ডোনাল্ড ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের পর থেকে তাঁর নতুন প্রশাসনের আফগানিস্তান নীতি কেমন হতে পারে, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেকের ধারণা, ট্রাম্প তালেবানের প্রতি কঠোর মনোভাব গ্রহণ করবেন। তবে তাঁর পূর্ববর্তী কর্মকাণ্ড এবং এ–সংক্রান্ত বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তিনি তাঁর প্রথম মেয়াদে যে বাস্তববাদী ও হস্তক্ষেপবিরোধী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছিলেন, সেই নীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনবেন না।
প্রথম মেয়াদে দীর্ঘ মেয়াদে বাইরের দেশগুলো নিয়ে মাথা না ঘামানোর নীতি নিয়েছিলেন ট্রাম্প। বিশেষত, আফগানিস্তানে দীর্ঘস্থায়ী মার্কিন উপস্থিতির বিরোধিতা করে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছিলেন তিনি।
ট্রাম্পই ২০২০ সালের দোহা চুক্তির স্থপতি, যা মার্কিন বাহিনীর আফগানিস্তান থেকে সরে আসার পথকে সুগম করেছিল এবং শেষ পর্যন্ত তালেবানের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করেছিল।
দোহা চুক্তি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান–কৌশলের একটি বড় মোচড়। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া নীতির অগ্রগতিতে অসন্তুষ্ট ট্রাম্প তাঁর সামরিক উপদেষ্টাদের মধ্যে দায়িত্বশীলতার অভাব দেখতে পেয়েছিলেন। ভোটারদের কাছে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘতম ও ব্যয়বহুল যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে সক্ষম। যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাতে ঐতিহ্যগত কৌশলগুলো ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি তালেবানের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা শুরু করেছিলেন।
পুনর্নির্বাচনের পর ট্রাম্প এবার সম্ভবত তাঁর সেই ব্যবসায়িক মনোভাবসম্পন্ন পররাষ্ট্রনীতি বহাল রাখবেন। আফগানিস্তানসহ অন্যান্য জায়গায় ব্যয়বহুল সংঘাত বা সামরিক হস্তক্ষেপে না জড়িয়ে তার বদলে বাস্তববাদী চুক্তিতে যাওয়াকে অগ্রাধিকার দেবেন।
তালেবানও মনে করে, ট্রাম্প প্রশাসন তাদের ভবিষ্যতের জন্য উপকারী হতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আবদুল কাহার বালখি নভেম্বর মাসে এক্সে (সাবেক টুইটার) এক পোস্টে বলেছেন, ‘আমরা আশা করি, ভবিষ্যৎ ট্রাম্প প্রশাসন দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে এবং উভয় জাতি সম্পর্কের একটি নতুন অধ্যায় খুলতে পারবে।’
ভবিষ্যৎ সম্পর্কের প্রতি তালেবানের এই আশাবাদ মূলত ট্রাম্প প্রশাসনের প্রথম মেয়াদে তাদের ইতিবাচক অভিজ্ঞতা থেকে এসেছে।
তালেবান জানে, প্রথম ট্রাম্প প্রশাসন সরাসরি তালেবানের সঙ্গে আলোচনার সূচনা করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া শুরু করে এবং কাবুলে তাদের ফিরে আসার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
তবে এটিও তালেবান জানে, ট্রাম্প তালেবানের সঙ্গে বাস্তববাদী সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হলেও তাদের পুরোপুরি ইচ্ছেমতো দেশ চালানোর সুযোগ দেবেন না বা বিনা শর্তে প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করবেন না।
যদি তালেবান দোহা চুক্তির প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়, তাহলে ট্রাম্প সম্ভবত আফগানিস্তানে মার্কিন সাহায্য কমিয়ে দেবেন বা নির্দিষ্ট শর্তে তা দেবেন। তিনি ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে বিদেশি সাহায্য কমানোর পক্ষে। প্রয়োজনে তিনি তালেবানের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতেও দ্বিধা করবেন না।
বর্তমানে তালেবানের শাসনকালে প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার মানবিক সহায়তা আফগান জনগণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যদি এই সাহায্য কমে যায়, তাহলে আফগান অর্থনীতি আরও দুর্বল হবে এবং জনগণের জীবনযাত্রার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়বে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে উন্নতিও হ্রাস পাবে। ট্রাম্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আফগানিস্তান নিয়ে বৈশ্বিক মনোযোগ কমে গেছে। মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এবং ইউক্রেন ও ফিলিস্তিনের সংঘাতের কারণে আফগানিস্তান এখন আর ওয়াশিংটনের প্রধান অগ্রাধিকারে নেই। এ কারণে ট্রাম্প তাঁর নতুন মেয়াদে হয়তো মনে করবেন, আফগানিস্তান এখন এমন একটি সমস্যা, যা তিনি আগেই সমাধান করে রেখেছেন।
তবে যদি ট্রাম্প সাহায্য কমান বা তালেবানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেন, তাহলে আফগানিস্তানের অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে। এতে দেশটিতে অস্থিরতা বাড়বে, নতুন করে অভিবাসনসংকট দেখা দেবে এবং চরমপন্থী গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা আরও বেড়ে যেতে পারে।
মার্কিন জনগণের যে অংশ বিদেশি সংঘাতে জড়ানোর বিষয়ে সতর্ক, তাদের কাছে ট্রাম্পের হস্তক্ষেপবিরোধী নীতি জনপ্রিয় হতে পারে। তবে ট্রাম্পের এই নীতির কারণে অধিকতর দুর্বল ও দরিদ্র আফগানিস্তান ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে।
এমন পরিস্থিতি আফগান জনগণের জন্যও ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। এতে দেশটির অর্থনৈতিক দুর্দশা আরও বাড়বে। সেখানে স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়তে পারে। নতুন করে দেশটিতে সংঘাত দেখা দিতে পারে এবং দেশটি বিশ্বের বাকি অংশ থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।
এটি শুধু আফগান জনগণকেই নয়, বরং পুরো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও প্রভাবিত করবে।
মোদ্দাকথা, দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পকে আফগানিস্তান নীতিতে সফল হতে হলে বাস্তববাদী বিচ্ছিন্নতা ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায় একটি সংঘাতের অবসান ঘটানোর চেষ্টায় নতুন ও আরও জটিল সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে।
● আজিজ আমিন যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড গ্লোবাল সোসাইটি থিঙ্কট্যাংকের একজন ফেলো এবং লেখক ও বিশ্লেষক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ