কিছু বিষয় এরই মধ্যে পরিষ্কার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর সরকার ও আওয়ামী লীগ শুরুতে যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, তারা আর সেখানে নেই। ভিসা নীতি এখন তাদের কাছে ক্ষমতা পরিবর্তন বা বদলের ষড়যন্ত্র। সেই সূত্রে আন্তর্জাতিকভাবেও কিছু বিষয় আরও খোলামেলাভাবেই প্রকাশ হতে শুরু করেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে চীন সরকার যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাতে বাংলাদেশ প্রশ্নে দুটি দেশের সরাসরি বিরোধপূর্ণ অবস্থানটি বোঝা যাচ্ছে।
মাস কয়েক আগে একটি লেখা লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে, বিপদও কি বাড়ল’, প্রথম আলো, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩। এখন বাংলাদেশ ও এর নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যখন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন অনেকটা মুখোমুখি পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন একে আমরা কীভাবে দেখব? আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ আমরা পাচ্ছি। তাতে এটা পরিষ্কার যে সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে এই বিরোধ আরও বাড়বে। কিন্তু যা এখনো পরিষ্কার নয়, তা হচ্ছে এসবের ফলে বাংলাদেশের নির্বাচনটি জনগণের চাওয়া অনুযায়ী অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে কি না? নাকি ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন হবে নতুন কোনো কৌশলে?
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনটি অবাধ ও নিরপেক্ষ করা। ভিসা নীতির বাইরেও আগামী নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য করার প্রক্রিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নানা তৎপরতার কথা শোনা যায়। এর বিপরীতে চীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তার সমর্থন জানিয়ে বলেছে, সব ধরনের আধিপত্যবাদ ও ক্ষমতার রাজনীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে কাজ করতে তারা প্রস্তুত আছে। চীনের এই অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিনের মন্তব্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি, এর আগে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং এসব নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিভিন্ন মন্তব্য ও কঠোর অবস্থান প্রশ্নে চীনের সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমস–এর প্রশ্নেরও জবাব দিয়েছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো আমাদেরও নজরে এসেছে।
প্রকৃতপক্ষে একটি দেশ নিজেদের বর্ণবৈষম্য, বন্দুক সহিংসতা ও মাদকের বিস্তারের সমস্যার দিকে চোখ বন্ধ রেখে দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অজুহাতে বাংলাদেশসহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুধু বাংলাদেশের জনগণেরই বলিষ্ঠ অবস্থানের কথা বলেননি, তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশের, বিশেষত উন্নয়নশীল বিশ্বের মনের কথা বলেছেন।
ভূরাজনীতির বিবেচনায় বাংলাদেশ ও এর আগামী নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার, চীনের অবস্থানও পরিষ্কার। ভারত কি আগের দুটি নির্বাচনের মতোই আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে রাখঢাক ছাড়াই অবস্থান নেবে, নাকি এখানে অবস্থানের কোনো বদল হবে? বিজেপির সাবেক মন্ত্রী ও সাংবাদিক এম জে আকবর গত জানুয়ারিতে এক সম্মেলনে বলেছেন, শেখ হাসিনা সম্পর্কে ভারতের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং তিনি দেশের গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছেন।
আগামী নির্বাচন ও যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ নীতির ব্যাপারে চীনের অবস্থানটি বোঝা গেল। কিন্তু একই বিষয়ে ভারতের অবস্থান কী, তা নিয়ে সব মহলে কৌতূহল থাকলেও এ ব্যাপারে তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ভারতীয় পত্রপত্রিকার অধিকাংশ বিশ্লেষণে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও অবস্থানের সমালোচনা করে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতিই সমর্থন প্রকাশ পেয়েছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এসব লেখালেখিতে অবশ্য বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা বা প্রসঙ্গ খুব একটা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। ভারতের আঞ্চলিক ভূরাজনীতির হিসাব-নিকাশই সেখানে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনের অবস্থান প্রকাশের পর ভারতের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত মতামতধর্মী এক প্রতিবেদনে (বেইজিং বিটস নিউ দিল্লি ইন রেইস টু এইড শেখ হাসিনা লেড গভর্নমেন্ট, ১৫ জুন) মন্তব্য করা হয়েছে, শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি সমর্থনের ক্ষেত্রে বেইজিং নতুন দিল্লিকে হারিয়ে দিয়েছে। টেলিগ্রাফ–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য যে ভিসা নীতি নিয়েছে এবং এর আগে র্যাবের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, সে ব্যাপারে দেশটি দুই প্রতিবেশী পরাশক্তির কাছ থেকে সমর্থন আশা করছিল। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সরকারের জন্য যখন সমর্থন জরুরি, তখন শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী মন্তব্যকে সমর্থন জানিয়ে চীন যে অবস্থান জানিয়েছে, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে নিয়ে ভারত-চীনের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানটি টের পাওয়া যায় এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে।
এখন সবাই তাকিয়ে আছেন ওয়াশিংটনে বাইডেন-মোদির বৈঠকের দিকে। বিশ্লেষকদের ধারণা, দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ের মধ্যে বাংলাদেশ এবং এর আগামী নির্বাচনও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বাংলাদেশের নির্বাচন প্রশ্নে ভারতের অবস্থান কী, বা বাংলাদেশ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অবস্থান মিলবে কি না, তা ওই বৈঠকের পর স্পষ্ট হবে বলে ধারণা করা যায়। আমরা চাই বা না চাই, বাংলাদেশের নির্বাচন এখন একটি বৈশ্বিক ইস্যু। যুক্তরাষ্ট্রের কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনস (সিএফআর) যে পাঁচটি নির্বাচনকে বিশ্বের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে, তার মধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচনও রয়েছে।
বিশ্ব গণমাধ্যমেও সেই একই কারণে চলছে নানা বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাউথ এশিয়া পারস্পেক্টিভের (এসএপি) এক নিজস্ব পর্যালোচনায় (ইজ এ ইউএস চায়না ফেস-অফ ইন দ্য মেকিং ইন বাংলাদেশ? ১৫ জুন) চীনের সমালোচনা করে লেখা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও দুই দলের আইনপ্রণেতারা যখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও একটি অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য চাপ দিচ্ছে, তখন বর্তমান সরকারের কর্তৃত্ববাদী চর্চাকে রক্ষায় এগিয়ে আসছে চীন। সেখানে প্রশ্ন তোলা হয়েছে বাংলাদেশকে কি তবে দক্ষিণ এশিয়ার ‘গ্রেট গেম’–এ নামানো হলো এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মুখোমুখি দাঁড়ানোর মঞ্চ হিসেবে বিবেচিত হবে দেশটি?
এসএপির বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, রাশিয়া আগে থেকেই হাসিনা সরকারের প্রতি তার সমর্থন জানিয়ে রেখেছে। আর ভারত প্রশ্নে বলা হয়েছে, হাসিনা সরকারের ‘ঘনিষ্ঠতম মিত্র’ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। কিন্তু ভারতের বিশ্লেষকদের অনেকে বাংলাদেশের ওপর আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি এই অঞ্চলে ভারতের প্রভাব কমানোর একটি চেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করেন।
এসএপির মন্তব্য, বোঝা যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি, বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচন নিয়ে দুই বিরোধী পরাশক্তি মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। নির্বাচনের আরও প্রায় সাত মাস সময় রয়েছে, বাংলাদেশ নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে।
ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিস (ইউএসআইপি) যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। এর সিনিয়র অ্যাডভাইজার জিওফ্রে ম্যাকডোনাল্ড লিখেছেন, বাংলাদেশ ইন্দো-প্যাসিফিকে ক্রমাগত গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়ে পরিণত হচ্ছে। ইউএসআইপির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে (থ্রি থিংস টু ওয়াচ অ্যাজ বাংলাদেশ’স ন্যাশনাল ইলেকশন সিজন হিটস আপ) তিনি লিখেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের যে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক স্বার্থ, তাতে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষার বিষয়টি খুবই জরুরি।
কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিকাশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের যে অবস্থান, তাতে সামনের দিনগুলোতে এ নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিরোধ বাড়তে পারে। এ প্রসঙ্গে তিনি ২০২০ সালে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বিগানের একটি মন্তব্য স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিকে ‘প্রধান অংশীদার’ হিসেবে এবং ‘ওই অঞ্চলে আমাদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে’ পেতে চায়।
ভূরাজনীতির বিবেচনায় বাংলাদেশ ও এর আগামী নির্বাচন প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পরিষ্কার, চীনের অবস্থানও পরিষ্কার। ভারত কি আগের দুটি নির্বাচনের মতোই আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে রাখঢাক ছাড়াই অবস্থান নেবে, নাকি এখানে অবস্থানের কোনো বদল হবে? বিজেপির সাবেক মন্ত্রী ও সাংবাদিক এম জে আকবর গত জানুয়ারিতে এক সম্মেলনে বলেছেন, শেখ হাসিনা সম্পর্কে ভারতের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে এবং তিনি দেশের গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করছেন।
ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের মুখে আমরা শুনেছি, ‘শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি আমাদের পুরো সমর্থন রয়েছে।’ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভারতের বর্তমান অবস্থান কী, সেটার জন্য অনেকেই ২২ জুন বাইডেন-মোদির বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করছেন। তবে ভারতের অবস্থানে খুব হেরফের হবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন না।
আমাদের দুর্ভাগ্য, যাঁরা বাংলাদেশ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সমালোচনা করছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ মনে করছেন, তঁারাই আবার চীনের অবস্থানে খুশি হচ্ছেন, ভারতের সমর্থনের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন কী হবে, তা নির্ধারণের ক্ষমতা কি তবে আমাদের হাতে নেই?
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক