নদী দেখতে গিয়ে ভূমিহীন কচির আলীর সঙ্গে দেখা তিস্তার চরে। ২৫ মার্চ, বিকেলে। তখন তিস্তার চর থেকে ফিরছি।
পঁয়ষট্টি-ঊর্ধ্ব কচির আলীর মাথা লুঙ্গি দিয়ে মোড়ানো। কাঁধে ব্যাগ। বাঁ পায়ের গোড়ালি একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ দিয়ে বাঁধা। নৌকায় উঠে বসলেন।
কচির আলীর পা বাঁধার কারণ জিজ্ঞাসা করি। বললেন, তাঁর পায়ের গোড়ালি ফেটে গেছে। এক মাস ধরে গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছ থেকে ওষুধ নিচ্ছেন। কিন্তু ভালো হচ্ছে না। এদিকে তামাকখেতে কাজ করতে হয়। তাই পা বেঁধে রেখেছেন, যাতে চরের বালুতে হাঁটতে ব্যথা কম লাগে।
কবি হেলাল হাফিজ কবিতায় বলেছিলেন, ‘কথা ছিল একটি পতাকা পেলে ভূমিহীন মনু মিয়া গাইবে তৃপ্তির গান জ্যৈষ্ঠে-বোশেখে।’ কিন্তু বাস্তবে?
ভূমিহীনের সরকারি সংজ্ঞা অনুসারে, শূন্য থেকে ৫ শতাংশ জমি মালিককে ভূমিহীন বলা যায়। কচির আলীর মাথা গোঁজার ঠাঁই নেওয়ার ২ শতক জমি আছে। অর্থাৎ তিনি ভূমিহীন ও রাষ্ট্রের একজন জ্যেষ্ঠ নাগরিক। অথচ তাঁর বেঁচে থাকার ন্যূনতম সম্বলটুকু আজও নেই।
কচির আলী বললেন, আগে তাঁর বাড়ি তিস্তার নোহালীর চরে ছিল। ৩০ থেকে ৩৫ বছর আগে তিস্তার গর্ভে বসতভিটা গেছে। আবাদি জমি গেছে। এরপর জীবিকার তাগিদে কত কিছু করেছেন। জমির আল থেকে ঢেঁকি, হেলেঞ্চা, কলমি ও কচু শাক তুলে বাজারে বিক্রি করেন। এখন করেছেন বাড়ি পূর্ব কচুয়া গ্রামে। এটি রংপুর জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী ইউনিয়নে।
বর্ষায় প্রমত্ত তিস্তা, শীত থেকে শীর্ণকায় হয়ে যায়। চৈত্র তো পুরোটাই বালুচর। দুই পারের বিস্তীর্ণ বালুরাশির মধ্যে জলের ক্ষীণধারা বয়ে যায়।
নোহালীর কচুয়া বাজার ঘাটে বাড়ি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফরিদুল ইসলামের। তিনিসহ নৌকায় নদী পার হয়ে মধ্যদুপুরে তিস্তার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল ঘুরে দেখি। দেখা গেল, কৃষক সংগ্রাম করে ফসল ফলাচ্ছেন। দিগন্তজুড়ে তামাক আর তামাক। কৃষকদের কাছে এ ফসলের নাম ‘তাংকু’। তামাক চাষের প্রতি এ অঞ্চলের কৃষকদের ঝোঁক বহু আগের। তবে তামাক চাষের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে কৃষকদের জানা খুব সামান্য।
তামাকের বাইরে ভুট্টা, পেঁয়াজ ও রসুনের আবাদ চোখে পড়ল। কোনো জমি খালি পড়ে নেই। কৃষকেরা বলছেন, এসব ফসলই বাঁচিয়ে রেখেছে চরের মানুষকে।
কচির আলীও এবার দেড় বিঘা জমি তিন হাজার টাকায় বর্গা নিয়ে তামাক চাষ করেছেন। অগ্রহায়ণ মাস থেকে গায়ে-গতরে খাটছেন। সকালে জমিতে যান, ফেরেন সন্ধ্যায়।
চলন্ত নৌকায় কচির আলীকে জিজ্ঞাসা করি, চরে আপনার জমি জেগে ওঠেনি? ‘আরেকজনে জুলুম করে সামান্য টাকায় দিয়ে নিছে।’ কচির আলী জবাব দিলেন।
ঘাটে নৌকা থামলে কচির আলীর সঙ্গে হেঁটে তাঁর বাড়িতে যাই। প্রতিবেশীরা জানান, কচির আলীর ছেলে পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকেন। তাঁর স্ত্রীও ছেলের সঙ্গে থাকেন। বাড়িতে কচির আলী একা থাকেন।
কবি জসীমউদ্দীনের ‘আসমানী’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,/ একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।/ একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,/ তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।’ কচির আলীর বাড়ি দেখে ‘আসমানী’ কবিতাটি মনে পড়ল।
পার্থক্য এতুটুকুই—আসমানীর ঘরে ভেন্নাপাতার ছানি, আর কচির আলীর ঘরে জীর্ণ টিনের ছানি। এ ছাড়া দুঃখ, দারিদ্র্য, অভাব—সব একই।
তিস্তাপারের পেশাহারা ‘মাছুয়া’
গঙ্গাচড়া থেকে ২০ কিলোমিটারের বেশি দূরে নোহালী ইউনিয়নটির তিন ভাগের দুই ভাগ তিস্তা নদীতে। তিস্তায় মাছ ধরে অনেক পরিবারের জীবন চলত। কিন্তু জেলেরা বলছেন, নদীতে এখন মাছ নেই। ২৫ মার্চ কচুয়া বাজার নৌকাঘাটের পারে কথা হয় জেলে মোন্নাফ হোসেনের সঙ্গে। তখন তাঁর ঘাড়ে ছাপ জাল, হাতে মাছ রাখার খলই। নদীতে জাল ফেলানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।
মোন্নাফ নিজেকে ‘মাছুয়া’ পরিচয় দিয়ে বললেন, ‘১৬ থেকে ১৭ বছর থাকি এই পদে আছি।’ ‘পানিতে জীবনটা গেল’ শুনিয়ে বললেন, ‘এ্যালা নদীত পানি নাই, মাছও নাই। তা–ও নামি, নেশা হয়্যা গেইছে।’
বিকল্প পেশা হিসেবে মোন্নাফ একটি ব্যাটারিচালিত ভ্যান কিনেছিলেন। কিন্তু চালানোয় অভ্যস্ত নন। তাই ভ্যানটি ছোট ছেলেকে দিয়ে আলাদা খানা করে দিয়েছেন।
ভারতের জলপাইগুড়ি হয়ে এই নদী বাংলাদেশের নীলফামারী, লালমনিরহাট, রংপুর, গাইবান্ধা দিয়ে কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্রে এসে মিশেছে। তিস্তাপারের ‘মাছুয়াদের’ এই দুঃখের বৃত্তান্ত মূলত গত তিন দশকের।
নদীর দুই তীরের বিপুলসংখ্যক মানুষ কৃষি, মাছ ধরা, নৌকা চালানোসহ বহুবিধ উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করত। পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় বাঁধ নির্মিত হওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তিস্তার ১১৫ কিলোমিটার জলপ্রবাহ প্রায় শূন্য হয়ে যায়। এর প্রধান শিকার তিস্তাপারের মানুষ।
হেমন্ত, ক্ষিতীশেরা এলাকা ছেড়েছেন
‘হামরা আসল কৈবর্ত। জলে হামার বাস। জলে জীবন। কিন্তু কী করবেন দাদা, মাছ ধরে পেট চলে না।’ কথাগুলো বলছিলেন গোবিন্দ দাস। নোহালী ইউনিয়নের পশ্চিম কুচয়া কুমারপাড়ার বংশপরস্পরা জেলে গোবিন্দ দাসের হাতে এখন ব্যাটারিচালিত ভ্যান।
২০১৫ সালে তিস্তাপাড়ের জীবন ও জীবিকা নিয়ে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান একশনএইড। গবেষণায় বলা হয়েছে, নদীপারের ৩৫ শতাংশ মানুষ তাঁদের পেশা (কৃষি, জেলে ও মাঝি) হারিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে নদীর প্রবেশমুখের ৮৮ শতাংশ মাঝি, ২০ শতাংশ কৃষক ও ৪৯ শতাংশ জেলে পেশা হারিয়েছেন। আর নদীর প্রবেশমুখ থেকে দূরে ৯৭ শতাংশ মাঝি, ৩৩ শতাংশ কৃষক ও ৬৫ শতাংশ জেলে পেশা বদল করতে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া এ দুই এলাকার অন্তত ২৫ শতাংশ মানুষ দিনমজুরে পরিণত হয়েছেন। (প্রথম আলো ৭ জুন, ২০১৫)।
গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশের ১০ বছর হয়ে যাচ্ছে, তিস্তাপারের পেশাহারা মানুষের ভিড় আরও বেড়েছে।
নোহালীর পশ্চিম কচুয়া কুমারপাড়ার সঙ্গে লাগোয়া নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার রণচণ্ডী ও কৈমারী ইউনিয়ন। ওই তিন গ্রামে ৪৪ ঘর জেলে পরিবারের বসবাস।
জেলেপাড়া তিনটিতে ঘুরে জানা গেল, অনেকে আদি পেশা পরিবর্তন করেছেন। জলঢাকার রণচণ্ডীর মাঝিরডাঙ্গার বিজয় দাস জেলে কাম মাঝি হয়েছেন। এখন আড়ত থেকে মাছ কিনে ‘টুকটাক’ ব্যবসা করেন।
একই পাড়ার রমণী দাস (৭০) কবিরাজি করেন। পশ্চিম কচুয়া বাবু দাস পুরোদস্তুর দিনমজুর হয়ে গেছেন। পশ্চিম কচুয়ার হেমন্ত দাস ও রণচণ্ডীর মাঝিরডাঙ্গার ক্ষিতীশ দাস ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন।
কথাসাহিত্যিক দেবেশ রায়ের ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’–এর বাঘারু একদিন পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবাতে বাঁধ, অর্থনীতি ও উন্নয়নকে প্রত্যাখ্যান করে তিস্তাপার ছেড়ে চলে গেছেন। আজকের বাঘারুরাও তিস্তাপার ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কচুয়ার জেলে লুৎফর ওরফে টুনু বলছিলেন, ‘তখন নদীর খুব তরঙ্গ (ঢেউ) ছিল। এখন নদী নাই। নদী এখন বহু ভাগ হয়েছে। ভারত ও বাংলাদেশের দুই ব্রিজ (ব্যারাজ) নদীর ক্ষতি করেছে।’
প্রান্তের মানুষের যত সমস্যা
১৯৯১ সালে মঙ্গা যেসব অঞ্চলের ওপর বেশি প্রভাব পড়েছিল, তার একটি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলা। চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিন তাঁর সংবাদ নেপথ্যে লিখেছেন, ‘একজন মার্কিন সিনেট-পত্নীর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের স্বেচ্ছাসেবী স্বাস্থ্যকর্মী দল এলেন ঢাকায়। তাদের মধ্যে ডা. জনসনের নেতৃত্বে একটি দল রংপুরে এসে গঙ্গাচড়া উপজেলার নোহালী আর আলমবিদিতর ইউনিয়নে গেলেন। ওই দুই জায়গাতেই বেশি লোক মারা যাচ্ছিল। “ডায়রিয়ায়” আক্রান্ত অনেক।’
মোনাজাতউদ্দিন আরও লিখেছেন, ‘অভিজ্ঞ চিকিৎসক ডা. জনসন নোহালীতে নেমেই বিহ্বল। তিনি দু-একজন “রোগী” পরীক্ষার পর দারুণ বিস্মিত। বারবার বলতে লাগলেন, “আমাকে বলা হয়েছিল, এখানে ডায়রিয়া হয়েছিল। কিন্তু এ যে দেখছি অন্য রকম ব্যাপার! এরা তো সব ম্যালনিউট্রেশনের (অপুষ্টি) রোগী! স্যালাইন বা ওষুধ এদের জন্য নেই, এদের জন্য খাবার দিতে হবে। পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে।”’
গঙ্গাচড়ার নোহালী ইউনিয়নে ঘুরলে এখনো মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মতো মৌলিক সমস্যাগুলো চোখে পড়ে। মানুষের কাজের সংকট আছে। চরাঞ্চলে যোগাযোগব্যবস্থা দুর্গম। কোনো নারীর প্রসবকালে হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হলে জলচৌকিতে ভার সাজিয়ে নৌকাঘাটে নিয়ে এসে তারপর হাসপাতালে নিয়ে আসতে হয়।
২৬ মার্চ দুপুর ১২টার দিকে নোহালী ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সামনে দুই নারীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। কাছে গিয়ে জানা গেল, তাঁরা ওষুধ নিতে এসেছেন। কিন্তু স্বাস্থ্যকেন্দ্র বন্ধ।
মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে পতাকা উত্তোলনের কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটিতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়নি।
স্থানীয় যুবক শাহজালালের সহযোগিতা নিয়ে দ্বিতীয় তলায় একজন সিএসবিএ (কমিউনিটি বেজড স্কিল্ড অ্যাটেনডেন্ট) নারায়ণী রানী রায়কে পাওয়া গেল। তিনি বললেন, প্রতি শনি ও মঙ্গলবার একজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা (এফউব্লিউভি) এসে ওষুধ বিতরণ করেন। ২৬ মার্চ সরকারি ছুটি থাকায় তিনি আসেননি। নারায়ণী বললেন, সবিতা রায় ও তিনি (দুজনই সিএসবিএ) সেখানে ২৪ ঘণ্টা থাকেন। তবে তাঁরা স্থায়ী চাকরিভুক্ত নন।
এই উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে সাঁটানো তথ্যবিবরণীতে দেখা গেল, স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, উপসহকারী কমিউনিটি স্বাস্থ্য কর্মকর্তাসহ এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র মোট পদ ২০টি। এর মধ্যে কর্মরত ১৩ জন। কিন্তু স্থানীয় ব্যক্তিরা বললেন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি নির্জন থাকে। চিকিৎসক, কর্মচারীরা খুব কম আসেন।
ওই দিন বিকেলে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার তিস্তা নদী থেকে ঘাঘট নদীর উৎপত্তিস্থল দেখে মোটরসাইকেলে গঙ্গাচড়া ফিরতে দেখা গেল, তিস্তার ডান তীর রক্ষা বাঁধের বেশ কিছু স্থানে বড় বড় গর্ত হয়ে আছে। আগামী বন্যায় ভেঙে যাওয়ার ঝুঁকি আছে।
নোহালীর লেবুর গুড়িং বাঁধে দেখা গেল উৎসুক মানুষের ভিড়। স্থানীয় একজন পশুচিকিৎসক বললেন, একটি বাছুরকে কুকুর কামড় দিয়েছে। আধা কিলোমিটার সামনে একই ঘটনা। এবার কচুয়া বাজারের কাছে দুই বছরের শিশুর ঘাড়ে কুকুর কামড় দিয়েছে।
ঘটনাস্থল থেকে গঙ্গাচড়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা আফিস ফেরদৌসকে ফোন করলে তিনি রোগীকে দ্রুত উপজেলা হাসপাতালে নিতে বললেন। তবে আসিফ ফেরদৌস এটাও বললেন, ‘হাসপাতালে প্রতিষেধক টিকা নেই, বাইরে থেকে কিনতে হবে।’
জহির রায়হান প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক
[email protected]