মেয়র, আপনার ফাঁপর কোথায়!

আমরা তো জালিয়াতির মধ্যেই আছি। সাগরে পেতেছি শয্যা, শিশিরে কী ভয়! আমাদের ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিক সাহেবের তাই প্রতারণা-জালিয়াতি বিষয়ে কোনো বাতিক নেই, ছুতমার্গ নেই। পাশে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামকে নিয়ে তিনি দেনদরবার করে, মঞ্চ বানিয়ে, শামিয়ানা টাঙিয়ে, মাইক লাগিয়ে, চারদিকে টেলিভিশনের ক্যামেরা চালিয়ে, ফটোসাংবাদিকদের ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক বাজিয়ে উদ্বোধন করলেন মশা মারার এক বিশেষ পদ্ধতি—জৈব কীটনাশক প্রয়োগ। সেই কীটনাশকের নাম বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস (বিটিআই)। এটা পানিতে দিলে মশার লার্ভা মারা যাবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন বলেছিল, এই জৈব আনতে হবে সিঙ্গাপুর থেকে। তো সরবরাহকারীরা হলুদ রঙের প্যাকেটে ‘মেড ইন সিঙ্গাপুর’ দেখিয়ে একটা জিনিস ধরিয়ে দিয়েছেন মেয়র ও বেচারা মন্ত্রীর হাতে! শুধু কি হলুদ প্যাকেট, সঙ্গে এনেছে একজন বিদেশি মানুষকে, তাঁর নাম তারা বলেছে মি. লি শিয়াং; পরিচয় দিয়েছে সিঙ্গাপুরের বেষ্ট কেমিক্যালের রপ্তানি ব্যবস্থাপক (এক্সপোর্ট ম্যানেজার) এবং বিটিআই বিশেষজ্ঞ।

আরও পড়ুন

এ খবর দেখে সিঙ্গাপুরের বেষ্ট কেমিক্যালের চক্ষু চড়কগাছ! তারা ফেসবুকে প্রতারণা সতর্কবার্তা প্রকাশ্যে প্রচার করেছে, লি শিয়াং নামের তাদের কোনো কর্মকর্তা নেই এবং ঢাকার মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের মাধ্যমে পাঁচ টন বিটিআই লার্ভিসাইড সরবরাহ করা হয়নি। ঢাকার মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড সিঙ্গাপুরের বেষ্ট কেমিক্যালের নিযুক্ত কোনো পরিবেশকও নয়। সিঙ্গাপুরওয়ালারা স্পষ্ট অক্ষরে লিখে দিয়েছে, যা হয়েছে তা হয়েছে ফ্রডলি, মানে প্রতারণাপূর্ণ, মানে জালিয়াতিময়।

শুনে মরমে মরমে শরমে মরে যাই। এত বড় অনুষ্ঠান শেষে এত বড় প্রতারণার শিকার হওয়ার পর ঢাকার একজন নাগরিক এবং মেয়র আতিকের বানানো ফুটপাতগুলোর একজন পথিক হিসেবে আমি পরম শরমিন্দা। নগরের পিতা আতিক কাকার কোনো বিকার দেখছি না। তিনি বলছেন, সাপ্লায়ারকে নোটিশ দেওয়া হয়েছে, তারা প্রমাণ করুক যে তারা সিঙ্গাপুর থেকেই জৈবটি এনেছে। আমাদের কী! আমরা পরীক্ষা করে দেখেছি, এই জৈব দৈব গুণসম্পন্ন, এতে কাজ ‘হইব’। আমাদের চাই কাজ! বটে!

আমাদের নগরপিতা আশায় আশায় আছেন, তাঁর সরবরাহকারী প্রমাণ করবেন, ওষুধ সিঙ্গাপুর থেকেই আনা হয়েছে এবং বেষ্ট কেমিক্যাল থেকেই আনা হয়েছে। যদি তা হয়, তাহলে নগরের সবচেয়ে বোকা লোকের নামের তালিকায় আমরা মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের নাম বসিয়ে দেব।

টেন্ডারে আপনি যদি বলেন, সিঙ্গাপুর থেকে আনতে হবে, আর সাপ্লায়ার যদি আনে চীন থেকে, তা ঘোরতর নিয়মভঙ্গ। আর সিঙ্গাপুরের বেষ্ট কোম্পানির লি শিয়াং নামে অভিনয় করতে যে অভিনেতাকে ভাড়া করে আনা হয়েছিল, তার ব্যাপারে কী হবে, আতিক স্যার! এ ব্যাপারও কি মার্শালকেই প্রমাণ করতে হবে যে এই লি শিয়াং আসলেই সিঙ্গাপুরের বেষ্ট কেমিক্যালের কর্মীই ছিলেন!

বলছি, আমরা জালিয়াতির ভেতরেই আছি। দিনে আছি এবং রাতে আছি। জোটে আছি এবং ভোটে আছি। রাতে মশা, দিনে মাছি! এ নিয়ে ঢাকা শহরে আছি। প্রতারণার অনেক গল্পই তো আমরা শুনে এসেছি। বীরবলের গল্প আছে।

আরও পড়ুন

বাদশা আকবরের কাছে এল এক বিদেশি ঘোড়া ব্যবসায়ী। বাদশা তাঁকে ১৫টা ঘোড়ার দাম দিলেন অগ্রিম। পরের বছর ঘোড়াগুলো সে এনে দেবে। বীরবল তখন রাজ্যের সবচেয়ে বড় বোকার নামের তালিকা তৈরি করছিলেন। এক নম্বর নামটা বীরবল লিখলেন বাদশা আকবরের। বাদশা বললেন, সে কী! কেন! বীরবল বললেন, যে মানুষ একজন অচেনা বিদেশিকে ঘোড়ার দাম অগ্রিম দিতে পারে, তার চেয়ে বড় বোকা আর কে হতে পারে? বাদশা বললেন, একটা বছর অপেক্ষা করো। সামনের বছর ঘোড়া নিয়ে তো এই ব্যবসায়ী আসতেও পারে।

বীরবল বললেন, তাহলে তো খুব সোজা। আপনার নামটা কেটে আমি এই ব্যবসায়ীর নাম বোকার তালিকায় বসিয়ে দেব।

আমাদের নগরপিতা আশায় আশায় আছেন, তাঁর সরবরাহকারী প্রমাণ করবেন, ওষুধ সিঙ্গাপুর থেকেই আনা হয়েছে এবং বেষ্ট কেমিক্যাল থেকেই আনা হয়েছে। যদি তা হয়, তাহলে নগরের সবচেয়ে বোকা লোকের নামের তালিকায় আমরা মার্শাল অ্যাগ্রোভেটের নাম বসিয়ে দেব।

কিন্তু তা যতক্ষণ না হচ্ছে, ততক্ষণ আমাদের এ তালিকায় আতিক সাহেবের নামটাই রাখতে হচ্ছে। সিঙ্গাপুরের কোম্পানি প্রতারণার সতর্ক সংকেত জারি করার পরও যাঁর বিশ্বাসে চিড় ধরছে না। আতিক সাহেব রবীন্দ্রানুরাগী, তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষের ওপরে বিশ্বাস হারানো পাপ!

সবই না হয় হবে, কিন্তু বেষ্ট কেমিক্যালের প্রতিনিধি হিসেবে যে লি শিয়াংকে আনা হলো, সে ব্যাপারটার ব্যাখ্যা কী!

আরও পড়ুন

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতারণার অনেক বড় বড় ঘটনা এর আগেও হয়েছে। তাজমহল তিন-তিনবার বিক্রি করে দিয়েছিল ভারতের নটবর লাল, যিনি মারা গেছেন সম্ভবত ২০০৯ সালে। আর প্যারিসের আইফেল টাওয়ার দু-দুবার বিক্রি করে দিয়েছিল আমেরিকান প্রতারক ভিক্টোর লাস্টিগ। এটা ঘটেছিল আজ থেকে ৮০-৯০ বছর আগে।

আমাদের লোককাহিনি অবলম্বনে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী কবিতা লিখেছিলেন—‘উলঙ্গ রাজা’। রাজাকে এক প্রতারক বলল, আমি এমন কাপড় এনে দেব, তা শুধু বুদ্ধিমানেরা দেখে, বোকারা কেউ দেখে না। তারপর রাজাকে সে তুলে দিল তার কাল্পনিক না-পোশাক। রাজা নিজেকে বোকা প্রমাণ না করার স্বার্থে তা-ই পরে নগ্নবেশে জনাকীর্ণ রাজপথ দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী লিখেছেন:

সবাই দেখছে যে, রাজা উলঙ্গ, তবুও
সবাই হাততালি দিচ্ছে।

সবাই চেঁচিয়ে বলছে; শাবাশ, শাবাশ!

কারও মনে সংস্কার, কারও ভয়;

কেউ-বা নিজের বুদ্ধি অন্য মানুষের কাছে বন্ধক দিয়েছে;

কেউ-বা পরান্নভোজী, কেউ

কৃপাপ্রার্থী, উমেদার, প্রবঞ্চক...

জমে উঠছে

স্তাবকবৃন্দের ভিড়।

কিন্তু সেই শিশুটিকে আমি
ভিড়ের ভেতরে আজ কোথাও দেখছি না।
...
সে এসে একবার এই উলঙ্গ রাজার সামনে
নির্ভয়ে দাঁড়াক।

সে এসে একবার এই হাততালির ঊর্ধ্বে গলা তুলে
জিজ্ঞাসা করুক:

রাজা, তোর কাপড় কোথায়?

আতিক সাহেবকে এত কড়া কথা বলতে পারব না, তবে এটা তো বলতে পারব, মেয়র, আপনার ফাঁপর কোথায়!

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক