দেশের অর্থনীতি এখন চাপের মুখে আছে। সরকার এর দায় কোভিড ও ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ওপর চাপাতে চায়। সমালোচকেরা অবশ্য মনে করেন, লাগামছাড়া দুর্নীতি ও সরকারের ভুল নীতি পরিস্থিতিকে এতটা শোচনীয় করে তুলেছে। তবে বর্তমান অবস্থা বাদ দিলে গত কয়েক দশকে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে দেশ যথেষ্ট এগিয়েছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সূচকেও এসব সাফল্যের স্বীকৃতি পাওয়া গেছে।
আবার রাজনীতি বিবেচনায় নিলে গত এক দশকে বাংলাদেশের অনেক খারাপ দিক সামনে চলে আসে। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা আছে। এই সময়ে দেশে দু-দুইি বাজে নির্বাচন হয়েছে। গণতন্ত্রের মান নেমেছে। মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কমেছে এবং আচার-আচরণে সরকার কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে।
দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা-ই হোক, দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক নিরাপত্তা ধারণায় আগে শুধু প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোকে বিবেচনায় নেওয়া হতো। সেই ধারণা পরে যখন ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে পরিণত হয়, তখন ভারত মহাসাগরও এতে যুক্ত হয়ে পড়ে। তখন থেকেই বাংলাদেশের ভূকৌশলগত গুরুত্ব বাড়তে থাকে।
বিশ্বরাজনীতিতে চীনের ভূমিকা বাড়তে শুরু করায় যুক্তরাষ্ট্র তার কৌশল বদল করে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের প্রতিযোগিতার কারণে বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্র এখন ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয়েছে। এই দুই দেশ স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলের দেশগুলোকে তাদের পক্ষে রাখতে চায়। সেই হিসাবে বাংলাদেশকেও তারা নিজেদের পক্ষে চায়।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বাড়িয়েছে। এই যুদ্ধে রাশিয়া-চীন একদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিম আরেক দিকে। এক পক্ষ চায় ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার বিরোধিতা করুক বাংলাদেশ। অন্য পক্ষ চায় নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকুক বাংলাদেশ। বাংলাদেশ কখনো এদিক, কখনো ওদিক করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধকে উপেক্ষা করতে পারছে না বাংলাদেশ। আবার রাশিয়াকেও পারছে না দূরে ঠেলতে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার দূতাবাসের পাল্টাপাল্টি মন্তব্য ও তৎপরতা আগে কখনো কি দেখা গেছে? কিন্তু ইউক্রেন সংকট ঘিরে তেমন অভিজ্ঞতাই আমাদের হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক থিঙ্কট্যাংক লয়ি ইনস্টিটিউট প্রতিবছর এশিয়ান পাওয়ার ইনডেক্স প্রকাশ করে। ২০২২ সালের সূচকে ২৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৯। এই অঞ্চলে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী ও শক্তিশালী সামরিক উপস্থিতির কারণে তালিকার ১ নম্বরে আছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর চীন, জাপান ও ভারতের অবস্থান। মিয়ানমারের স্থান বাংলাদেশের পেছনে, ২২ নম্বরে।
যখন কোনো দেশ দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি বা শিবিরের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, তখন দর-কষাকষির ক্ষমতা বাড়ে। ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজে লাগানো যায়। যুক্তরাষ্ট্র যখন তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে মাঠে নেমেছে, তখন থেকেই বাংলাদেশ দুই শিবিরের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করে আসছে। বাংলাদেশ চীনের বৈশ্বিক যোগাযোগ অবকাঠামো বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে যুক্ত হয়েছে।
নির্বাচন সামনে রেখে এমন একটি পরিস্থিতি বাংলাদেশ ও এর জনগণের জন্য কতটা স্বস্তিকর? ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো কিংবা নতুন কোনো কৌশলে আরেকটি একতরফা নির্বাচন কি দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে? বাংলাদেশ ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে—একে আমরা উদ্যাপন করতে পারি। কিন্তু ভূরাজনীতি যদি দেশের রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়, জনগণ যদি সেখানে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, তবে তা সত্যিই বিপদের কথা।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র কোয়াড, আইপিএস, জিএসওএমআইএ বা এসিএসএর মতো নানা কৌশলগত ও সামরিক উদ্যোগে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। বাংলাদেশ এসব নিয়ে হ্যাঁ বা না কিছুই বলেনি। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে চাপ ভবিষ্যতে বাড়বে বলেই মনে হয়। আবার এসব উদ্যোগে যোগ দিলে চীন যে বিরক্ত হবে, তা তারা স্পষ্ট করেই বিভিন্ন সময় বলেছে। বোঝা যায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কাজটি বেশ জটিল হবে।
একসময় দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের আধিপত্য মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্র অনেকটাই ভারতের ওপর নির্ভর করার নীতি নিয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে তারা সরে এসেছে বলে পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন। আবার ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পরের বিশ্বরাজনীতিও অনেক হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে, দুই চরম প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ ভারত ও চীনের অবস্থান রাশিয়ার পক্ষে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের বিরুদ্ধে। ভূরাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা বাংলাদেশ এই পরিবর্তনগুলোর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।
জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এক অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতি। কীভাবে বা কেমন হবে সেই নির্বাচন, তা নিয়ে সবাই অন্ধকারে আছে। এসব বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। কিন্তু ভূরাজনীতি এসব বিষয়কে অভ্যন্তরীণ থাকতে দেয় না। বাংলাদেশের গত দুটি নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা প্রশ্ন উঠেছে। কিন্তু ভারত কোনো রাখঢাক ছাড়াই সরকারকে সমর্থন দিয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র কার্যত ভারতের অবস্থানকেই মেনে নিয়েছে। একই সঙ্গে সরকার বেশ সফলভাবেই চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের অবস্থানের কোনো নড়চড় হয়েছে, এমন ইঙ্গিত নেই। কিন্তু এ অঞ্চলের ভূরাজনীতির অনেক হিসাব-নিকাশ বদলে যাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখন ভারতের সঙ্গে না-ও মিলতে পারে।
গণতন্ত্র, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের আয়োজন; মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতাসহ নানা ইস্যুতে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ যে বাড়বে, তা স্পষ্ট। র্যাব ও এর কিছু কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা ও গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে। সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কিছু হয়নি। একই সঙ্গে দেখা গেল, এ বছরের মার্চে যে দ্বিতীয় গণতন্ত্র সম্মেলন হতে যাচ্ছে, তা থেকেও বাদ পড়েছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের কাউন্সেলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপদেষ্টা ডেরেক শোলে বাংলাদেশ সফরে এসে গত বুধবার আবার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, মানবাধিকার ও ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতা দেখানোর বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিয়ে গেলেন।
ডেরেক শোলের সফরের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল রোহিঙ্গা ইস্যু। এই সংকট সমাধানে তিনি বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা বলেছেন। এই ইস্যুতে চীন বা ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ যথাযথ সহায়তা পায়নি। এই দুটি দেশের অবস্থান পরিষ্কারভাবেই মিয়ানমারের পক্ষে। গত ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে সিনেটে ‘বার্মা অ্যাক্ট’ পাস হয়েছে। চীনের নিয়ন্ত্রণে থাকা মিয়ানমারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র যে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে, তা বোঝা যায়। এ অঞ্চলের ভূরাজনীতিতে এই অ্যাক্টের প্রভাব সামনে পড়বে। এই অঞ্চল নিয়ে বেশ আটঘাট বেঁধেই নেমেছে যুক্তরাষ্ট্র। বোঝা যায়, চীনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে নিজেদের বলয়ে যুক্ত করার চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের তরফে অব্যাহত থাকবে।
দেশের রাজনীতিতে সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ক্ষমতা ধরে রাখা এবং একই সঙ্গে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা। সরকার যদি তেমন একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের চাপ উপেক্ষা করার পথ ধরতে হবে। বাংলাদেশ তখন নিশ্চিতভাবেই চীনকে পাশে পাবে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব গত বুধবার বাংলাদেশে এসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি ভারতের পূর্ণ সমর্থনের কথা জানিয়ে গেছেন। তার মানে, ভারত ও চীন—এই অঞ্চলের দুই পরাশক্তিকে পাশে পাওয়া সরকারের জন্য খুব কঠিন কিছু নয়। আর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেনদরবার করে এবং কিছু চাওয়া পূরণ করে সরকার যদি তাদের সঙ্গে কোনো একধরনের সমঝোতায় আসতে পারে, তাহলে তো সব কুলই রক্ষা করা যাবে।
নির্বাচন সামনে রেখে এমন একটি পরিস্থিতি বাংলাদেশ ও এর জনগণের জন্য কতটা স্বস্তিকর? ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো কিংবা নতুন কোনো কৌশলে আরেকটি একতরফা নির্বাচন কি দেশের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে? বাংলাদেশ ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে—একে আমরা উদ্যাপন করতে পারি। কিন্তু ভূরাজনীতি যদি দেশের রাজনীতির অন্যতম নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়ায়, জনগণ যদি সেখানে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে, তবে তা সত্যিই বিপদের কথা।
এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক