রনিল বিক্রমাসিংহেকে আর প্রেসিডেন্টের ভার নিজের কাঁধে বহন করে যেতে হবে না। ভারমুক্ত হয়ে এখন তিনি নিজেই প্রেসিডেন্ট। বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট হবেন, এটা শুনে কেউ কি বলেছিলেন, ‘আমার কি কাঁদা উচিত না হাসা উচিত?’ আমি অনেকটাই নিশ্চিত যে সেটা ‘কেউ বলেছিলেন’। দুই বা তিন বছর আগেও যদি শ্রীলঙ্কার কেউ মুখ ফসকে বলে বসতেন, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে রনিল বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট হতে চলেছেন, তাহলে তাঁর সেই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে হাসির হুল্লোড় উঠত। কেননা, এর চেয়ে বড় হাসির বিষয় আর হতে পারে না।
বাস্তবতা হলো, বিক্রমাসিংহে এখন বৈধ প্রেসিডেন্ট। শ্রীলঙ্কার আইনসভার সদস্যরা সদ্য তাঁকে নির্বাচিত করেছেন। আইনসভায় তিনিই তাঁর দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির একমাত্র সদস্য। সাংবিধানিক বিধি মেনেই বৈধভাবে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, প্রেসিডেন্টের মসনদে বিক্রমাসিংহের এ আরোহণ তাঁর চাচা জে আর জয়াবর্ধনের মতোই হলো। ১৯৭৮ সালে জয়াবর্ধনে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। সেই বছরেও সাধারণ ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছিলেন জে আর জয়াবর্ধনে। দলটি সংসদে প্রেসিডেন্টকে নির্বাহী ক্ষমতা দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে। ১৯৮২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে সত্যিকার অর্থে জনগণের ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ছিলেন না তিনি। সেই নির্বাচনেও ব্যাপক প্রতারণা ও কারচুপির অভিযোগ ওঠে। নাগরিক অধিকার আদায়ে কাজ করে জনপ্রিয় হওয়া শ্রীমাভো বন্দরনায়েকের কাছ থেকে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন জয়াবর্ধনে।
২০২২ সাল ভিন্ন একটি বছর, এখন পরিস্থিতিটাও ভিন্ন। রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রনিল বিক্রমাসিংহেকে নিয়োগ দেন। বিক্রমাসিংহের এ নিয়োগ কতটা বৈধ, তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। সেটা ছিল মে মাসের প্রশ্ন। কিন্তু এখন জুলাই মাসে আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের ইচ্ছায় তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। আজকেও কেউ কেউ তাঁর বৈধতার বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন। আইনসভায় তাঁর দলের অবস্থান ও গত সাধারণ নির্বাচনে জনগণের নগণ্য যে ভোট তাঁর দল পেয়েছে, সে কারণেই এ প্রশ্ন। যাহোক, এখন প্রশ্ন হলো, পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের আগপর্যন্ত তাঁর বৈধতা যাচাইয়ের বিকল্প কোনো পথ আছে কি?
শ্রীলঙ্কার চলমান ‘আরাগালায়া’ (সিংহলি ভাষায় এর অর্থ সংগ্রাম) আন্দোলনের কিছু সোচ্চার মুখ এই প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু কারও সেটা শোনার আগ্রহ নেই। মজার বিষয় হচ্ছে, এই প্রশ্ন সংবিধানের বিতর্কিত বিধিগুলো বাতিলের দাবিসহ চলমান আন্দোলনের পুরো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াটির সঙ্গেই সাংঘর্ষিক। আসুন বিস্তারিত ব্যাখ্যা করি। যদি একজন মানুষকেও আরাগালায়া আন্দোলন নিয়ে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি ‘#গোতাগোহোম’ (গোতাবায়া বাড়ি যাও) স্লোগানটির কথায় বলবেন। ঝাঁকের বাইরে এসে আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ যখন প্রশ্ন তুলেছিলেন, আচ্ছা গোতাবায়া বিদায় নেওয়ার পর কী হবে? প্রশ্নটি সবাই জোর করে থামিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, ‘প্রথম বিষয়টি প্রথমে মীমাংসা হোক।’ অন্য কথায়, গোতাবায়ার বিদায়ের পর শ্রীলঙ্কার কী হবে—এ প্রশ্ন জেনেশুনে সযত্নে বইয়ের তাকের পেছনে রেখে দিয়েছিলেন তাঁরা।
আর তাই আন্দোলনের যে সময়টাতে নিজেদের দাবিকে বাস্তব রূপ দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি উদ্যম ও শক্তি প্রদর্শন করা দরকার, সে সময়ই আন্দোলনকারীরা হতোদ্যম হয়ে পড়েছেন। কেউ কেউ তো প্রথমে সতর্কতার সঙ্গে পরে জোরেশোরেই বলতে শুরু করেছেন, আন্দোলনকারীদের এখন বাড়ি ফেরা উচিত। রনিল বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর কেউ কেউ সান্ত্বনা পুরস্কার নিয়ে হাসিমুখে ঘরে ফিরেছেন আবার কারও কারও জন্য পুরস্কারটি হচ্ছে রাজাপক্ষেদের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে উচ্ছেদ করতে পারা। কিন্তু শ্রীলঙ্কাকে খুব ঠান্ডা মাথায় পদ্ধতিগতভাবে কীভাবে এ খাদের কিনারে নিয়ে আসা হলো (৫০ বছর ধরে খুব সুচিন্তিতভাবে সেটা করা হয়েছে), এ প্রশ্ন নিয়ে আন্দোলনকারীরা কোনো কথাই বলেননি। সুতরাং এ আন্দোলন ছিল একটা ক্ষমতার খেলা, এর বেশিও না, কমও না।
দিন শেষে রনিল বিক্রমাসিংহে এখন শ্রীলঙ্কার কার্যত (ডি–ফ্যাক্টো) নেতা। শ্রীলঙ্কান পিপলস ফ্রন্ট বা পদুজানা পেরামুনা দলের সদস্য অথবা অন্য যে কেউ বলতে পারেন, বিক্রমাসিংহে নিজের দক্ষতায় দলের নেতৃত্ব নিয়েছেন। বিক্রমাসিংহে কীভাবে পদুজানা পেরামুনার সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে কেমন করবেন, সেটা বোঝার জন্য অবশ্যই সময় লাগবে। কিন্তু আইনসভার ভেতরে ও বাইরে যাঁরা তাঁর সমালোচক (এর মধ্যে গোতাবায়ার সমর্থকেরাও রয়েছেন), তাঁরা এখন কৃতকর্মের ফল ভোগ করবেন।
শ্রীলঙ্কার চলমান এ আন্দোলনে একের পর এক ঘটনার স্রোত অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথম প্রশ্নটি হলো, এ আন্দোলন আগের গোতাবায়া সরকারের ওপর জনগণের যে বিপুল অসন্তোষ ও ক্ষোভ, সেখানে বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়নি, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর পক্ষগুলোকে জায়গা দেওয়ার ক্ষেত্রে এটা উর্বর ভূমি হিসেবে কাজ করেছে। এদের অনেকে আন্দোলনের শুরুতেই তঁাদের বেসাতি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। কেউ কেউ সরাসরি আসেন, কেউ কেউ আসেন ঘুরপথে। আন্দোলনে বিদেশি দূতাবাসের সম্পৃক্ততার পাশাপাশি গণমাধ্যম, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, থিঙ্কট্যাংকস, এনজিও ও আন্দোলনকর্মীদের অনেকের কাছে সরাসরি অথবা হাত ঘুরে টাকা পৌঁছেছে।
সুতরাং এখন যে প্রশ্ন সামনে এসেছে, তা হলো এ বাস্তবতাতেই কি আরাগালায়া আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে? এটা ভাবার দরকার নেই। এ আন্দোলন রনিল বিক্রমাসিংহেকে ক্ষমতায় আনার জন্য শুরু হয়নি। বিক্রমাসিংহে প্রেসিডেন্ট হওয়ায় তাই এ আন্দোলনের সমাপ্তি হতে পারে না। দীর্ঘ পথ পেরোতে হবে। যুদ্ধে পরাজয়ের মানে এই নয় যে যুদ্ধটাই শেষ হয়ে গেছে। এ যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকেরাও গল্পের অংশ। নিরাশাটাও তাই প্রত্যাশিত। পিছিয়ে যাওয়া কোনো অপরাধ নয়। এ আন্দোলনের অধিকাংশই তরুণ। তাঁদের রয়েছে আদর্শ, সাহস ও সংকল্প। তাঁরা লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। চূড়ান্ত বিজয়ী না হতে পারায় তাঁদের উপহাস করা ঠিক নয়। এখন কেউ কেউ উল্লাস করছে এই বলে যে আরাগালায়া আন্দোলনের মৃত্যু হয়ে গেছে। হ্যাঁ, কিছু আন্দোলনকারী মানসিকভাবে মারা যেতে পারেন, কেউ কেউ আহত হতে পারেন, কেউ কেউ ‘রিটায়ার্ড হার্ট’ হয়ে অবসরে যেতে পারেন, কেউ আবার পালিয়েও যেতে পারেন। কিন্তু এখনো আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ আসেন, যাঁরা বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছেন। সেটাই সবচেয়ে ভালো খবর।
শ্রীলঙ্কার দ্য মিরর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মনোজ দে
● মালিন্দা সেনেভিরত্নে শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক