সুন্দরবনে বাঘের মুখে পড়েছিলেন ৯ বছর আগে। তালপট্টি এলাকায়। সঙ্গীরা লড়াই করে উদ্ধার করে আনেন বনজীবী কুদ্দুসকে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কুদ্দুস। এখন তাঁর বয়স ৫৫। এই বয়সেই কি বসে থাকবেন আবদুল কুদ্দুস? মধু সংগ্রহ করতে আবারও ঢুকেছেন সুন্দরবনে, বৈধ অনুমতি নিয়ে। এবার তিনি সুন্দরবনের কলাগাছী নদীতে শিকার হন কুমিরের আক্রমণের। কুমির তাঁর হাতে কামড় বসিয়ে তাঁকে টেনে নিতে থাকে। সঙ্গীরা লাঠি-হাঁড়ি যা পেয়েছেন, তা দিয়ে পানিতে কোপাতে থাকেন, শেষে তাঁরা তাঁর পা ধরে টানতে থাকলে কুদ্দুসের হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যায় কুমির। রক্তে লাল হয়ে যায় নদীর পানি।
প্রথম আলো অনলাইনে আবদুল কুদ্দুসের ছবি দেখি। তাঁর চোখ দুটো দেখি। এমন করুণ চাউনি! বড় মায়া লাগে!
প্রতিবছর সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে মারা যায় প্রায় ৬০ জন। খুলনা বিভাগে সাপের কামড়ে মারা যায় বছরে প্রায় ৬১৫ জন। এরপরেও মানুষ সুন্দরবনে যায়। মধু সংগ্রহ করে। গোলপাতা সংগ্রহ করে। জেলেরা যান মাছ ধরতে।
বাংলাদেশের যুবকেরা ভয়াবহ বিপৎসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করে কাজের খোঁজে। ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টায় মরক্কোর মতো দেশগুলো থেকে রবারের নৌকায় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশের মানুষ পাচারকারীর কবলে পড়ে জঙ্গলে জিম্মি জীবন কাটায়, মরে পড়ে থাকে দূরপ্রাচ্যের পথে। হিমশীতল বাহনে চড়ে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে জীবন্ত বরফ হয়ে মরে যায়। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে ১৮ হাজার ১৬৬টি প্রবাসীর মরদেহ এসেছে দেশে। পাঁচজনে একজন সেখানে মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়।
এই জীবন বাজি রেখে কাজ করে যাওয়া মানুষেরাই বাংলাদেশকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এগিয়ে নেওয়ার জন্য সিসিফাসের মতো চেষ্টা করছে। এদের জন্যই বাংলাদেশ হারছে না। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তেলের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার শুরুতে বলা শুরু হলো, বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে। প্রস্তুত থাকতে হবে। ব্যয়-সংকোচন করতে হবে।
২০২২ সালের নভেম্বরে একাধিক বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে আহ্বান জানান। তিনি দেশে এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে ২০২৩ সালের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সতর্ক করে দেন এবং ব্যবস্থা নিতে আহ্বান জানান। ২০২৩ সাল পার হয়ে গেছে। দেশে দুর্ভিক্ষ হয়নি। দেশে দুর্ভিক্ষ হতে দেয়নি অন্য আরও অনেক কারণের সঙ্গে দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। আমাদের প্রবাসী শ্রমিকেরা। আমাদের আবদুল কুদ্দুসেরা। আর আমাদের পোশাকশ্রমিকেরা।
১২ মে মা দিবসে আমি ছিলাম দুবাই থেকে ঢাকার ফ্লাইটে। এই ফ্লাইটে অভিবাসী শ্রমিকেরা থাকেন। আমার পাশে দুজন কথা বলছিলেন। একজন আরেকজনকে বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, প্লেন কি মেঘের নিচে নেমেছে?
না। নামেনি।
ঘরবাড়ি দেখা যায়?
যায়। ছোট ছোট। মেঘের নিচে।
তাইলে তো প্লেন মেঘের নিচে নামছে!
না নামে নাই।
তাইলে ঘরবাড়ি দেখা যাইব কেমনে?
আয়। তুই দেখ জানালা দিয়া।
তখনো প্লেন ঢাকা থেকে দুঘণ্টা দূরে। কেবল আমরা ভারতের আকাশে ঢুকেছি। প্লেন যখন ঢাকার কাছে এল, ঘরবাড়ি, নদীনালা দেখা যাচ্ছে, তাঁরা আবেগে আপ্লুত হয়ে উঠলেন। ওই তো আমাদের দেশ। এই যে ঢাকা...
আমার মনে হলো, মা দিবসে সন্তানেরা মায়ের কাছে ফিরছেন। বাংলা মায়ের মুখ দেখে তাঁরা চোখ মুছছেন।
এই দেশপ্রেমিক প্রচণ্ড পরিশ্রমী বাঘের মুখ থেকে কুমিরের মুখে পড়েও হার না-মানা মানুষগুলো বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ হতে দেবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও সতর্ক করেছেন, মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা লাগতে পারে। আবারও কি মধ্যপ্রাচ্যে মরুভূমির বালিতে মগজ গলানো মানুষগুলোই আমাদের বাঁচিয়ে দেবে?
একটু একটু করে মধু সংগ্রহ করেন সুন্দরবনের মৌয়ালেরা। একটা একটা করে মাছের পোনা ধরেন সুন্দরবনের জেলেরা। নিজেরা না খেয়ে একটা ঘরে ১৪ জন গাদাগাদি করে শুয়ে ডলার বাঁচিয়ে দেশে পাঠান প্রবাসী শ্রমিকেরা। আর ঢাকায় কিংবা চট্টগ্রামের সাহেবেরা এসি রুমে বসেন, পাঁচটা-ছয়টা আউডি মার্সিডিজ বিএমডব্লিউ গরুর পালের মতো পড়ে থাকে তাঁদের গ্যারাজে, তাঁরা একটা ফোনে ৫০০ কোটি-এক হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে তুলে ফেলতে পারেন। সেই টাকা তাঁরা দেশে শিল্পে-ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে পাঠিয়ে দেন বিদেশে।
কেন আমরা দেশটা গোছাতে পারি না। রাস্তাঘাটে মানুষেরা আমাদের ধরে, প্রশ্ন করে, কেন দেশটার এই হতদশা জানেন? কারণ, যাঁদের করবার কথা, তারা দেশের টাকা পাচার করে বিদেশে রেখেছেন। এই জন্য দেশটাকে গুছিয়ে রাখার কথা তাঁদের ভাবনাতেই নেই। এটা সাধারণ মানুষের পারসেপশন। যদি কেউ আপত্তি করতে চান, করতে পারেন।
কানাডায় বেগমপাড়া গড়েন, ইস্তাম্বুলে-দুবাইয়ে বাড়ি কেনেন, আমেরিকা-মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুরে বিলাসব্যসনে বিনিয়োগ করেন, পানামার মতো দেশগুলোতে অফশোর বিনিয়োগ করেন। দেশটা মাড়াই মেশিন থেকে বেরোনো আখের মতো ছোবড়া হয়ে যায়। কেন এত ঋণখেলাপি? কেন এত ডলার পাচার?
বিদেশ থেকে দেশে এলে মনটা খারাপ হয়। ঢাকার আকাশে ঢুকলেই বোঝা যায়, এটা ঢাকা। বাতাস এত ধোঁয়াশাময়। যেমন নদীপথে এলে ঢাকার নিকটবর্তী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গন্ধ এসে ধাক্কা দেয় নাসিকায়, বলে দিতে হবে না, এসে গেছি ঢাকায়। টাকা খরচ করছি, কিন্তু সবকিছু আমরা গুছিয়ে রাখতে পারি না কেন। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিই। আপনারা মেট্রোরেলের নিচের সড়ক এবং সড়কদ্বীপ খেয়াল করুন। রাস্তা ভালো, সড়কদ্বীপ পরিষ্কার। মেট্রোর পিলারগুলোতে পোস্টার নেই, আমরা লাগাচ্ছি, ওঁরা তোলার চেষ্টা করছেন। তুলনা করুন, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের সঙ্গে। ময়লা, আবর্জনা, আস্তাকুঁড়, ভাঙা গাড়ি, দোকানপাট, পলিথিন—অবর্ণনীয়।
চেষ্টা করলে যে ভালো থাকা যায়, ঢাকার মেট্রোই তো তা দেখিয়ে দিচ্ছে। অথচ আমাদের বিমানবন্দরের বাইরে কী বিশৃঙ্খলা। গাড়ি কোন দিক দিয়ে ঢুকবে, বেরোবে, লাগেজ নেবে, তারপর বিমানবন্দরের প্রবেশমুখ, উত্তরাগামী রাস্তা—সব নৈরাজ্যের পরম প্রতিমূর্তি। স্থপতি মাজহারুল ইসলাম বলতেন, দেশটাকে একটু গুছিয়ে রাখো!
কেন আমরা দেশটা গোছাতে পারি না। রাস্তাঘাটে মানুষেরা আমাদের ধরে, প্রশ্ন করে, কেন দেশটার এই হতদশা জানেন? কারণ, যাঁদের করবার কথা, তারা দেশের টাকা পাচার করে বিদেশে রেখেছেন। এই জন্য দেশটাকে গুছিয়ে রাখার কথা তাঁদের ভাবনাতেই নেই। এটা সাধারণ মানুষের পারসেপশন। যদি কেউ আপত্তি করতে চান, করতে পারেন।
আরেকটা দুর্ভাবনার কথা বলে রাখি। গত সেপ্টেম্বরে আমেরিকার ইলিনয়ে গিয়েছিলাম ওদের কৃষিকাজ দেখতে। আড়াই হাজার একর জমি চাষ করেন চারজন। ওঁরা বললেন, লোক বেশি। চার হাজার একর চাষ করবেন চারজন। তাহলে পোষাবে। ঘরে কম্পিউটারের সামনে বসে এঁরা ট্রাক্টর চালান গেম খেলার মতো করে; ফসল কাটা, বীজ বোনা—সব করে বড় বড় যন্ত্র।
মার্চে গিয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়া। একটাই অভিজ্ঞতা, মানুষবিহীন সবকিছু চলছে যন্ত্রের মাধ্যমে। একটা বিশাল গাড়ির পার্কিংয়ে শত শত গাড়ি, কিন্তু একজনও মানুষ নেই। যাত্রীরা মেশিনে টাকা দিচ্ছে, গেট খুলে যাচ্ছে, গাড়ি রেখে চলে যাচ্ছে। বিমানবন্দরগুলোতেও এখন মানুষের সাহায্য ছাড়া চেক-ইন ইত্যাদি করা হচ্ছে। বাংলাদেশেও পোশাকশিল্পে, টেক্সটাইলে রোবট কাজ করে। তার মানে এআই, রোবট, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আর কল্পকাহিনি নয়, বাস্তব!
আমরা এখনো মানুষের শক্তিতে চলছি। মানবসম্পদই আমাদের বড় সম্পদ। কিন্তু মানুষের কায়িক শ্রমের যদি আর দরকার না পড়ে, সবই যন্ত্র করে দেয়, তাহলে কুড়ি বছর পর এই বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ে আমরা করবটা কী?
মানুষগুলোকে দক্ষ করে তুলতে হবে। আমরা যন্ত্র চালাব, যন্ত্র তৈরি করব, এআই ব্যবহার করব। তাহলে লাগবে শিক্ষায় বিনিয়োগ!
সবকিছুর মূলে পরিকল্পনা। ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে গাজা যুদ্ধ, বাঘের মুখ থেকে কুমিরের মুখে পড়া কুদ্দুসরা তা থেকে আমাদের বাঁচিয়ে দেবে। কিন্তু ব্যাংক লুট, টাকা পাচার, দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং লুটপাটের যে থাবা আমাদের প্রতিনিয়ত আঘাত করছে, তা থেকে আমাদের বাঁচাবে কে?
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক