ্রহণ বা বর্জন করে। এ পরিস্থিতিতে যেকোনো বিষয়ের বিশ্লেষণে মানুষের কাছে তাঁর আবেগ ও বিশ্বাসই প্রধান ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়।
যাঁরা ‘সত্য’ বিশ্বাস করতে চান না, তাঁরা এখন আর নিজেকে মিথ্যার পথে আছেন বলে মনে করেন না; ভাবেন তাঁরা আছেন সত্যের (অলটারনেটিভ ফ্যাক্ট বা ট্রুথ) সঙ্গেই। অনেকেই বরং প্রতিষ্ঠিত সত্যকেই উড়িয়ে দিতে চান এখন। কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ‘ইকো-চেম্বারে’ এখন যে কেউ ‘আরামদায়ক সত্য’ পেতে পারেন খুব সহজেই। আর ভারতের ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি এই প্রবণতা আর মোটেও সীমাবদ্ধ নেই শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ক্ষেত্রে—আগ্রাসীভাবে ছড়িয়ে পড়েছে মূলধারার মাধ্যমেও।
শুরু করেছিলাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইউটার্ন নিয়ে। আমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছি ভারতের মূলধারার মিডিয়া ক্রমাগত যে প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে শেখ হাসিনা পতনের পর থেকে, তাতে ভারতীয়দের মধ্যে এই বিশ্বাস ভিত্তি পেয়েছে—বাংলাদেশের হিন্দুদের ওপরে একেবারে পরিকল্পিতভাবে ক্রমাগত হামলা এবং অত্যাচার হচ্ছে। অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করছেন রিলিজিয়াস ক্লিনজিংয়ের বয়ানও।
এ রকম একটা চরমপন্থী, বিভক্তি সৃষ্টিকারী, পরিচয়বাদী রাজনৈতিক পরিবেশে ভোটের রাজনীতি করা রাজনীতিবিদদের সামনে ক্রমাগতভাবে চরমপন্থী হয়ে ওঠার ঝুঁকি তৈরি হয়। বাংলাদেশকে নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরম আপত্তিকর মন্তব্যটির কারণ সম্ভবত এটিই।
বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের সরকার, মিডিয়া এবং রাজনীতির সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়া আমাদের সামনে এই আলাপও নিয়ে এসেছে, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভারত কি সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে, যেটা মধ্য এবং দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশসহ এই অঞ্চল তো বটেই, ভারতের জন্যও ভালো হবে? এই প্রশ্নের উত্তরও নিশ্চয়ই খুঁজব আমরা।
জাহেদ উর রহমান লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক