একজন সুস্থ-সবল মানুষ সকালে কাজে বের হলেন, কিন্তু দিন শেষে তাঁর নিরাপদে ঘরে ফেরা কতটা অনিশ্চিত, সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কেউ হয়তো সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন, ভবন থেকে ইট ছিটকে এসে বা দেয়াল ধসে পড়ে মারা যাচ্ছেন, সিলিন্ডার বা জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণে প্রাণ হারাচ্ছেন, ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে মারা যাচ্ছেন, কারখানায় আগুন লেগে বা বিস্ফোরণে মৃত্যু। প্রাণহানির কারণের শেষ নেই।
এভাবে মৃত্যু হওয়াই যেন এ দেশের মানুষের একটা ‘অভ্যাস’ হয়ে গেছে। ফলে এর জন্য কোনো না কোনো কর্তৃপক্ষ বা ব্যক্তি দায়ী, সেটি আমরা সবাই ভুলে যাই। কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, কারও ক্ষমা চাইতে হবে বা ভুক্তভোগীর ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার আছে—এসবের আলাপ এখানে অনুপস্থিত। সবই হয়ে যায় তখন নিয়তির লিখন!
সব মৃত্যুই মর্মান্তিক, বিশেষ করে অপঘাতে মৃত্যু। তবে জাহেদ আলীর মৃত্যুটি আরও বেশি মর্মান্তিক। জাহেদ আলী একজন রিকশাচালক। একজন খেটে খাওয়া মানুষ। এক তরুণীর স্বামী। একজন আট মাস বয়সী শিশুর পিতা। সর্বোপরি একজন দুর্ভাগা নাগরিক। ঘূর্ণিঝড় মোখার বিপৎসংকেত উপেক্ষা করে রিকশা নিয়ে বের হয়েছিলেন তিনি। পেটের দায় মেটাতে গিয়ে প্রাণটাই খোয়ালেন।
গতকাল রোববার সকালে চট্টগ্রাম শহরের অক্সিজেন মোড়ের ঘটনা। আচমকা বিদ্যুতের মোটা একটি তার এসে পড়ে জাহেদ আলীর ওপর। সেই ছবি ও ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তারজুড়ে আগুন আর সেই আগুনে পুড়ে যাচ্ছেন জাহেদ আলী। সে সময় চট্টগ্রামের অন্যতম প্রবেশদ্বার ও ব্যস্ততম এলাকা গোটা অক্সিজেন মোড় যেন থমকে দাঁড়িয়েছিল। কয়েক হাত দূরে মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়েছিলেন। রাস্তার দুই পাশে সব গাড়িও। সবাই জাহেদ আলীর এই পরিণতি দেখছিলেন আর আফসোস করছিলেন, কিন্তু কিছু করার ছিল না। যদিও পরবর্তী সময়ে সাহস করে কয়েকজন শুকনো কাঠ নিয়ে এগিয়ে যান। এরপর তো পুলিশ খবর পেয়ে এসে তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
ভেজা রাস্তায় মুখ থুবড়ে থাকা জাহেদ আলীর ছবি আর আগুনে পুড়তে থাকার ভিডিও দেখে কারও মনেই হবে না যে তিনি বেঁচে আছেন। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাৎক্ষণিক ছড়িয়ে পড়ে তাঁর মৃত্যুর খবর, সেই সঙ্গে এমন মৃত্যুর জন্য আফসোসও। তবে প্রথম আলোর খবরে কিছুটা আশার প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল, যখন জানতে পারলাম, জাহেদ আলী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকেরা জানালেন, তাঁর শরীরের প্রায় ৩৫ ভাগ পুড়ে যায়। কিন্তু না, তিনি তো এক দুর্ভাগা দেশের হতভাগ্য নাগরিক। কয়েক ঘণ্টা পর তিনি সত্যিই মারা গেলেন। একবার চিন্তা করুন তো, একটু দূরে যে যাত্রাবাহী বাস বা প্রাইভেট কারটি দাঁড়িয়েছিল, সেটির ওপর বিদ্যুৎবাহী তারটি পড়লে আরও কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হতো!
মৃত্যুর খবর দেওয়া প্রথম আলোর প্রতিবেদন জানাচ্ছে, জাহেদ আলীর বাড়ি লালমনিরহাট জেলায়। তবে পরিবার নিয়ে তিনি নগরের কুলগাঁও বটতল এলাকায় থাকেন। তাঁর আট মাস বয়সী একটি সন্তান রয়েছে। আহা, মেয়েটির বাবা ডাক শোনা হলো না জাহেদের। মেয়েটিও কোনো কিছু বোঝার আগেই হয়ে গেল এতিম। জাহেদের বউয়ের নাম আমরা জানি না, তরুণীটি হয়ে গেলেন বিধবা। বাচ্চা মেয়েটিকে নিয়ে পড়ে গেলেন অকূলপাথারে। জাহেদের শ্বশুর আইয়ুব আলী বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। আমরা মামলা করব না। লাশ দ্রুত দাফন করতে চাই।’
এ দেশে বিচার চাওয়ার বা পাওয়ার ইচ্ছাটাই কীভাবে মরে যাচ্ছে মানুষের, সেটিই কি প্রতীয়মান হলো না জাহেদের শ্বশুরের বক্তব্যে? মামলা করে যে কিছু হবে না, বিচার পাবেন না, সেটিই তিনি বুঝে নিয়েছেন। এই ধারণা কেনই-বা তার হবে না? চট্টগ্রামে দেয়াল ধসে বা নালায় পড়ে মৃত্যুসহ আরও আরও প্রাণহানির উদাহরণ তাঁর সামনেই আছে। তাঁরা কি কোনো বিচার পেয়েছেন? বরং কারও লাশ এখনো পাওয়া যায়নি, কারও লাশ পাওয়া গিয়েছিল দীর্ঘ সময় খোঁজাখুঁজির পর, সেখানে আইয়ুব আলীর কপাল ভালো যে মেয়ের জামাইয়ের লাশটা পেয়েছেন, বুঝে পেতে বেশি দেরিও হয়নি!
কদিন আগে চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা স্টিল মিল বাজার এলাকায় লরি থেকে দড়ি ছিঁড়ে ছিটকে গিয়ে পণ্যবাহী একটি কনটেইনার রিকশার ওপর পড়ে। এতে রিকশাচালক কোনোমতে প্রাণে বাঁচলেও আরোহী বাবা-ছেলের ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। নৌবাহিনীর ক্রেনের সাহায্যে কনটেইনারের নিচে চাপা পড়া দুজনকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। তাঁরা চিকিৎসক দেখিয়ে রিকশায় বাসায় ফিরছিলেন।
সেই ঘটনাও আমরা দেখলাম, স্বজনেরা লাশ নিয়ে ঘরে ফিরতে পেরেই স্বস্তিবোধ করেছেন। আমরা জানতেও পারলাম না সেই কনটেইনারের মালিক কে বা কারা ছিলেন। কী সুন্দর, দুটি মানুষের মৃত্যুর দায় নিতে হলো না তাঁদের! কোনো ক্ষতিপূরণও দিতে হলো না, কী সহজে পার পেয়ে গেলেন তাঁরা! কোনো মামলা-মোকদ্দমা বা পুলিশি ঝামেলায়ও পড়তে হলো না। পড়লেও হয়তো কিছু মানুষের পকেটে টাকা ঠেসে দিয়ে সহজে মিটমাট করে ফেলতে সক্ষম হয়েছেন।
এরপর আমাদের জাহেদ আলীর এই অসহনীয় মৃত্যু দেখতে হলো। কোনো সভ্য দেশ হলে বিদ্যুৎ বিভাগ বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অবশ্যই ক্ষমা চাইত। কেন বিদ্যুতের তারটি ছিঁড়ে পড়ল, কেন তারটি দুর্বল হলো, সে ব্যাপারে তদন্ত হতো। দায়িত্ব অবহেলা বা দায়িত্বহীনতার দায়ে কারও শাস্তি হতো। ক্ষতিগ্রস্ত জাহেদ আলীর পরিবার ক্ষতিপূরণ পেত। ক্ষতিপূরণ আদায়ে আদালতের ভূমিকাও হয়তো দেখা যেত।
প্রশাসনের কেউ, নগরের জনপ্রতিনিধি এখন পর্যন্ত জাহেদ আলীর পরিবারের পাশে দাঁড়াননি। তাঁর বিধবা স্ত্রী ও এতিম মেয়ের ভবিষ্যৎটা এভাবে অনিশ্চিত হয়ে গেল। অথচ তাঁদের প্রতি সরকার, প্রশাসন ও বিদ্যুৎ বিভাগের দায় আছে, সেটি কোথাও আমরা দেখলাম না। এই দেখতে না পাওয়ার বিষয়টিই যেন এ দেশের সংস্কৃতি হয়ে পড়েছে। এটিই যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে মানুষের এমন মর্মান্তিক মৃত্যুই যেন আরও বেশি স্বাভাবিক এখন!
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী