নজিরবিহীন মৃত্যুময় দিনের দায়

‘এই শোক আমরা ভুলব কী করে? এই ক্ষত মুছবে কী করে?’ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

২০২৪-এর জুলাইয়ে যা ঘটল, তা স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এত মৃত্যু এর আগে কোনো আন্দোলনে ঘটেনি। বাবার কোলে শিশু মারা গেছে, ঘরের জানালা বন্ধ করতে গিয়ে মারা গেছে বাচ্চা ছেলে। এত রাবার বুলেট, এত কাঁদানে গ্যাসের শেল, এত সাউন্ড গ্রেনেড, এত গুলি আর কোনো সময়ে ছোড়া হয়েছে বলে আমাদের মনে পড়ে না। আন্দোলন দমনে বা পুলিশ উদ্ধারে হেলিকপ্টারের ব্যবহার এর আগে হয়েছিল কি? সারা দেশে একযোগে এত মানুষ রাস্তায় নেমেছিল কি না, সেটাও আমাদের স্মৃতিতে নেই।

১৪ জুলাই ২০২৪ শিক্ষার্থীরা যেদিন রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দিতে গেল, সেদিনও যদি মীমাংসার উদ্যোগ নেওয়া হতো, দায়িত্বশীল নেতৃস্থানীয়রা যদি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসতেন, যদি বলতেন, তোমরা কোটা চাও না, আমরাও তো চাই না, আমরাই তো হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছি, ছাত্রলীগ যদি ‘মেধা না কোটা, মেধা মেধা’ বলে শিক্ষার্থীদের কাতারে যোগ দিত, তাহলে আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো বলে মনে হয় না।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপরে যখন বাইরে থেকে আক্রমণ হতে লাগল, তখন রাস্তায় নেমে এল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তারপর, আমরা দেখলাম, স্কুলের ইউনিফরম পরে কিশোর শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ বন্ধ করেও কুলাল না, প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত বন্ধ করে দিতে হলো।

বোঝাই যায়, নীতিনির্ধারকেরা এই রকম ছাত্রশক্তির প্রচণ্ডতা আঁচই করতে পারেননি। ভেবেছিলেন, ছাত্রলীগই যথেষ্ট। ক্ষমতা মানুষকে নিঃসঙ্গ করে, ক্ষমতাকে ঘিরে থাকে চাটুকারেরা, তারা কখনো প্রকৃত সত্য কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছাতে দেয় না। ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে, বধির করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে লিখেছিলেন, ‘জনাব নুরুল আমিন কত বড় অপরিণামদর্শী কাজ করলেন। গুলি ছুড়লেন তাও ছাত্রদের ওপর। মানুষের যখন পতন আসে, তখন পদে পদে ভুল করতে থাকে।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা বলেছেন, তাঁদের কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই, কেউ এই আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নিক, এটা তাঁরা চান না এবং কোনোরকমের ভাঙচুর, সন্ত্রাস, আগুন, ধ্বংসের সঙ্গে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কোনো সম্পর্ক নেই।

এরপর শুরু হলো ধ্বংস, আগুন, লুটপাট। তখনো হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়। ঢাকায় এখানে ধোঁয়া উড়ছে, ওইখানে দাউ দাউ শিখা জ্বলছে, দমকল সেখানে পৌঁছাতে পারছে না। সারা দেশ থেকে এখন ধ্বংসের যে বিপুল বিবরণ আসছে, তাতে মনে হয়, দুটো দিন প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না বহু জায়গায়।

আন্দোলন আর কোটা সংস্কারে সীমিত রইল না।

সবাই বলছেন, এর মূলে আছে মানুষের বহুবিধ ক্ষোভ। জিনিসপত্রের দাম বেশি, মূল্যস্ফীতি লাগামহীন। একটার পর একটা দুর্নীতির খবর আসতে লাগল, এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজে বললেন, তাঁর পিয়ন চার শ কোটি টাকার মালিক। নির্বাচন হয়েছে নামমাত্র, বিরোধী দলবিহীন। মানুষ কথা বলতে ভয় পায়, ফেসবুকে কিছু বললেই নেমে আসে সাইবার সিকিউরিটি। এলাকায় এলাকায় ক্ষমতাসীন নেতা, পাতিনেতাদের দৌরাত্ম্য। একদিকে ব্যাংক খালি করা হচ্ছে, আরেক দিকে টাকা পাচারে দেশ শীর্ষ তালিকায় উঠে গেছে।

এই সুযোগ নেওয়ার জন্য বসে ছিল রাজনৈতিক ও আদর্শগত বিরোধীরা। বিএনপি প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে মাঠে নেমেছিল। তবে সরকার যেমনটা অভিযোগ করছে, জামায়াত-শিবির আগেই সারা দেশ থেকে ঢাকার আশপাশে এসে অবস্থান নিয়েছিল, তা যদি হয়ে থাকে, তাহলে বলতে হবে, জামায়াত-শিবির কর্মীদের কৌশল ধরতেও সরকার ব্যর্থ হয়েছে।

শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যখন সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে তা হয়ে ওঠে লক্ষ্যহীন, নেতাহীন, কর্মসূচিহীন। এ ধরনের আন্দোলন বিপজ্জনক। কোনো দায়িত্ববান নেতা এই সময় রাস্তায় থাকলে জনতাকে এইভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতেন না। আমরা আমাদের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে দেখেছি, দায়িত্বশীল নেতারা এই সমস্ত পরিস্থিতিতে বন্দুকের মুখ থেকে উত্তেজিত জনতাকে সরিয়ে আরেক দিকে নিয়ে যেতেন।

স্বাধীন দেশে এত ব্যাপক আন্দোলন আমরা আর দেখিনি! আমরা তো নব্বইয়ের আন্দোলনে মিছিলে ছিলাম। তাহলে নব্বই বা উনসত্তরের আন্দোলনের সঙ্গে এবারের আন্দোলনের পার্থক্য কী?

এইবারের আন্দোলনের কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও কর্মসূচি ছিল না। এবারের আন্দোলনে নিয়ামক শ্রেণি-পেশার মানুষ যোগ দেয়নি। ১৯৯০-এ সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতি, সব সাংবাদিক সমিতি, প্রেসক্লাব, চিকিৎসকদের সংগঠন, ইঞ্জিনিয়ারদের সংগঠন, কৃষিবিদদের সংগঠন যোগ দিয়েছিল। মতিঝিলের অফিসপাড়া থেকে কর্মকর্তা কর্মচারীরা রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। ১৯৯৬ সালে সচিবালয় থেকে কর্মচারী-কর্মকর্তারা রাস্তায় এসে যোগ দিয়েছিলেন। এরপর আর ক্ষমতায় থাকা ক্ষমতাসীনদের পক্ষে সম্ভব হয়নি।

এবারের আন্দোলনে সে রকম কিছু ঘটেনি। দুই শরও বেশি মানুষ মারা গেছে। অগণিত মানুষ আহত। শুধু চোখে আঘাত নিয়ে কতজন হাসপাতালে আছে, কতজন দৃষ্টি হারাবেন! এই শোক আমরা ভুলব কী করে? এই ক্ষত মুছবে কী করে?

এই বিপুল প্রাণহানি আর এই জনগণের সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতির দায়িত্ব কার? একটা অকারণ মৃত্যুও অগ্রহণযোগ্য। সম্পদের এই বিশাল বিনাশের ক্ষতি অপূরণীয়। এর দায় কেউ স্বীকার করবে না। কিন্তু ইতিহাস ঠিকই সবকিছু ধরে রাখবে। মহাকালের বিচার কঠিন বিচার।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও কথাসাহিত্যিক