একটা যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু যুদ্ধের জয়-পরাজয় অনিবার্যভাবেই নির্ধারণ করে দেয় প্রযুক্তি এবং যুদ্ধক্ষেত্রের নীতি ও কৌশল। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক যুদ্ধ কীভাবে বদলে যাচ্ছে, তারই দৃষ্টান্ত এই যুদ্ধ। ন্যাটোর জন্য দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হচ্ছে, এই যুদ্ধ তাদের জন্য খারাপ সংবাদের আগাম বার্তা নিয়ে এসেছে।
একেবারে নিখাদ একটি সত্যি হচ্ছে ইউক্রেনীয়দের কাছে আকাশপথে যুদ্ধ করার মতো শক্তি নেই এবং রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিরোধ করার মতো সামর্থ্যও তাদের নেই। ন্যাটো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সমর্থনের ওপর তারা নির্ভরশীল।
এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো ১০০ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দিয়েছে ইউক্রেনকে। প্রতিদিন গড়ে ১০০ মিলিয়ন ডলার। এত বিপুল সহায়তা দেওয়ার পরও রাশিয়া যে ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে, তার সামান্যটাই পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এ যুদ্ধে ইউক্রেনের বিশাল জনবল ও সম্পদ ক্ষয় হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে ন্যাটোর প্রতিটি দেশকে যে সামরিক বাজেট বাড়াতে হয়েছে, সেই হিসাবও এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে।
দৃষ্টান্ত হিসেবে, পোল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে প্যাট্রিয়ট ডিফেন্স সিস্টেম এবং ১২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে অ্যাপাচি হেলিকপ্টার কিনেছে। জার্মানি ইসরায়েলের কাছ থেকে সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে অ্যারো আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনেছে। পোল্যান্ড তাদের জিডিপির ৪ শতাংশ সামরিক খাতে ব্যয় করার অঙ্গীকার করেছে। এটা ন্যাটোর যেকোনো দেশের তুলনায় সবচেয়ে বেশি। ন্যাটোর ৩০ সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র আটটি দেশ লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সামরিক খাতের বাজেটের ২ শতাংশ ব্যয় করে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, অনেক ধরনের কাঁচামালের জন্য চীনের ওপর নির্ভর করতে হয়। সম্প্রতি মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রেথিয়নের চেয়ারম্যান জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইলেকট্রনিক, বিরল ধাতুসহ অস্ত্র তৈরির কিছু পণ্য রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে চীন। একই সমস্যা ন্যাটোকে অন্য যেকোনো যুদ্ধের ক্ষেত্রে মোকাবিলা করতে হবে। শত্রু যখন আক্রমণ করবে সে সময় তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদন বন্ধ রাখতে হবে
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ন্যাটো ইউক্রেনকে আকাশ থেকে নজরদারি করার ও লক্ষ্যবস্তুর তথ্য জানার প্রযুক্তি দিয়েছে। কৃষ্ণসাগরে আন্তর্জাতিক আকাশসীমায় ড্রোন ও ইলেকট্রনিক এয়ারক্র্যাফটের মাধ্যমে এসব তথ্যের অনেকটা পাচ্ছে ইউক্রেন।
তথ্যপ্রযুক্তির এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে লক্ষ্যবস্তুর তথ্য জানতে যে পারা যাচ্ছে, সে জন্য ইলন মাস্কের স্টারলিংককে ধন্যবাদ দিতেই হয়। কেননা, নিমেষেই এসব তথ্য কমান্ডারের স্মার্টফোনে চলে আসছে। একই সঙ্গে হিমার্সের মতো স্মার্ট অস্ত্রের কার্যকারিতাও উন্নত হয়েছে। আকাশ থেকে নজরদারির এই ব্যবস্থা রাশিয়ার সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য গতিপথ সম্পর্কে ধারণা করা যাচ্ছে। যেটা অতীতে অসম্ভব ব্যাপার ছিল।
দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে, ন্যাটো রাশিয়া কিংবা অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে ভবিষ্যতে যদি বড় কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তাহলে এই সুবিধা কাজে লাগাতে পারবে না। ইউক্রেনে ন্যাটোর ব্যাপক সম্পৃক্ততা থাকা সত্ত্বেও আকাশপথে আসা হুমকি প্রতিরোধের ব্যাপারে রাশিয়া অনেক বেশি সফলতা পেয়েছে। চীন ও রাশিয়া তাদের স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এ সাফল্য পাচ্ছে। অনেক স্মার্ট অস্ত্র কীভাবে পরাজিত করা যায়, সেটা রুশরা শিখেছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে অনবরত বলা হচ্ছে, তারা হিমার্স ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করেছে এবং স্মার্ট অস্ত্র ও ড্রোন ধ্বংস করছে।
অন্যদিকে মিশ্র ড্রোন হামলা অথবা এমনকি মাঝারি ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকানোর ক্ষেত্রে ন্যাটো এখনো পিছিয়ে রয়েছে। এর কারণ হলো, আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার বিষয়টি উপেক্ষা করা হচ্ছে অথবা পারমাণবিক হুমকির দিকেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত ইউরোপের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাও দুর্বল। এ দুর্বলতা কৌশলগত ক্ষেত্রেও রয়েছে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর হাতে থাকা আদিকালের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ঠেকাতে নিজেদের শক্তি ব্যয় করছে যুক্তরাষ্ট্র।
এর বড় দৃষ্টান্ত হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী সম্প্রতি ইসরায়েলের তৈরি করা কার্যকর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আয়রন ডোম নিতে অস্বীকৃতি জানায়। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাঘাঁটিগুলোকে ইরানের হাত থেকে রক্ষার জন্য এই ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারত। এর বদলে যুক্তরাষ্ট্রে তাদের নিজস্ব ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইছে। কিন্তু এ জন্য কত বছর অপেক্ষা করে থাকতে হবে, সেটা কেউ জানে না।
অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র সোয়ার্মিং ড্রোন হামলা (একই সঙ্গে বিভিন্ন ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা) যে সমস্যা তৈরি করছে, সে বিষয়টি স্বীকার করেছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার এ ধরনের হামলা ভূমিতে থাকা আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য অনেক বড় সমস্যা তৈরি করেছে। ট্যাংকের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা সত্যি। রুশদের হাতে ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে এত বেশিসংখ্যক জার্মান লেপার্ড ট্যাংক ধ্বংস হচ্ছে কেন? অত্যাধুনিক সাঁজোয়া যান হওয়া সত্ত্বেও লেপার্ড ট্যাংকের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কার্যকর বলে প্রমাণিত হচ্ছে না কেন? এর কারণ হলো, এই ট্যাংকগুলো ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র কিংবা মর্টারের বিরুদ্ধে যতটা কার্যকর, মাইন কিংবা ভারী গোলাবর্ষণ ঠেকাতে সেগুলো ততটা কার্যকর নয়।
যেকোনো যুদ্ধে প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ যেমন প্রয়োজন, সেই সঙ্গে পুরোনো অস্ত্রের জায়গায় নতুন অস্ত্রও প্রয়োজন। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে ন্যাটোর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুতে টান ধরেছে। যুদ্ধ এক বছর পেরোনোর পর যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা অস্ত্র তৈরির ঠিকাদারদের কাছে আরও গোলাবারুদ ও স্মার্ট অস্ত্র তৈরির কার্যাদেশ দেয়। কিন্তু খুব দ্রুতই সমস্যা সামনে চলে আসে।
অনেক কারখানা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকায় নতুন কারখানা স্থাপনের প্রয়োজন পড়ছে। সরবরাহ শৃঙ্খলাও নতুন করে তৈরি করতে হচ্ছে। অভিজ্ঞ কর্মী ও প্রকৌশলী খুঁজে পাওয়াটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, অনেক ধরনের কাঁচামালের জন্য চীনের ওপর নির্ভর করতে হয়। সম্প্রতি মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রেথিয়নের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ইলেকট্রনিক, বিরল ধাতুসহ অস্ত্র তৈরির কিছু পণ্য রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে চীন।
একই সমস্যা ন্যাটোকে অন্য যেকোনো যুদ্ধের ক্ষেত্রে মোকাবিলা করতে হবে। শত্রু যখন আক্রমণ করবে সে সময় তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদন বন্ধ রাখতে হবে।
ইউক্রেন ও নিজেদের নিরাপত্তার জন্য ন্যাটোর অস্ত্র ও গোলাবারুদ ভান্ডার মোটেও পর্যাপ্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো কেন তাদের ফুরিয়ে আসা ভান্ডার নষ্ট করছে, সেটা এখন বড় প্রশ্ন। ইউরোপ ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা যখন দুর্বল হয়ে পড়ছে, তখন সে প্রশ্নটিই বড় করে সামনে আসছে।
স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড দ্য ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত