মধ্য পশ্চিমবঙ্গের দুই জেলা মুর্শিদাবাদ ও মালদা, যেখানে ৫০ শতাংশের বেশি মানুষ মুসলমান, সেখানে আগামী দুই দফায় পাঁচ আসনে ভোট। এর মধ্যে মুর্শিদাবাদে তিনটির মধ্যে দুটি আসন—জঙ্গিপুর ও মুর্শিদাবাদ—২০১৯ সালে জিতেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। বহরমপুর আসন পেয়েছিল কংগ্রেস। মালদার দুটি আসন উত্তর ও দক্ষিণের একটি, অর্থাৎ উত্তর পেয়েছিল বিজেপি এবং দক্ষিণ কংগ্রেস।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের বড় অংশ তৃণমূলের পাশে থাকলেও এ দুই মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলায় তৃণমূলের কপালে দুঃখ আছে বলে অনেকেই মনে করছেন। এর কারণ কী?
‘এর একটা কারণ, যেটা আপাতদৃষ্টে চোখে পড়ে, সেটি হলো, অন্তত মুর্শিদাবাদে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জোটটা ভালো হয়েছে এবং ভালোভাবে কাজ করছে। পশ্চিমবঙ্গে সম্ভবত মুর্শিদাবাদেই জোটটা এত ভালোভাবে কাজ করছে। ফলে জোটের ভালো ফল করার একটা সম্ভাবনা রয়েছে,’ বললেন মুর্শিদাবাদের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রদীপ দে।
কতগুলো বিষয়ের দিকে চোখ রাখলেই বোঝা যাবে জোট কতটা শক্তপোক্ত।
লোকসভার পাশাপাশি মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলায় একটা উপনির্বাচন হচ্ছে, কারণ সেখানে বিধায়ক মারা গিয়েছেন। এই আসনে এককভাবে মুর্শিদাবাদের কংগ্রেস নেতা এবং রাজ্যে কংগ্রেসের প্রধান অধীর চৌধুরী প্রার্থী ঘোষণা করেন। এতে জেলা স্তরে সিপিআইএম প্রবল অসন্তুষ্ট হয় এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারেও নামে। কিন্তু জেলা ও রাজ্য নেতৃত্ব বিষয়টি মেনে নেয় রাজ্যে বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের বৃহত্তর ঐক্যের স্বার্থে।
অন্যদিকে কংগ্রেস মুর্শিদাবাদ আসন ছেড়ে দেয় সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমকে, সিপিআইএমের কাস্তে-হাতুড়ি-তারা উত্তরীয় পরিয়ে অধীর চৌধুরীকে বরণ করেন সেলিম। আবার অধীরের মনোনয়ন পেশের দিন উপস্থিত ছিলেন সিপিআইএমের রাজ্য নেতৃত্ব। এ ছাড়া যে কাজ করতে গিয়ে তাঁরা অতীতে বিশেষ সফল হননি, সেটা হলো একসঙ্গে জোট বেঁধে প্রচার। এবারে গোড়া থেকে জোটবদ্ধভাবে দুই দল প্রচার করেছে।
মুর্শিদাবাদের ডোমকল বিধানসভা আসনে বিজেপির স্থানীয় কর্মী ঋতুরাজ বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই ডোমকলেই কয়েক দিন আগে অধীরদা ও সেলিম জনসভা করলেন। সাংঘাতিক ভিড় হয়েছিল। ভাবতেই পারিনি এখানে কংগ্রেস-সিপিআইএমের মিটিংয়ে এত লোক হতে পারে।’
বিপদ বুঝে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গত শনিবার পর্যন্ত মুর্শিদাবাদ ও মালদায় এক ডজন জনসভা করেছেন।
মুর্শিদাবাদে তিনটির মধ্যে অন্তত দুটি আসন আশা করছে তৃণমূল। এর কারণ, অতীতে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের দুর্গ বলে পরিচিত ৬৬ শতাংশ সংখ্যালঘুর এই জেলায় বর্তমানে ২২টি বিধানসভা আসনের মধ্যে ২০টি তৃণমূলের, অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ ও পৌরসভা তৃণমূলের দখলে। তারপরও যদি তারা মুর্শিদাবাদে তিনটি আসনের মধ্যে অন্তত দুটি না পায়, তবে তা হবে লজ্জার, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গসহ গোটা ভারতের মানুষ যখন মনে করে তৃণমূল সংখ্যালঘুর স্বার্থ কিছুটা হলেও দেখে।
সে কারণেই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভগবানগোলায় এক জনসভায় তিনি বলেছেন, ‘আমি জানি, ভোট তৃণমূল ও সিপিআইএমের মধ্যে ভাগাভাগি হবে। কিন্তু আমি হাতজোড় করে অনুরোধ করব, দুটি ভোটই তৃণমূলকে দিতে।’ কিন্তু এরপরও মালদা ও মুর্শিদাবাদে মুসলমান সমাজ তৃণমূলকে ভোট দেবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
‘এর প্রধান কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে,’ বললেন দুই জেলার একটির সাবেক তৃণমূল সভাপতি, নাম প্রকাশ না করার শর্তে।
‘বহরমপুরে পাঁচবারের এমপি অধীর চৌধুরীর অবস্থা এবারে একেবারেই ভালো ছিল না। তিনি যথেষ্ট চাপে রয়েছেন এবং মাঝেমধ্যেই প্রকাশ্যে মাথা গরম করছেন। এর কারণ, বহরমপুরের সাতটি বিধানসভার মধ্যে ছয়টি তৃণমূলের দখলে এবং একটি বিজেপির দখলে। পৌরসভা বা গ্রাম পঞ্চায়েতও অধীরের নিয়ন্ত্রণে নেই।
এই রকম অবস্থায় তৃণমূল নেতৃত্বের উচিত ছিল একজন স্থানীয় শক্তপোক্ত প্রার্থী বহরমপুরে দেওয়া। কিন্তু তারা তা না দিয়ে গুজরাট থেকে নিয়ে এল সাবেক ক্রিকেটার ইউসুফ পাঠানকে, যাঁর স্থানীয় বা জাতীয় কোনো রাজনীতি নিয়েই বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। স্বাভাবিকভাবেই মুসলমান ভোটের একটা অংশ বহরমপুরে কংগ্রেসে, অর্থাৎ অধীরের দিকে যাবে,’ বললেন তৃণমূল নেতা।
রাজনীতি সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল বহরমপুরের এক স্কুলশিক্ষক আসিফ জোয়ারদার বললেন, ‘তৃণমূলের স্থানীয় নেতারা চান না যে ইউসুফ পাঠান জিতুক, কারণ সে ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে বলা হবে বহরমপুরে বাইরের প্রার্থী জিততে পারে, কিন্তু স্থানীয়রা নয়।’
তবে তৃণমূলের তরফে বাইরের প্রার্থী আনার একটা কারণ ব্যাখ্যা দিলেন এক স্থানীয় নেতা। তিনি বলেন, ‘গোটা রাজ্যে ও মুর্শিদাবাদে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত তৃণমূল কংগ্রেস। এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। তৃণমূলের এক এমএলএ এবং বহরমপুর সাংগঠনিক জেলার সভাপতি অপূর্ব সরকারের সঙ্গে এবং রবিউল আলম চৌধুরীর (এমএলএ এবং বহরমপুর জেলার সাংগঠনিক সভাপতি) অহিনকুল সম্পর্ক। ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে অপূর্ব ও রবিউলের সম্পর্কও সাপে-নেউলে। হুমায়ুন ধারাবাহিকভাবে ওদের আক্রমণ করেছ। রবিউল রেজিনগরের বিধায়ক। হুমায়ুনের বাড়ি রেজিনগরের শক্তিপুরে। কিন্তু কারও সঙ্গেই কারও বনিবনা নেই।
একটা ক্ষুদ্র অঞ্চলে যদি এই পর্যায়ের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থাকে, তাহলে স্থানীয় কোনো নেতাকে মনোনয়ন দিলে কী হতো ভাবতে পারছেন? বাকি নেতারা ভেতর থেকে অন্তর্ঘাত করে নিশ্চিতভাবে দলকে হারাত। সেটা মাথায় রেখেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলনেত্রী বাইরের প্রার্থী এনেছেন।’
সবদিক বিচার করে স্থানীয় মানুষের বক্তব্য, বহরমপুর আসনে শেষ পর্যন্ত পাঁচবারের এমপি কংগ্রেসের অধীরই পাবেন, কারণ তৃণমূলের গোষ্ঠীবিভ্রাটে বিপর্যস্ত ভোটাররা বিধানসভা বা পঞ্চায়েতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে ভোট দিলেও লোকসভায় দেবেন কংগ্রেসকে।
মুর্শিদাবাদের অপর একটি আসন জঙ্গিপুরে (যেখান থেকে অতীতে সংসদ সদস্য হয়েছেন প্রণব মুখোপাধ্যায়) তৃণমূলের জেতার সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ সেখানে প্রার্থী হয়েছেন মুর্শিদাবাদের প্রধান শিল্প বিড়ির অন্যতম প্রভাবশালী ব্যবসায়ী খলিলুর রহমান। ২০১৯ সালেও তিনি এই আসনে জয়ী হয়েছিলেন। বিড়িমালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ শ্রমিকদের দাবিদাওয়া ঠিকমতো না মেটানো। ‘খলিলুর মোটামুটি শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল। মানুষের সঙ্গে মেশার স্বাভাবিক একটা প্রবণতাও তাঁর রয়েছে।
সে কারণেই শেষ পর্যন্ত জিততে পারেন,’ বললেন অবসরপ্রাপ্ত রাজ্য সরকারি কর্মী তন্ময় মজুমদার।
তবে তৃতীয় আসন, মুর্শিদাবাদে ২০১৯ সালে জয়ী তৃণমূলের প্রার্থী আবু তাহেরের অবস্থা সুবিধার নয়।
তাঁর বিপরীতে দাঁড়িয়েছেন সিপিআইএমের হেভিওয়েট সেলিম। ‘সেলিম প্রবল পরিশ্রমও করছেন।
অনেক জায়গাতেই দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের থেকে সিপিআইএমের পতাকা অনেক গ্রামে বেশি। এ অবস্থায় মুর্শিদাবাদ আসনটিতে লড়াই হচ্ছে সমানে সমানে, যেখানে তৃণমূল খুব একটা সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। আবার তারা এখানে জিততেও পারে,’ বললেন সম্প্রতি তৃণমূল ছেড়ে বসে যাওয়া জিম নওয়াজ।
মালদার চিত্র
জিম নওয়াজকে দেখেই কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়, কেন মালদা ও মুর্শিদাবাদের তৃণমূলের অবস্থা সুবিধার নয়। কট্টর বিজেপিবিরোধী জিম অতীতের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের হয়ে সাংগঠনিক কাজকর্মের কিছুটা তদারক করেছেন মুর্শিদাবাদে, বিশেষত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
গত জানুয়ারি মাসে দল ছেড়ে তিনি এককভাবে প্রচার করছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে দক্ষিণ মালদায় তৃণমূল প্রার্থী শাহনওয়াজ আলী রায়হানের বিরুদ্ধে। ওই আসনের ভোটার জিম সেখানে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন বলে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ; যদিও এই অভিযোগ মানতে নারাজ জিম।
তবে জিমের বক্তব্য, দক্ষিণ মালদায় (যেখান থেকে প্রয়াত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গনী খান চৌধুরীর পরিবার ধারাবাহিকভাবে জিতে আসছে) তৃণমূলের মুসলমান সমর্থকের বড় অংশ ভোট দেবে কংগ্রেসকে। গতবারও দিয়েছিল। এই আসনে তৃণমূলের জেতার প্রায় কোনোই সম্ভাবনা নেই।
‘একই সঙ্গে সামান্য হলেও বিজেপির জেতার একটা সম্ভাবনা রয়েছে, কারণ বিজেপি প্রার্থী এখানে সামান্য ভোটের ব্যবধানে গতবার হেরেছিলেন। এবার যদি ৬০ শতাংশের কিছু বেশি মুসলমান ভোট কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে যায়, তবে প্রায় ৪০ শতাংশ হিন্দু ভোট ও কিছু মুসলমান ভোট টেনে শেষ পর্যন্ত জিতে যেতে পারে বিজেপিও,’ বললেন জিম।
উত্তর মালদায় সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়কে প্রার্থী করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। সেখানকার মুসলমান সমাজ প্রার্থী নিয়ে সন্তুষ্ট নয়।
সিপিআইএমের সাবেক নেতা খগেন মুর্মু আদিবাসীদের মধ্যে জনপ্রিয় না হলেও নিজে আদিবাসী হওয়ার কারণে তাঁর কিছুটা প্রভাব রয়েছে সমাজের মধ্যে। বিজেপি প্রার্থী হিসেবে ২০১৯ সালে মুর্মু জিতেছিলেন মালদা উত্তরে। এবারও তাঁর জেতার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় মানুষ। ফলে এই প্রতিবেদন লেখার সময় মনে করা হচ্ছে, মালদা ও মুর্শিদাবাদের পাঁচ আসনের মধ্যে চারটিতেই পিছিয়ে রয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস।
শুভজিৎ বাগচী প্রথম আলোর কলকাতা সংবাদদাতা