উন্নয়ন অর্থনীতিতে চারটি দেশকে ‘এশিয়ান টাইগার’ নামে অভিহিত করা হয়—সিঙ্গাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ও হংকং। উন্নয়ন অর্থনীতিবিদেরা ভিয়েতনামকে ইতিমধ্যেই ‘দ্য নেক্সট এশিয়ান টাইগার’ আখ্যায়িত করা শুরু করেছেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের প্রশ্নে ভিয়েতনামের উদীয়মান অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বোঝা দরকার।
১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বরে সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম যখন স্বাধীন দেশ হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল, তখন ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়’—সুকান্তের এই অবিস্মরণীয় কবিতার পঙ্ক্তিটি আক্ষরিকভাবেই প্রযোজ্য ছিল ভিয়েতনামের বীর জনগণের ক্ষেত্রে।
ভিয়েতনাম কখনোই কোনো দেশের কাছে মাথা নত করেনি, ভিক্ষার জন্য হাত পাতেনি। এমনকি অনুদান ও সফট লোনের আশায় জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্ত হতেও আবেদন করেনি।
অথচ ভিয়েতনামের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি ১৯৭৪ সালে ছিল মাত্র ৬৫ ডলার (বাংলাদেশের চেয়ে কম), ১৯৮৫ সালে ছিল ২৮৫ ডলার, জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ২ দশমিক ৪ শতাংশ।
২০২২ সালে আইএমএফের প্রাক্কলন মোতাবেক ভিয়েতনামের মোট জিডিপি ৪৩৩ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ সালে ভিয়েতনামের মাথাপিছু নমিনাল জিডিপি ৪ হাজার ৩১৬ ডলারে পৌঁছে গেছে, যেটিকে বলা হচ্ছে ‘মিরাকল’। ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি) ভিত্তিতে ভিয়েতনামের মাথাপিছু জিডিপি ২০২২ সালে পৌঁছে গেছে ১২ হাজার ৮১০ পিপিপি ডলারে।
ভিয়েতনামের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ২০০৫ সালে সর্বোচ্চ ৮ দশমিক ৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছিল। এক দশক ধরে তা ৬ দশমিক ৫ থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রয়ে গেছে। শেষ ২০২৩ সালে ভিয়েতনামের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে ভিয়েতনামের মাত্র ২ শতাংশ জনগণ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করেছে।
২০২২ সালের মানব উন্নয়ন সূচকের বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ভিয়েতনামের অবস্থান ছিল ১০৭ নম্বরে, বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯ নম্বরে। ২০২২ সালে ভিয়েতনামের সাক্ষরতার হার ছিল ৯৬ শতাংশ আর বাংলাদেশের ৭৩ শতাংশ।
ভিয়েতনামের এই ‘মিরাকল’–এর পেছনের কাহিনি কী? ভিয়েতনামের রাষ্ট্রনেতারা এখনো তাঁদের রাষ্ট্রকে ‘সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম’ হিসেবেই অভিহিত করে থাকেন। কিন্তু ১৯৮৬ সালে ‘দোই মোই’ (ইংরেজিতে যাকে ‘রিনোভেশন’ বলা হয়) সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন শুরু হওয়ার ৩৮ বছর পর এখন পাশ্চাত্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন–চিন্তকেরা ভিয়েতনামের অর্থনীতিকে ‘সোশ্যালিস্ট ওরিয়েন্টেড মার্কেট ইকোনমি’ হিসেবে বর্ণনা করছেন।
বাংলাদেশ ধনকুবের প্রবৃদ্ধির হারে ২০১৭ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করলেও ভিয়েতনাম সক্রিয়ভাবে ধনাঢ্য ব্যক্তি সৃষ্টিকে নিরুৎসাহিত করে চলেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফলকে কয়েকটি নগরে কেন্দ্রীভূত না করে ভিয়েতনাম গ্রামীণ জনগণের মধ্যে উন্নয়নের সব ডাইমেনশনকে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর।
দোই মোই কর্মসূচিতে ‘কালেকটিভ ফার্মিং’ নিষিদ্ধ হয়েছে, জমির ওপর জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং অর্থনীতিতে ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় উভয় উদ্যোগকে উৎসাহিত করা হয়েছে।
দোই মোই অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংস্কারের প্রধান তিনটি ডাইমেনশন হলো, ১. অত্যন্ত শক্ত হাতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য উদারীকরণ, ২. অত্যন্ত দ্রুত অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির বিনিয়ন্ত্রণ এবং সরকারি হস্তক্ষেপ হ্রাসের মাধ্যমে ব্যবসা করার খরচ ও বাধাবিঘ্নœ কমিয়ে ফেলা এবং ৩. রাষ্ট্রীয় খাতের বিনিয়োগ প্রবলভাবে জোরদার করার মাধ্যমে মানব উন্নয়ন (শিক্ষা) ও ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়নকে প্রথম অগ্রাধিকারে পরিণত করা।
বিশেষত, প্রাথমিক শিক্ষা ও বৃত্তিমূলক (ভোকেশনাল) শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে ভিয়েতনাম ২০০০ সালের মধ্যেই পুরো জনসংখ্যাকে শতভাগ শিক্ষিত করে তুলেছে এবং জনগণের বিশাল একটি অংশকে প্রযুক্তিগত দক্ষতা অর্জনে সফল করে তুলেছে। একইভাবে উল্লেখযোগ্য যে ভিয়েতনাম তার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বৈষম্য বাড়তে দেয়নি। ভিয়েতনামের জনগণের ৯১ শতাংশ ২০২১ সালে স্বাস্থ্যবিমার আওতায় সেবা পেয়েছে। জনসংখ্যানীতির ব্যাপারে ভিয়েতনাম কঠোরভাবে ‘দুই সন্তান নীতি’ অনুসরণ করে চলেছে, যে নীতি বাংলাদেশে বহু আগেই গ্রহণ করা উচিত ছিল।
আয় ও সম্পদবৈষম্যের ক্ষেত্রেও ভিয়েতনাম বৈষম্য বৃদ্ধির প্রবণতাকে প্রতিরোধ করে যাচ্ছে। আয়বৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগ ২০১৬ সালে ভিয়েতনামের ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৩৫৩ আর বাংলাদেশের জিনি সহগ ২০১৬ সালে ছিল শূন্য দশমিক ৪৮৩ এবং ২০২২ সালে হয়ে গেছে শূন্য দশমিক ৪৯৯।
বাংলাদেশ ধনকুবের প্রবৃদ্ধির হারে ২০১৭ সালে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করলেও ভিয়েতনাম সক্রিয়ভাবে ধনাঢ্য ব্যক্তি সৃষ্টিকে নিরুৎসাহিত করে চলেছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফলকে কয়েকটি নগরে কেন্দ্রীভূত না করে ভিয়েতনাম গ্রামীণ জনগণের মধ্যে উন্নয়নের সব ডাইমেনশনকে পৌঁছে দিতে বদ্ধপরিকর।
একদা চরম শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ২০০০ সালে এবং পরবর্তী সময়ে গণচীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ এক ডজনের বেশি দেশের সঙ্গে ‘ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট’ করেছে ভিয়েতনাম, যার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এসব দেশ থেকে বিপুল শুল্ক হ্রাস ও সহজ প্রবেশাধিকার সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে দেশটির পণ্য।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হতে ভিয়েতনামকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। বৈদেশিক বিনিয়োগকে প্রবলভাবে উৎসাহিত করে চলেছে ভিয়েতনাম। স্যামসাং, এলজি, অলিম্পাস, পাইওনিয়ার ইত্যাদি কোম্পানির দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় হাব এখন ভিয়েতনামে। (ভিয়েতনামে যাওয়ার আগে বাংলাদেশের কোরিয়ান ইপিজেডে কারখানা করার জন্য প্রবল আগ্রহ দেখিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল স্যামসাং)।
এখন ভিয়েতনামে প্রতিবছর বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবাহ দাঁড়াচ্ছে ২০ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার, যেখানে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগ এখনো তিন বিলিয়ন ডলারের নিচে থাকছে। ২০২২ সালে ভিয়েতনামে ২৭ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছে। বিশ্বব্যাংকের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস’ র্যাঙ্কিংয়ে ভিয়েতনামের অবস্থান ২০০৭ সালের ১০৪তম থেকে ২০১৭ সালে ৬৮তম অবস্থানে উন্নীত হয়েছে। (বাংলাদেশের অবস্থান এ ক্ষেত্রে অবনমিত হয়েছে।) ভিয়েতনামের ব্যাংকিং ব্যবস্থা এখনো রাষ্ট্রীয় মালিকানায় রয়ে গেছে। কিন্তু ব্যাংকঋণে উদ্যোক্তাদের অভিগম্যতা উল্লেখযোগ্যভাবে সহজ ও বহুল বিস্তৃত করা হয়েছে, বিশেষত গ্রামীণ এলাকায়।
এক দশক ধরে চীনের বিরুদ্ধে পশ্চিমা পুঁজিবাদী দেশগুলো নানা রকম বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাধানিষেধ আরোপের কারণে ভিয়েতনাম অনেক রকম সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে চীনের বিকল্প হিসেবে। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভিয়েতনাম এখন বাংলাদেশকে হটিয়ে মাঝেমধ্যে গণচীনের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানটি দখল করে নিচ্ছে। ইলেকট্রনিকস পণ্য রপ্তানিতে এখন সিঙ্গাপুরের পর ভিয়েতনাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। চাল রপ্তানিতে থাইল্যান্ডকে হটিয়ে ভিয়েতনাম ভারতের পর বিশ্বের দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে।
ব্রাজিলের পর কফি রপ্তানিতে ভিয়েতনাম বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। প্রায় ১০ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভিয়েতনামের মোট রপ্তানি আয় বাংলাদেশের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ২০২৩ সালে ভিয়েতনামের রপ্তানি আয় ছিল ৩৭১ দশমিক ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গণচীনের চলমান বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে গণচীনে উৎপাদনরত অনেক শিল্পকারখানা এখন ভিয়েতনামে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের চর্চা দুর্বল হলেও তা ভিয়েতনামের একদলীয় সরকারব্যবস্থার চেয়ে বিশ্বের কাছে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতো। কিন্তু ২০০৮ সালের অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পর ২০১৪ সালে, ২০১৮ সালে এবং ২০২৪ সালে বাংলাদেশে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়ায় এ ক্ষেত্রে আমাদের গণতান্ত্রিক পরিচয় আমরা হারিয়ে ফেলতে বসেছি।
ভিয়েতনাম থেকে রাজনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে প্রতিনিধিত্বমূলক স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনের বিষয়টিতে। উৎপাদনের সব ক্ষেত্রে সমবায় ব্যবস্থার মাধ্যমে শ্রমজীবী জনগণের ক্ষমতায়ন ও গ্রাম সমবায়ের ক্ষেত্রেও ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে পথ দেখাতে পারে।
ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক