কেমব্রিজ থেকে এমবিএ, সঙ্গে পিএইচডি। কাজেও বেশ দক্ষ নিক। সর্বোচ্চ দেওয়ার চেষ্টা সব সময়। একটি ব্রিটিশ ম্যানেজমেন্ট কনসাল্টিং কোম্পানির কর্মকর্তা তিনি। কর্তাব্যক্তিদের অধিকাংশই অক্সফোর্ড আর কেমব্রিজের প্রাক্তনী। ডিসেম্বর মাস। প্রতিবছর এই সময়ে পদোন্নতির জন্য বোর্ডে সিদ্ধান্ত হয়। নিক আমার টিমে কাজ করত। পদোন্নতির জন্য নিকের নাম প্রস্তাব করেছিলাম। কাজে দক্ষ। কেমব্রিজের প্রাক্তনী।
ভেবেছিলাম অনায়াসে নিকের পদোন্নতি হয়ে যাবে। হলো না। দক্ষতা বা যোগ্যতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুললেন না। কিন্তু আমার প্রস্তাবের সমর্থনেও কেউই এগিয়ে এলেন না। আমার মনটা খারাপ। বলা হলো, বৃহত্তর কোম্পানিতে নিকের যোগাযোগ আরও বাড়াতে হবে। যাদের পদোন্নতি হলো, তাদের যোগ্যতা বা দক্ষতা নিকের থেকে কোনো অংশেই কম নয়, কিন্তু তাদের এগিয়ে যাওয়ার কারণ হলো তাদের নেটওয়ার্ক।
ওই ঘটনার পর কোম্পানির চেয়ারম্যান আমাকে বলেছিলেন, ‘মনে রাখবে কোম্পানির বিভিন্ন স্তরের লোকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে হবে। তোমার অবর্তমানে, বদ্ধ ঘরে, তোমার হয়ে কথা বলার লোকের যেন অভাব না হয়। এই তালিকায় প্রভাবশালীরা থাকলে তো আরও ভালো।’
যোগ্যতা ও দক্ষতা থাকা সত্ত্বেও অনেক সময় শুধু নেটওয়ার্কের অভাবে আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারি না। একই যোগ্যতার অন্যরা এগিয়ে যায়—তাদের যোগাযোগের কারণে।
শুধু পেশাগত উন্নতির জন্য নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রেই নেটওয়ার্কের একটা বড় ভূমিকা আছে। গবেষণা বলছে, আমরা কোন শহরে বাস করি, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্বাস্থ্য, পেশা, পোশাক, প্রেম বা পরিণয়, কথা বলার ধরন, এমনকি শব্দচয়নেও নেটওয়ার্ক, অর্থাৎ আমরা যাদের সঙ্গে উঠবস করি, তাদের একটা প্রভাব রয়েছে। আমার নেটওয়ার্কের অধিকাংশই জার্মান আর সুইস। তারা নিয়মিত শরীরচর্চা করে, কাজের জায়গাতে সাদা জামা-নীল ট্রাউজার পরে, নির্ধারিত সময়ের আগেই মিটিংয়ে হাজির হয়। আমার মধ্যেও ধীরে ধীরে এ অভ্যাসগুলো গড়ে উঠেছে।
বিলেতে ‘ওল্ড বয়েজ নেটওয়ার্ক’ নামে একটি কথা খুব প্রচলিত। অর্থ হলো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আভিজাত্যের সঙ্গে আপনার পরবর্তী জীবনের উন্নতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ব্রিটেনের অধিকাংশ প্রধানমন্ত্রী, হাইকোর্টের ৭৪ শতাংশ বিচারক, ৭১ শতাংশ সামরিক কর্মকর্তা, নামকরা ডাক্তারদের ৬০ শতাংশ, আর বড় সাংবাদিকদের ৫০ শতাংশেরও বেশি প্রাইভেট স্কুলে গিয়েছেন। ৫৭ জন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ৩০ জন অক্সফোর্ডে গিয়েছেন, ১৪ জন কেমব্রিজে।
কোনো স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য আলাদা কোনো পাঠ্যক্রম নেই। এসব স্কুলে অনেক কম বয়স থেকেই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মেধাবী ছাত্রদের একটা ভালো নেটওয়ার্ক তৈরি হয়। সেই নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত হয় ওই প্রতিষ্ঠানের সফল প্রাক্তনীদের নেটওয়ার্ক। বয়সের সঙ্গে গাণিতিক হারে বাড়তে থাকে নতুন সম্ভাবনা।
পাশ্চাত্যের বড় কোম্পানিগুলোতে প্রতিবছর হরহামেশাই ভারতীয় অভিজাত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দুই বা তিন মাসের জন্য শিক্ষানবিশ হয়ে আসেন। অধিকাংশই কোম্পানিগুলোতে কর্মরত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনীদের মাধ্যমে। এই শিক্ষার্থীরা যখন পড়াশোনা শেষ করে কাজের জন্য আবেদন করেন, অভিজ্ঞতা নেই এমন প্রার্থীদের থেকে একটু হলেও এগিয়ে থাকেন।
কীভাবে আপনার নেটওয়ার্ক বাড়াবেন? পেশাগত জীবনের শুরুর দিকে নেটওয়ার্ক বাড়ানোর একমাত্র উপায় হলো নিজের কাজটি মন দিয়ে করা। যে বিষয় নিয়ে আপনি কাজ করছেন, ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হওয়ার চেষ্টা করুন। আপনার কাজটি যেন পৃথিবীর অন্য কেউ আপনার চেয়ে ভালো না করতে পারে। দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দিন। আপনার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ান। হঠাৎ এটি হবে না। সময় আর শ্রম দিতে হবে।
লেগে থাকতে হবে। দক্ষতাকে নিজের সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড করুন। দেখবেন প্রতিষ্ঠানের ভেতরে আস্তে আস্তে আপনার পরিচিতি বাড়ছে, বাড়ছে কদর। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কম বয়সীদের অনেকে পেশাগত জীবনের শুরুর দিকটাতে নিজের কাজের প্রতি মন না দিয়ে, উন্নতির আশায় নেটওয়ার্ক বাড়ানোর প্রতি অশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। আবার কেউ কেউ নিবিষ্ট মনে নিজের কাজটি করে যায়। দীর্ঘমেয়াদে তাঁরাই উপরে ওঠে।
আপনার ঝুলিতে বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা। কাজে মোটামুটি আপনি একজন বিশেষজ্ঞ। এবার আপনার নেটওয়ার্ক বাড়ানোর পদ্ধতিটা একটু ভিন্ন হতে হবে। পরিচিতির গণ্ডি একটু বাড়াতে হবে। শুরুটা নিজ কোম্পানি থেকেই করুন। কীভাবে করবেন?
আশপাশের অন্য সহকর্মীদের সাহায্য করার চেষ্টা করুন। সাহায্য করার হাতটা সাহায্য চাওয়ার আগে বাড়িয়ে দিন। কারও কাছ থেকে সহায়তা চাওয়ার আগে তাকে সহায়তা করাটা অত্যন্ত জরুরি। অন্যের কথা শুনুন। মন দিয়ে।
প্রতিষ্ঠানের অন্য বিভাগের সহকর্মী এবং কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করুন। পূর্বপরিচিত না হলে অল্প সময়ের সাক্ষাতের জন্য সময় চান। এসব মিটিংয়ে স্বল্প সময়ে নিজের কথা বলতে হবে। অন্যকে বলার সুযোগ দিতে হবে। এটি আপনার প্রথম এবং হয়তো বা শেষ সুযোগ নিজের সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার। কী বলবেন, কীভাবে বলবেন, এর ওপর তৈরি হবে আপনার গ্রহণযোগ্যতা। তাদের অভিজ্ঞতা শুনুন উৎসাহের সঙ্গে।
নিজের কর্মজীবনের উত্থান আর অভিজ্ঞতা শোনাতে সবাই পছন্দ করে। আপনার ক্যারিয়ার নিয়ে পরামর্শ চাইতে পারেন। প্রথম মিটিংয়ে কখনোই নিজের পদোন্নতি বা তাঁর বিভাগে চাকরির আবদার করবেন না। আলাপ শুরু হলে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। কাজ–সম্পর্কিত তথ্য বিনিময় করুন। কোনো ভালো লেখা বা বই পড়লে শেয়ার করুন। নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারলে দেখবেন আপনি অনেক তথ্য জানতে পারছেন, যা কিনা অন্যের অজানা। কে কবে চাকরি ছেড়ে যাচ্ছে, অন্য কোন বিভাগে লোক নেওয়া হবে, এসব তথ্য এ রকম ছোটখাটো আলোচনা থেকেই জানা যায়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেমন লিংকডইনে নিজের প্রফেশনাল প্রোফাইল তৈরি করুন। বিষয়ভিত্তিক ম্যাগাজিন বা জার্নালে লেখার কথাও ভাবতে পারেন। লিংকডইনে মতামত লিখতে পারেন। সেমিনারে বা কনফারেন্সে যোগ দিন। প্রতিষ্ঠান ছেড়ে এলেও প্রাক্তন সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করুন। যেসব সহকর্মী আপনার প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখুন নিয়মিত।
একাধিক পেশার লোকের সঙ্গে নেটওয়ার্ক রাখাটা ভালো। জানাশোনার পরিধি বাড়তে থাকে। অ্যাপলের প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবসের কথাই ধরুন। কম্পিউটার প্রোগ্রামার বা হার্ডওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার থেকে শুরু করে ডিজাইনার—বিভিন্ন পেশার লোকের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। ভাগিয়ে নিয়ে এসেছিলেন বিভিন্ন কোম্পানি থেকে অ্যাপলে কাজ করানোর জন্য।
কতজনকে চেনেন, তার থেকে সম্পর্কের গভীরতায় জোর দেওয়া উচিত। আপনি কজনকে চেনেন তার থেকে জরুরি, আপনাকে কজন চেনে। অপরিচিতের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরিতে অনেকেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকেন। শুরুটা করুন। দেখবেন একসময় এটি অত্যন্ত সহজাত হয়ে গেছে। স্বার্থসিদ্ধি নয়, দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক তৈরিতে জোর দিন।
যোগাযোগের ব্যাপ্তি, মাধ্যম আর পরিধি আপনাকেই ঠিক করতে হবে অবস্থা বুঝে। মনে রাখবেন, প্রত্যেকেই অত্যন্ত ব্যস্ত। আপনার অতি উৎসাহ অন্যের বিরক্তির যেন কারণ না হয়।
ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের গ্লোবাল ভাইস প্রেসিডেন্ট
[email protected]