আলুর বাজার সহনীয় করা কি আদৌ সম্ভব

বিশ্বব্যাপী আলু একটি সুপরিচিত সবজি। ফ্রেঞ্চফ্রাই পছন্দ করে না, এমন কোনো মানুষই খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলাদেশের মানুষ তরকারি হিসেবে নানাভাবে আলু ব্যবহার করে থাকে। মাছ-মাংসে আলু যেন অপরিহার্য উপাদান। প্রায় সব ধরনের তরকারিতে আলুর ব্যবহার হয়ে থাকে। বাঙালির পান্তার সঙ্গে আলুভর্তা, ভাজা শুকনা মরিচ যেন এক ঐতিহ্যবাহী পছন্দনীয় খাবার। এটি না হলে পয়লা বৈশাখ যেন বরণ করা হয়ই না। অন্য কোনোকিছু না থাকলেও গ্রামের দরিদ্র সাধারণ মানুষজন আলুভর্তার সঙ্গে উঠানে লাগানো গাছের কাঁচা মরিচ দিয়ে নাশতা সেরে ফেলেন।

নভেম্বর মাসে সেই আলুর দাম ১০০ টাকা ছাড়িয়েছিল। বাজারে নতুন আলু উঠেছে। নতুন আলুর চাহিদা বেশি বলে দাম বেশি হয়, তা সঠিক নয়। এটি হয় মূলত মৌসুমের শুরুতে নতুন আলুর জোগান কম থাকার কারণে।

আলু নতুন উঠেছে বলে নয়, গত কয়েক বছরে আলু আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে শুধু এর দাম বেশি হওয়ার কারণে। নতুন আলু ওঠার আগে আগে পুরোনো আলুর দামও বেড়ে যায়। ব্যাখ্যা হিসেবে শোনা যায়, কোল্ডস্টোরেজের খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বেশি। আলুর বাজারে সিন্ডিকেশন হয় বলে দাম বেশি। আলুর চাহিদার তুলনায় জোগান কম বলে দাম বেশি। মানুষ ভাতের পরিবর্তে আলু দিয়ে তৈরি খাবার বেশি খায় বলে দাম বেশি। আলুর বিকল্প ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় আলুর দাম বেশি। আলু রপ্তানি হচ্ছে বলে দাম বেশি। বৃষ্টি বেশি হয়েছে বলে আলু পচে যায়, তাই দাম বেশি। আলু দিয়ে বেগুনি তৈরি করায় আলুর দাম বেশি। বিদ্যুৎ–বিভ্রাট হওয়ায় আলু নষ্ট হয়েছে, তাই দাম বেশি। অন্যান্য সবজির জোগান কম, তাই আলুর দাম বেশি। হঠাৎ বৃষ্টিতে বা বন্যায় অন্যান্য সবজির উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, তাই আলুর দাম বেশি। দাম বাড়ার আরও যে কত ধরনের কারণ শুনছি, তা লিপিবদ্ধ করে শেষ করা প্রায় অসম্ভব বিষয়।

তাহলে কি আলুর বাজার কোনোভাবেই স্থির হওয়ার সুযোগ নেই? এটা তো হতে পারে না। বিষয়টিকে এভাবে দেখা যেতে পারে। বাস্তবে কোনো দ্রব্য ভোগ বা খেয়ে বা পান করে কতটুকু সন্তুষ্টি পাওয়া যায়, তা কোনোভাবেই পরিমাপ করা যায় না। কিন্তু কতগুলো অনুমিত শর্ত ধরে নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা তার ভিত্তিতে দ্রব্য ভোগের সন্তুষ্টি পরিমাপ করতে পেরেছেন। আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সে রকম কিছু একটা করা যায় কি না, সেটা চেষ্টা করে দেখা দরকার।

কৃষি অর্থনীতির গ্র্যাজুয়েট হিসেবে এটা বিশ্বাস আছে যে কিছুসংখ্যক কৃষক ভাইদের সঙ্গে আলোচনা করে যথাযথ তথ্য নিয়ে আমরা আলু উৎপাদনে কেজি বা বিঘাপ্রতি কৃষক ভাইদের কত টাকা খরচ হয়, তা বের করতে পারব। কৃষক ভাইয়েরা কেজিপ্রতি কত টাকা লাভ চান, তা পাওয়া কঠিন কিছু নয়। এবার যাঁরা আলু কিনে সংরক্ষণ করবেন, তাঁদের মোট খরচ এবং তাঁরা কত টাকা কেজিপ্রতি লাভ চান, তাঁর একটা অনুমান করতে পারলে পাইকার ও আড়তদারদের লাভের অংশ কত হতে পারে, তা অনুমান করা যাবে। এবার আসে, খুচরা বিক্রেতারা কত টাকায় বিক্রি করবেন, তার হিসাব করা।

হিসাবের সুবিধার্থে যদি এভাবে ধরে নিই যে একজন আলুচাষির সব খরচ হিসাব করে দেখা গেল যে প্রতি কেজির উৎপাদন খরচ ২০ থেকে ২২ টাকা (২০১৯ সালে কৃষকপর্যায়ে ১ কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ছিল ১০ দশমিক ৫৬ টাকা এবং তাঁদের বিক্রয়মূল্য ছিল ১৩ দশমিক ৮৮ টাকা)। কেজিপ্রতি তাঁরা কমপক্ষে ২ থেকে ৩ টাকা লাভ আশা করেন। তাহলে কৃষক ভাইদের বিক্রয়মূল্য হবে ২২ থেকে ২৫ টাকা।

যাঁরা আলু ক্রয় করে হিমাগারে সংরক্ষণ করে থাকেন, তাঁদের সব খরচ হিসাব করে যদি দেখা যায়, হিমাগারে আলু সংরক্ষণে তাঁদের কেজিপ্রতি খরচ ৪ থেকে ৫ টাকা এবং তাঁদের নিজেদের লাভ কেজিপ্রতি ৩ টাকা আশা করেন, তাহলে দেখা যায় সংরক্ষণকারীর বিক্রয়মূল্য হবে প্রতি কেজি ২৯ থেকে ৩৩ টাকা। পরিবহন খরচসহ পাইকারের মাধ্যমে আড়তদারের কমিশন যোগ করে খুচরা বিক্রেতার ক্রয়মূল্য হতে পারে সর্বোচ্চ ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা। খুচরা বিক্রেতা কেজিতে ৩ থেকে ৪ টাকা লাভ আশা করবে। তাহলে অনুমিত হিসাবমোতাবেক আলুর খুচরা মূল্য সর্বোচ্চ ৩৮ থেকে ৪২ টাকা হতে পারে।

ছোট পরিসরে গবেষণার মাধ্যমে এ হিসাব করা যেতে পারে এবং হিসাবটা সরকারের কৃষি বিপণন কর্মকর্তাদের মাধ্যমেও করা সম্ভব। গবেষণালব্ধ ফলাফলের ভিত্তিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বাজার পর্যবেক্ষণ ও অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে তদারকি করলে তাতে কারা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, সেটা বের হয়ে আসবে। তবে বাজারে যদি আলুর চাহিদা অনেক বেশি থাকে, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বাজার অস্থিতিশীল থাকবে। সে ক্ষেত্রে বাজারে আলুর চাহিদা ও জোগানের সঠিক তথ্য থাকা খুবই জরুরি। সে কাজটিও সরকারকেই করতে হবে ও নিয়মিতভাবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য যাচাই ও তুলনা করে বছরওয়ারি হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করলে আলুর বাজার বিষয়ে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া সম্ভব হবে।

বছরভেদে বর্ধিত চাহিদা অনুমান করে উৎপাদন বাড়ানো বা কমানোর পরামর্শ দেওয়া যেতে পারে। জাতীয় পর্যায়ে একটি কৃষিদ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ কমিশন থাকলে তাঁরা ছোট ছোট গবেষণা পরিচালনা করে উৎপাদন বৃদ্ধি, মূল্য নির্ধারণ, প্রয়োজনে আমদানি ও অন্যান্য আশুকরণীয় বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারেন।

এ বিষয়ে কৃষি বিপণন কর্মকর্তারাও নিবিড়ভাবে কাজ করতে পারেন। জেলা ও বিভাগওয়ারি মূল্যের পার্থক্য থাকতে পারে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হলে সেটা বিবেচনায় নিয়ে দাম নির্ধারণ করাও খুব কঠিন কাজ নয়। আসলে কঠিন সমস্যা তখনই হয়, যখন অপরিকল্পিতভাবে পরিকল্পনা করা হয় এবং তার ভিত্তিতে কোনোকিছুর সমাধান বের করতে চাওয়া হয়। এসব ক্ষেত্রে একটি ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ধৈর্যসহকারে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অত্যন্ত জরুরি। সেটা করা যাচ্ছে না বলেই বারবার কৃতকার্য হওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

বিবিএসের সূত্র মোতাবেক ২০২২-২৩ সালে দেশী ও উফশী জাত মিলে আলুর মোট উৎপাদন হয়েছে ১ কোটি ৪ লাখ ৩১ হাজার ৭৩৬ মেট্রিক টন (বিবিএস, ২০২৩)। আর চাহিদা ৮৫-৯০ লাখ মেট্রিক টন। সারা দেশের ৪৩ জেলায় ৩৬৫টি হিমাগারে মোট আলু সংরক্ষণ করা যায় প্রায় ৩০ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদন বেশি হলেও বীজের জন্য প্রায় ১০-১৫ শতাংশ আলু রেখে দিতে হয় (২০২০ সালের বিএআরসির গবেষণায় ১০ দশমিক শূন্য ৬ লাখ মেট্রিক টন আলু বীজের জন্য রাখার কথা হয়েছিল)।

এ ছাড়া বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১১টি দেশে আলু রপ্তানি হয়। কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায় যে ২০২৪ সালে ১ দশমিক ৮ লাখ মেট্রিক টন রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে, যা আগের ধারাবাহিকতার চেয়ে কিছুটা বেশি। বীজের জন্য জমা রেখে, আলুর বিকল্প ব্যবহার এবং রপ্তানির পরিমাণ বিবেচনায় নিলে চাহিদার তুলনায় আলুর জোগান উদ্বৃত্ত থাকে না বললেই চলে।

এ ছাড়া আলু সংরক্ষণ সঠিকভাবে করা না গেলে ঘাটতির প্রবণতা থেকেই যায়, সে কারণে আলুর বাজার স্থিতিশীল রাখা কঠিনই হবে। এই বাস্তবতায় আলুর দাম বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল সঠিক বলে মনে হয় না; বরং আলুর উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া বেশি যুক্তিযুক্ত এবং স্বল্প মেয়াদে জোগান বাড়ানোর জন্য আলু আমদানির সিদ্ধান্ত বেশি কার্যকর বলে মনে হয়। কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য ব্যতীত ঢালাওভাবে কৃষিদ্রব্যের বাজারে সিন্ডিকেশন হচ্ছে বলে সরকার যে অজুহাত দেয়, তা বাজারকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলে। কারণ, এতে সৎ ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হন। কোনো অসাধু চক্র সিন্ডিকেট করে অহেতুক সরবরাহকে বাধাগ্রস্ত করলে সরকার সেটা অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে দেখভাল করবে এবং তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেবে, এটা সরকারেই দায়িত্ব।

কৌশলগত কারণে উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে নজর দেওয়া জরুরি। আলুচাষিদের সময়মতো ভালো ও উচ্চফলনশীল বীজ সাশ্রয়ী দামে সরবরাহ করে, সার, কীটনাশক ও সেচে ভর্তুকি দিয়ে সাশ্রয়ী দামে প্রদান করলে, উন্নত প্রযুক্তির বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে এবং উৎপাদিত আলু সঠিকভাবে বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করা হলে উৎপাদনের পরিমাণ বাড়বে এবং কম মূল্যে পাওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।

বোরো ধানের মতো আলুর উৎপাদন কম ঝুঁকিপূর্ণ সময়ে হয় বলে উৎপাদন খরচ কমাতে পারলে আলু উৎপাদনে চাষি ভাইয়েরা এগিয়ে আসবেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল ব্যাহত না হলে বছরব্যাপী চাহিদামতো আলু সরবরাহ করা কঠিন কাজ হবে না। এভাবে বাজারে আলুর সরবরাহ বাড়াতে পারলে দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে।

সমস্যার সমাধানে গবেষণা অত্যন্ত জরুরি। ২০১৯ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের উদ্যোগে নিত্যপণ্য, যেমন চাল, আলু, পেঁয়াজের ওপর কম সময়ের মধ্যে একটি গবেষণা করে তার ফলাফল উপস্থাপন করা হয়। সেখানে মূল্যবৃদ্ধির কারণগুলো বের করার চেষ্টা করা হয় এবং সরকারের কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান সেগুলো নিরসনে কাজ করতে পারে, তারও সুপারিশ করা হয়। আসলে প্রতিবছরই গবেষণা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। কারণ, কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যাপক পরিবর্তনশীল। আলু উৎপাদনে সময় ও পরিমাণে বেশি হওয়ায় এটির ব্যবস্থাপনা খুব সহজ নয়। তবে সরকারের যথাযথ উদ্যোগ থাকলে পর্যায়ক্রমে এগুলোর সমাধান বের করা সম্ভব।

কোনো হিসাবই কার্যকর হবে না, যদি না সবাই মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে সমাজ বা দেশের মানুষকে সেবা দিতে না চান। তবে এ কথা সত্য যে যত দিন আমরা উন্নত ও স্থিতিশীল অর্থনীতিতে প্রবেশ করতে না পারব, তত দিন বৈষম্য থাকবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে এবং মানুষ নিজের স্বার্থের আগে অন্যের স্বার্থ চিন্তা করবে, এটিই প্রত্যাশিত। পৃথিবীর বহু দেশে এভাবেই ধারাবাহিক উন্নয়ন হয়েছে। আমাদের দেশও পারবে। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন আমরাও একটি উন্নত অর্থনীতির দেশে পদার্পণ করব। আর তখন অবশ্যই মূল্যস্ফীতি কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে থাকবে এবং সামগ্রিকভাবে বাজার স্থিতিশীল হবে।

  • মো. সাইদুর রহমান অধ্যাপক ও সাবেক বিভাগীয় প্রধান, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এবং সহসভাপতি, বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি।

    ই–মেইল: [email protected]