গত বছরের নভেম্বরেই বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে লিখেছিলাম। শীত আসছিল, তখন সবাইকে সাবধান আর সরকারকে ব্যবস্থাপনা ঠিক করার অনুরোধ ছিল। কিন্তু শেষ কয়েক দিনের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, আমরা কেন লিখি? আমাদের লেখা কি সরকারের কেউ দেখে? ফেসবুকে বঙ্গবাজারের ছবি দেখে কষ্টে বুক ভেঙে যাচ্ছে। বেশ কয়েকবার সামলে উঠলেও এবার এই মন্দার মধ্যে ব্যবসায়ীরা কীভাবে সামলাবেন!
বঙ্গবাজার—আমাদের অনেকের স্মৃতি আছে এখানে বাজার করার। এ যুগের মানুষ বুঝবে না, আমাদের দেশের মানুষকে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীরা কীভাবে স্বল্পমূল্যের পোশাক দিয়ে চলতে সাহায্য করেছে। আজ তা আর নেই। ঠিক বিপরীত পাশেই ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তর, তা-ও আগুনের হাত থেকে বাঁচানো যায়নি! এটাই আমাদের সক্ষমতা? আর কত কাছে ফায়ার সার্ভিস অফিস সম্ভব? কেন তবে বঙ্গবাজারকে বাঁচানো যায়নি? উত্তর কে দেবে? এখানে পরিষ্কারভাবে ফায়ার সার্ভিসের অদক্ষতা ফুটে উঠেছে।
আমরা দেখেছি, ঢাকাতেও আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই। যদি কখনো তুরস্কের কাছাকাছি মাত্রারও ভূমিকম্প হয়, এই দেশের কী হবে? আমাদের ট্যাক্সের টাকা অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প হয়। কিংবা পাচার হয় বা ঋণখেলাপিদের কাছে যায়। কিন্তু আমাদের বাঁচানোর জন্য কত শতাংশ ব্যয় হয়? ভূমিকম্প হলে মেগা প্রকল্পগুলোই তো আমাদের মাথার ওপর পড়বে।
এর আগে দুটি ভবনে পরপর বিস্ফোরণ দেখলাম। সেখানেও নাজেহাল অবস্থা! উদ্ধার অভিযানের একপর্যায়ে রাতে উদ্ধার অভিযান বন্ধ করে দিতে হলো। কারণ, কলামের স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। রাজউক থেকে পরদিন মানুষ এসে ঠিক করার পর আবার কাজ শুরু হয়। কেন রাতে জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করা যায়নি? এগুলো তো যেকোনো উদ্ধার অভিযানের মৌলিক বিষয়। ১২ ঘণ্টা বিরতিতে একজনও যদি মারা যান, এটা তো কাঠামোগত হত্যা।
তারপর গ্যাসের কথা বলা হচ্ছে? বাসাবাড়ির নিরাপত্তাব্যবস্থা দেখার দায়িত্ব কাদের? অনেক বাড়িতে ২০ বছরের ওপরে গ্যাস বা বিদ্যুতের লাইন করা হয়েছে। মাসে মাসে বিল বাড়াচ্ছেন, কিন্তু নিরাপত্তা দেখার দায়িত্ব যাঁদের, তাঁদের কেন অবহেলা! গাড়ির যেমন নিয়মিত সব জিনিস চেক করা লাগে, বাসাবাড়িরও বিদ্যুতের লাইন আর গ্যাসের লাইনের চেক আবশ্যক। সিটি করপোরেশনের ট্যাক্স বাড়াতে চিন্তা করা লাগে না, কিন্তু কোনো কাজের দায়িত্ব নেওয়ার কেউ নেই।
চট্টগ্রামে রাসায়নিক বিস্ফোরণ বা পুরান ঢাকার রাসায়নিক বিস্ফোরণের ঘটনায় কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। হলে এ বছর একই রকম বিস্ফোরণ হতো না।
বনানীর আগুন ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়ার পরও যে দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা বাড়েনি, তার প্রমাণ গুলশানে আগুন মোকাবিলা করতে না পারা। এত যে ঘাটতি, কেউ কি দেখার নেই?
মূলত দুটি জায়গা থেকে বাসাবাড়ি বা দোকানে আগুন লাগতে পারে—বিদ্যুৎ আর গ্যাসের লাইন। এখন সিলিন্ডারের ব্যবহার বাড়াতে দিন দিন বাড়িগুলো একটা জলজ্যান্ত বোম হয়ে যাচ্ছে। আর গ্যাসের পুরোনো লাইনগুলোর নিয়মিত চেক করা হয় না। একই রকম বিদ্যুতের লাইনেরও নিয়মিত চেক করা হয় না। সঙ্গে আছে অবৈধ লাইন। এমনভাবে সব কানেকশন দেওয়া হয়, কোনো রকম নিরাপত্তা সেখানে একেবারেই অনুপস্থিত।
আমরা দেখেছি, ঢাকাতেও আমাদের জীবনের নিরাপত্তা নেই। যদি কখনো তুরস্কের কাছাকাছি মাত্রারও ভূমিকম্প হয়, এই দেশের কী হবে? আমাদের ট্যাক্সের টাকা অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প হয়। কিংবা পাচার হয় বা ঋণখেলাপিদের কাছে যায়। কিন্তু আমাদের বাঁচানোর জন্য কত শতাংশ ব্যয় হয়? ভূমিকম্প হলে মেগা প্রকল্পগুলোই তো আমাদের মাথার ওপর পড়বে। এসব মেগা প্রকল্পের অন্তত একটা বাদ দিয়ে নিরাপত্তা তদারকি দল আর উদ্ধারকারী দলের সক্ষমতা বাড়ানো উচিত। সবার আগে দরকার স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি, যা আজ পুরোপুরিই এই দেশ থেকে অনুপস্থিত।
সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলামিস্ট। ই-মেইল: [email protected]