আগস্টের ২৩ তারিখ মস্কোর উত্তরাঞ্চলে বিমান দুর্ঘটনায় রাশিয়ার ভাড়াটে সেনাদল ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের মৃত্যুর খবর বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। রাশিয়ার সামরিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে হঠকারী ও ক্ষণস্থায়ী বিদ্রোহের দুই মাসের মাথায় এ ঘটনা ঘটল। সে কারণে এই সন্দেহ ছড়িয়ে পড়েছে যে এটা নিছক কোনো দুর্ঘটনা নয়।
প্রথম দিনেই ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, প্রিগোশিনকে হত্যার জন্য ক্রেমলিন হুকুম দিয়েছ—এ রকম যে গুজব ছড়িয়ে পড়েছে সেটা ‘পুরোপুরি মিথ্যা’।
কিন্তু সময় যতই গড়াচ্ছে তথ্য-উপাত্ত ততই শক্ত প্রমাণ হাজির করছে যে দুই দশকের বেশি সময় ধরে লৌহমুষ্টিতে দেশ শাসন করা প্রেসিডেন্ট পুতিনের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর প্রতিশোধ হিসেবে এই হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ভাড়াটে সেনাদলের কমান্ডারকে নাটকীয়ভাবে সরিয়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে পুতিন তাঁর সব মিত্র ও অধীনদের পরিষ্কার একটি বার্তা দিয়েছেন। সেটা হলো তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ভিন্নমত বরদাশত করা হবে না। ইউক্রেন যুদ্ধ তিনি যেভাবে পরিচালনা করুন না কেন, তাতে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। বিরোধিতাকারীরা কত শক্তিশালী কিংবা কত ভালো যোগাযোগ তাদের আছে—সেটা কোনো বিবেচ্য বিষয় নয়।
যে সময়টিতে প্রিগোশিনদের বহনকারী বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছে, সেটা বিশ্লেষণ করে বলা যায়, এটি ছিল পুতিনের ক্ষমতা দেখানোর জন্য একেবারে মোক্ষম একটি সময়। এর ঠিক এক দিন আগে পুতিন দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে ভাষণ (সরাসরি উপস্থিত ছিলেন না) দেন। এই ভাষণে পুতিন ইউক্রেন আগ্রাসনের পক্ষে সাফাই গেয়ে সদস্যদেশগুলোকে তাঁর পক্ষে আসার আহ্বান জানান। আর বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার এক দিন পরেই (তখনো বিশ্বের মনোযোগ প্রিগোশিনের মৃত্যু ঘিরে) উদীয়মান অর্থনীতির শক্তিশালী জোট ব্রিকসে ছয়টি দেশকে নতুন সদস্য করার ঘোষণা দেওয়া হয়। আবার এই সপ্তাহে রাশিয়ার নভোযান লুনা-২৫ চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অভিযানে যায়, যদিও ঘটনাচক্রে অবতরণের আগেই সেটি বিধ্বস্ত হয়েছে।
এ কারণেই বিদ্রোহী কমান্ডারকে (যিনি তাঁর ভাড়াটে সেনা নিয়ে মস্কো অভিমুখে যাত্রা করার মধ্য দিয়ে ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে হুমকি তৈরি করেন) দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা খুবই সুপরিকল্পিত বলেই মনে হয়। এর মধ্য দিয়ে পুতিন বিশ্বকে বার্তা দিতে চেয়েছেন রাশিয়া এখন পর্যন্ত শক্তিমত্তা নিয়েই রয়েছে।
এরপরও প্রিগোশিনের এই মৃত্যু (ইউক্রেন যুদ্ধে যাঁর ভূমিকা দৃশ্যমানভাবে বাড়ছিল) পুতিনকে তাঁর খুনে আগ্রাসনে চালিয়ে নেওয়ার জন্য কোনো সহায়তা করতে পারবে না।
এটা একটা অলঙ্ঘনীয় চক্র। ইউক্রেনে দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা রাশিয়ার সেনাবাহিনীর থাকবে না। লক্ষণটা যদি ঠিকভাবে ধরতে পারি, তাহলে আমরা এটা বলতে পারি যে রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় ভাগনার গ্রুপের প্রধান প্রিগোশিনের মৃত্যুর ঘটনা একদিন হয়তো পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসনের ট্র্যাজিক পরিণতির শীর্ষ মুহূর্ত হিসেবে স্মরণ করা হবে।
প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধবাজের এই মৃত্যু ইউক্রেনের জন্য খুব ভালো একটা খবর।
প্রিগোশিনের সঙ্গে তাঁর কুখ্যাত কমান্ডার দিমিত্রি উটকিনের মৃত্যু সামনের মাসগুলোতে যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে বাড়তি সুবিধা দেবে।
ভাগনার গ্রুপের যোদ্ধারা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে সক্রিয় থাকলেও পদায়ন, অর্থায়ন ও নৈতিক বলের অভাবে তাঁদের ক্ষয় হতে থাকবে। এই অভিজাত ভাড়াটে সেনাদল আর নিয়মিত সামরিক বাহিনীর মধ্যে চলমান যে বিবাদ, তা অব্যাহত থাকবে। ফলে আগ্রাসী বাহিনীর আক্রমণের সক্ষমতা কমে আসতে থাকবে।
প্রিগোশিনের মৃত্যুর পর, এটা এখনো পরিষ্কার নয় যে ভাগনার গ্রুপের সেনাদের মধ্যে এখন যাঁরা যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করছেন না, তাঁদের নিয়ে কী করা হবে। তাঁদের অনেককে আফ্রিকায় নিয়োগ করা হতে পারে, অন্যদের ক্রেমলিনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোতে একীভূত করা হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ভাগনার গ্রুপকে এখন কারা নেতৃত্ব দেবে? যুদ্ধের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কয়েক হাজার ভাগনার সেনা, আদর্শের চেয়ে টাকার প্রতিই যাঁদের আনুগত্য, তাঁদের যে কেউ যেকোনো কাজে ব্যবহার করতে পারবে। যারা তাঁদের সর্বোচ্চ টাকা দিতে পারবে, তারাই শেষ পর্যন্ত তাঁদের কমান্ডার হবে। যদিও ক্রেমলিন এখন চেষ্টা করবে যত বেশিসংখ্যক ভাগনার সেনাকে নিজেদের বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করে নিতে। তাহলেও ভাগনার সেনারা যে রাশিয়ার বাহিনীর ওপর অনুগত থাকবেন, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
ভাগনার বসের মৃত্যু পুতিনের যুদ্ধপ্রচেষ্টাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সেনাবাহিনীর একটি অংশ পুতিনের বিরুদ্ধে চলে যেতে পারে। রাশিয়ার সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্তরে প্রিগোশিন অনেক বড় সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি করে গেছেন। নির্ভীকতা ও সত্য বলার সাহসিকতার জন্য অনেকেই তাঁকে শ্রদ্ধা করেন। তিনি সব সময়ই রাশিয়ান জেনারেলদের দুর্নীতি ও তাঁদের গোঁড়ামিপূর্ণ কমান্ড কাঠামোর সমালোচনা করতেন।
প্রিগোশিন মনে করতেন জেনারেলদের দুর্নীতি আর গোঁড়া মানসিকতার কারণে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া সাফল্য পাচ্ছে না। জাতীয়তাবাদী শক্তি প্রিগোশিনকেই সেনাবাহিনী সংস্কার ও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য সবচেয়ে সেরা ভরসার জায়গা বলে মনে করতেন। প্রিগোশিনের হত্যাকাণ্ড তাঁদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভে আরও উসকে দিতে পারে।
দৃশ্যপট থেকে প্রিগোশিনের এই নাই হয়ে যাওয়া রাশিয়ার জনমতকেও পুতিনের বিরুদ্ধে নিয়ে যেতে পারে।
ক্রেমলিনের প্রোপাগান্ডা যন্ত্র দীর্ঘদিন ধরে জোরালোভাবে প্রচার চালিয়ে আসছে যে ইউক্রেন যুদ্ধ হলো ইউক্রেনীয় ‘নাৎসিদের’ বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ। এই প্রোপাগান্ডা রুশ সমাজের বড় অংশই বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। পুতিন সব সময়ই তাঁর বাগাড়ম্বর দিয়ে জনসাধারণকে মোহিত করে রাখতেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে জয় তো নিয়ে এসেছিলেন প্রিগোশিন। ভাড়াটে বাহিনীর ক্যারিশম্যাটিক নেতার মৃত্যুর পর রুশ সমাজে ইউক্রেন আগ্রাসনের অগ্রগতি কী হলো—সে বিষয়ে অসন্তোষ চূড়ায় পৌঁছাতে পারে। ক্রেমলিনের নেতৃত্বের প্রতি তাঁদের এমনিতেই দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস। এ দুই মিলে পুতিনের বলিষ্ঠ ক্ষমতার মুঠি আলগা হয়ে যেতে পারে।
প্রিগোশিন দৃশ্যের বাইরে চলে যাওয়ায় এখন পুতিনের যুদ্ধ মন্ত্রিপরিষদে সহমত পোষণকারী ও স্তাবকেরা ভিড় করে থাকবেন। সত্য বলার লোক আর থাকবে না।
রাশিয়ার বিপর্যস্ত সেনাবাহিনীকে পুনর্গঠন করা জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন। সত্যিকারের চৌকস কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে নিছক ব্যক্তিগত আনুগত্যের ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর জ্যেষ্ঠ জেনারেলের পদে বসানো হবে। তাতে নিঃসন্দেহে একের পর যুদ্ধে রাশিয়ান বাহিনীকে হেরে যেতে হবে। হতাহত সেনাদের জায়গায় নতুন নিয়োগ দিতে হবে। ক্রমাগত গরিব হতে থাকা একটি সমাজ এই নির্দয় সত্যের মুখে দাঁড়াতে হবে যে তাদের সন্তান আর স্বামীরা মৃত্যুপুরী হয়ে ওঠা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে মাংসের কিমায় পরিণত হচ্ছেন।
এটা একটা অলঙ্ঘনীয় চক্র। ইউক্রেনে দীর্ঘদিন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা রাশিয়ার সেনাবাহিনীর থাকবে না। লক্ষণটা যদি ঠিকভাবে ধরতে পারি, তাহলে আমরা এটা বলতে পারি যে রহস্যময় বিমান দুর্ঘটনায় ভাগনার গ্রুপের প্রধান প্রিগোশিনের মৃত্যুর ঘটনা একদিন হয়তো পুতিনের ইউক্রেন আগ্রাসনের ট্র্যাজিক পরিণতির শীর্ষ মুহূর্ত হিসেবে স্মরণ করা হবে।
ম্যাক্সিম স্ক্রিপহেনকো ট্রান্সআটলান্টিক ডায়ালগ সেন্টারের প্রেসিডেন্ট
আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত মনোজ দে