অন্তত বিদ্যুৎ পানি গ্যাসের জন্য ইন্টারনেট খুলে দিন

ইন্টারনেট সেবা বন্ধ থাকায় বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার রিচার্জ করতে পারছেন না গ্রাহকেরা। এমন অবস্থায় বিদ্যুৎ অফিসের সামনে দীর্ঘ লাইন। ২১ জুলাই দুপুর ১২টায় মিরপুর ১৩ নম্বর এলাকায়।
কোটা সংস্কারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ও পরবর্তী সংঘর্ষ–সহিংস পরিস্থিতিতে গত বৃহস্পতিবার (১৮ জুলাই ২০২৪) সন্ধ্যার পর থেকে দেশজুড়ে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। মঙ্গলবার (২৩ জুলাই ২০২৪) রাত থেকে সীমিত আকারে ইন্টারনেট চালু করা হয়। এ কয়দিনের প্রথম আলোর ছাপা পত্রিকার সম্পাদকীয়, লেখা ও সাক্ষাৎকার ধাপে ধাপে অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। সোমবার (২২ জুলাই ২০২৪) এ লেখা ছাপা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

ভোরে ফোন বাজল। ফোনটা করেছে এলাকার ছোট ভাই মিন্টু সরকার। সে পেশাদার তবলাশিল্পী। তবলা বাজিয়ে সংসার চলে না বলে টুকটাক আম, লিচু ও মধুর মৌসুমি ব্যবসা করে।

ফোন ধরতেই মিন্টু কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘ভাই, আমার সব শেষ। সুদের ওপর ধারদেনা করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে দুই লাখ টাকার আম এনেছিলাম। ভেবেছিলাম, অনলাইনে আম বিক্রি করে টাকাটা শোধ করব, কিছু লাভ থাকবে। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ আর কারফিউ থাকায় আমার সব শেষ। সব আম পেকে গলে যাচ্ছে। এই আম আর বিক্রি করা যাবে না। এখন ধারের টাকা কেমনে দেব জানি না। আমার মরা ছাড়া পথ নাই।’ 

মনটা খারাপ হলো।

অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছি। স্ত্রী এসে বললেন, ‘বিদ্যুতের মিটার সিগন্যাল দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে কারেন্ট চলে যাবে। প্রিপেইড কার্ড রিচার্জ করতে হবে।’

মহল্লার যে দোকান থেকে বিদ্যুতের কার্ড রিচার্জ করি, তারা জানাল, হবে না। ইন্টারনেট বন্ধ। অথচ বিদ্যুৎ ছাড়া ফ্যান, লাইট, ফ্রিজ, টিভি সব বন্ধ হয়ে যাবে।

বাসার খাওয়ার পানি শেষ হয়ে গেছে দুই দিন আগেই। পানি আনা হয় বাসার পাশের ওয়াসার পাম্প থেকে। প্রিপেইড মিটারে পানি দেওয়া হয়। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় পাম্পও বন্ধ।

গ্যাসের চুলাও চলে প্রিপেইড মিটারে। সেটিও রিচার্জ করার সময় চলে এসেছে; অথচ ইন্টারনেট না এলে তা রিচার্জ করার সুযোগ নেই।

ব্যাংকের এটিএম বুথ বন্ধ। মোবাইল ব্যাংকিং বন্ধ। বিকাশ, নগদ ও রকেট বন্ধ। বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলা হলেও কার্যত টাকা তোলা যাচ্ছে না।

রাজধানীতে চাল, ডাল, তেল, নুন, শাকসবজি কিছুই বাইরে থেকে ঢুকতে পারছে না। ঢাকার আড়তগুলোর মজুত দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। বাজারে যে সবজিতেই হাত দাও, দামের গরমে হাতে ফোসকা পড়ার দশা হচ্ছে। সবকিছুর দাম গরিব মানুষ তো দূরের কথা, মধ্যবিত্তেরও হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

পেটের পীড়নে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রিকশাওয়ালারা কারফিউর মধ্যে বের হচ্ছেন। যাত্রী নেই। এক কেজি চাল কেনার টাকা আয় করতে করতে তাঁদের কোমর বাঁকা হয়ে যাচ্ছে। অন্য দিনমজুরেরা সম্পূর্ণ বেকার হয়ে আছেন। ক্ষুধা লাগলে তাঁরা একটা রুটি খেয়ে যে উদরপূর্তি করবেন, সে উপায়ও নেই। কারণ, টংদোকানগুলোতে বেকারির পাউরুটি-বিস্কুটের সাপ্লাইও প্রায় বন্ধ।

রাজধানীতে আমরা যারা আছি, সব মিলিয়ে তাদের এখন আক্ষরিক অর্থে ‘ভাতে মরা, পানিতে মরা’র দশা চলছে। পাম্পের বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে জীবন বাঁচাতে ওয়াসার পানি ফুটিয়ে খেতে হচ্ছে। 

কার্ড রিচার্জ না করায় যাঁদের চুলা বন্ধ হয়েছে, তাঁদের নাকমুখ চেপে ওয়াসার ব্লিচিং মেশানো পানি না ফুটানো অবস্থাতেই খেতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ না থাকায় ফ্যান-লাইট চলছে না। 

বিদ্যুৎহীন রাতে একদিকে ‘থাকে শুধু অন্ধকার’; অন্যদিকে গরমে সেদ্ধ হওয়ার দশা। অনেক বাসায় শিশু-বৃদ্ধ ও রোগীরা বিদ্যুৎ না থাকায় ছটফট করছেন। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নেওয়ার অবস্থাও নেই। আমার পক্ষাঘাতগ্রস্ত শাশুড়ি যারপরনাই অসুস্থ। যেকোনো সময় তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া লাগতে পারে। কিন্তু কারফিউর মধ্যে রোগী নিয়ে বাইরে যাওয়া কঠিন। 

পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তা জানারও কোনো উপায় নেই। কারণ, ইন্টারনেট নেই। 

খবরের জন্য টেলিভিশনগুলোর দিকে যখনই চোখ রাখছি, দেখছি কিন্তু তাতে আমাদের চাহিদা মিটছে না। প্রকৃত অবস্থা বুঝতে পারছি না। 

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গুজবে কান দেবেন না; কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় নিউজ পোর্টালগুলোর খবর পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে গুজব চক্রবৃদ্ধি হারে ছড়িয়ে পড়ছে। 

বহু ফ্ল্যাটে পানি, ফ্যান, লাইট, চুলা ও ফ্রিজ নাইয়ের সঙ্গে আরও অগণিত ‘নাই’ যোগ হয়েছে। সব মিলিয়ে একেকটি ফ্ল্যাট একেকটি মিনি ‘কারবালায়’ পরিণত হচ্ছে। 

এসব ‘নাই’জনিত দুর্ভোগ দূর করতে যেটি ফিরিয়ে দিতে হবে, তার নাম ইন্টারনেট। 

ইন্টারনেট এমন জিনিস, যা ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। সে নিরাকার। এই বীভৎস দুর্ভোগের মধ্যেও অতি দুঃখে হেসে ফেলার মতো করে ইন্টারনেটের উদ্দেশে বলতে হচ্ছে, ‘তুমি আছ সবই আছে, তুমি নেই, কিছু নেই।’ 

গত বুধবার থেকে মোবাইল ইন্টারনেট-সেবা এবং বৃহস্পতিবার থেকে ব্রডব্যান্ড-সেবা বন্ধ রয়েছে। ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী প্রথমে বলেছিলেন, চলমান পরিস্থিতির কারণে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ রয়েছে। 

এরপর শুক্রবার তিনি বলেছেন, দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে মহাখালীতে ডেটা সেন্টার পুড়ে যাওয়ায় ব্রডব্যান্ড বন্ধ রয়েছে। এটি ঠিক হতে সময় লাগবে। সরকারের দিক থেকে আমাদের ‘ধৈর্য ধরতে’ বলা হচ্ছে। ধৈর্য ধরা ছাড়া যেহেতু আমাদের আর কিছু করার নেই, তাই আমরা ধৈর্য ধরে আছি।

মাননীয় সরকার, বিশ্বাস করুন, আমাদের কষ্ট হচ্ছে। আমরা আর পারছি না। দয়া করে এখনই ইন্টারনেট খুলে দিন। পুরোপুরি খুলতে না পারলে অন্তত কারফিউ শিথিলের মতো কয়েক ঘণ্টার জন্য হলেও ইন্টারনেট খুলে দিয়ে আমাদের বাঁচান। অন্তত পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাসের মতো জীবন রক্ষাকারী সেবাগুলো কিছুক্ষণের জন্য হলেও সচল করুন।

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

[email protected]