ইসরায়েল ও লেবাননের মধ্যে যুদ্ধবিরতি যখন হলো, তখন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর দেশের হতাশাগ্রস্ত জনগণের কাছ থেকে পাহাড়সম চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন।
ইসরায়েল এখন তার সামরিক শক্তির সীমাবদ্ধতাকে স্বীকৃতি দিতে শুরু করেছে। এর কারণ হলো, ইসরায়েলের শীর্ষ কর্মকর্তারা এখন এই ধারণার সঙ্গে আপস করতে শুরু করেছেন যে এই অঞ্চলে ইসরায়েল তার এজেন্ডা নিষ্ঠুর বলপ্রয়োগের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে পারবে না।
কেবল গত অক্টোবর মাসেই গাজা, লেবানন ও তথাকথিত সবুজ অঞ্চলে ৮৮ জন ইসরায়েলি সেনা ও ৬ জন বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। গাজায় গণহত্যা শুরুর পর এটা এক মাসে ইসরায়েলিদের সর্বোচ্চ মৃত্যু।
ইসরায়েল আরব অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাতে সক্ষম হলেও হিজবুল্লাহর সঙ্গে দেশটির যুদ্ধ প্রমাণ করেছে, অ–রাষ্ট্রীয় খেলোয়াড়েরাও দেশটির বড় একটা অংশকে পঙ্গু করে দিতে কিংবা পুরোপুরি অচল করে দিতে সক্ষম।
গোলাগুলির মুখে উত্তর অঞ্চল থেকে ১০ লাখের বেশি বাসিন্দাকে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে ইসরায়েল। একই সঙ্গে দক্ষিণ অঞ্চলের কলোনিগুলোর বেশির ভাগ অংশ খালি করে ফেলতে হয়েছে। হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরও উত্তর অঞ্চলে নিরাপত্তার বোধ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
বিশ্বের নেতৃত্বদায়ী পরাশক্তিগুলোর অকুণ্ঠ সমর্থন থাকার পরও ইসরায়েল এই যুদ্ধবিরতির মধ্য দিয়ে তাদের ‘পুরোপুরি বিজয়ের’ আখ্যানকে সত্যে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কেননা ইসরায়েলের লক্ষ্য ছিল হিজবুল্লাহকে নিরস্ত্রীকরণ করা এবং লেবাননকে তাদের দাবির প্রতি বশ্যতা স্বীকার করিয়ে নেওয়া।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর নীতিনির্ধারকেরা এটা উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে তাঁরা হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সামরিক বিজয় অর্জন করতে পারবেন না। অতীতেও সেটা তাঁরা পারেননি। দৃশ্যপটে কোনো রাজনৈতিক সমাধান দেখা যাচ্ছে না। ফলে আরও অনেক বছর ইসরায়েলকে হিজবুল্লাহর সঙ্গে লড়াই করে যেতে হবে।
কিছু ইসরায়েলি হয়তো একদিন তাঁদের কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত হবেন, অনেকে পুরোপুরি উপেক্ষা করবেন আবার অনেকে নিজেদের কর্মকাণ্ডের ন্যায্যতা দিতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু সামষ্টিক চেতনায় এই ধ্বংসযজ্ঞের পরিণতি তাঁদের বয়ে বেড়াতেই হবে।
এরপরও যুদ্ধবিরতির পেছনে নেতানিয়াহুর যে স্বার্থবুদ্ধি কাজ করেছে, সেটা হলো, তিনি দেশের ভেতরকার অসন্তোষকে প্রশমিত করতে চান। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নেতানিয়াহু ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর যুদ্ধবিরতির এ সিদ্ধান্ত আসে।
এদিকে হামাস জানিয়েছে যে গাজার উত্তরাংশে একজন ইসরায়েলি জিম্মি মারা গেছেন। এ ছাড়া দুবাইয়ে নিখোঁজ একজন ইসরায়েলি রাব্বি (ইহুদি ধর্মযাজক) নিহত হয়েছেন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি গোপন নথি ফাঁস হয়েছে। ‘বিবিলিকস’ বলে পরিচিত এই কেলেঙ্কারিতে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে এবং দেশটির প্রতিরক্ষা নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তদন্তের দাবি উঠেছে।
এমনকি ইসরায়েলের নেতারা গাজার দিকে মনোযোগ আবার নিবদ্ধ করার চিন্তা করলেও গত ১৪ মাসে এটা প্রমাণিত হয়েছে যে হামাসের সঙ্গে চুক্তি করা ছাড়া গাজা থেকে জিম্মিদের মুক্ত করে আনার মতো সামরিক ও গোয়েন্দা সক্ষমতা ইসরায়েলের নেই।
এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, গাজায় গণহত্যা শুরুর পর এই প্রথম তেল আবিবে বিক্ষোভ হয়েছে, শুধু জিম্মিদের মুক্ত করে আনার দাবিতে নয়, যুদ্ধ বন্ধের দাবিতে।
নির্মম বাস্তবতা
লেবাননে যুদ্ধের দুই মাস পেরোতে না পেরোতে যে নির্মম বাস্তবতা প্রকাশ পেয়েছে, তা হলো, ইসরায়েল বৈশ্বিক তো দূরে থাক, আঞ্চলিক পরাশক্তিও নয়। যদিও প্রথম দিকে পেজার ও ওয়াকিটকি নেটওয়ার্কে হামলায় লেবাননে বেসামরিক লোক হতাহত ঘটনায় ইসরায়েলি সমাজে ব্যাপক উচ্ছ্বাস দেখা দিয়েছিল।
গাজা দখল, সেখানকার বাসিন্দাদের অভুক্ত রেখে, নির্বিচারে বোমা হামলা করে এবং অবর্ণনীয় ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরও ইসরায়েল তার যুদ্ধের উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা জিম্মি সংকটের সমাধান করতে পারেনি, হামাসকে ‘নিশ্চিহ্ন’ করতে পারেনি।
গত মঙ্গলবার ইসরায়েলের পার্লামেন্টে হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতির পক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু এখন ইয়েমেন, ইরাক ও সিরিয়ার দিক থেকে নতুন সামরিক হুমকি আসছে।
উপরন্তু নেতানিয়াহু ও গ্যালান্তের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায় দুই ধরনের প্রভাব আছে। প্রথমটি হলো, ইসরায়েলি জেনারেলরাও গ্রেপ্তারি পরোয়ানায় পরার ঝুঁকিতে আছেন। এ কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা, অস্ত্র–বাণিজ্য ও গোয়েন্দা তথ্য আদান–প্রদানে বাধা তৈরি হবে।
দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের জনগণের বড় একটা অংশ এটা উপলব্ধি করতে পারছে যে তাদের দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি ভালো নয়। ইসরায়েলিরা ও তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বয়কটের মুখে পড়ছে।
বিভক্তি গভীর হচ্ছে
এসব পর্বতপ্রমাণ সংকটের মধ্যেও নেতানিয়াহু তাঁর নিজের সামরিক বাহিনীসহ সব ফ্রন্টে যুদ্ধ বেছে নিয়েছেন।
তিনি সব জবাবদিহির প্রশ্ন এড়ানোর চেষ্টা করছেন। নেসেটে আরবেরা যাতে সদস্য হতে না পারেন, তার জন্য বর্ণবাদী আইন চালুর চেষ্টা করছেন। বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে খর্ব করার চেষ্টা করছেন। ইসরায়েলি জাতীয় পরিচয় ইস্যুতে দেশের ভেতরে উত্তেজনা ছড়ানোর চেষ্টা করছেন। রাজনৈতিক বিরোধী পক্ষকে দুর্বল করার চেষ্টা করছেন।
শেষ পর্যন্ত ইসরায়েলের মানুষের আন্তর্জাতিক আইন ও মানুষের জীবনের প্রতি সীমাহীন অবজ্ঞা ও অশ্রদ্ধার মূল্য অবশ্যই দিতে হবে। কিন্তু ইসরায়েলি সমাজে কেবল বিভক্তিই গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে।
গাজায় ৪৪ হাজারের বেশি মানুষ সেখানে মারা গেছেন, যাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। গাজা পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে মিশে যাওয়ার আগে সেটা রক্ষার সুযোগ তাঁরা হারাচ্ছেন।
কিছু ইসরায়েলি হয়তো একদিন তাঁদের কর্মকাণ্ডের জন্য অনুতপ্ত হবেন, অনেকে পুরোপুরি উপেক্ষা করবেন আবার অনেকে নিজেদের কর্মকাণ্ডের ন্যায্যতা দিতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু সামষ্টিক চেতনায় এই ধ্বংসযজ্ঞের পরিণতি তাঁদের বয়ে বেড়াতেই হবে।
আবেদ আবু শেহাদেহ, জাফার রাজনৈতিক আন্দোলনকর্মী
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত