‘এভাবে পুলিশ চলতে পারে না’

অডিটররা রাস্তা আটকে দিয়েছিলেন। তাঁদের সড়ক থেকে সরে যেতে হ্যান্ডমাইকে দফায় দফায় অনুরোধ করার পরও তাঁরা সরছিলেন নাছবি: দীপু মালাকার

কতটা দায় এড়ালে তবে পুলিশ বলা যায়—এই কথাটাকে এখন কিন্তু আর কথার কথা মনে হচ্ছে না। আগে জানতাম, ‘পুলিশ ও লোকাল ট্রেন কদাচ সময়মতো আসে’।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পুলিশ সময়মতো এখন আর ‘কদাচ’ও আসছে না। বহু স্থান পুলিশ-শূন্য। অনেক ব্যস্ত রাজপথেও পুলিশ নেই। ‘আল্লাহর নামে চলিলাম’ পদ্ধতিতে ট্রাফিক ব্যবস্থা চলছে। 

ভ্রাম্যমাণ দোকানে সবজি বিক্রি করা এক লোক সেদিন বলছিলেন, ‘আমার ভ্যানের ব্যাটারিডা লয়্যা কেডায় জানি ভাগচে। অর ভাইগ্য ভালো যে ধরা পড়ে নাই। ধরা পড়লে বাইড়াইয়া মাইর‍্যা ফ্যালতাম। কারণ পুলিশ-মুলিশ নাই; মোকদ্দমা অইত না।’ 

তার মানে জনগণের মনে ঢুকে গেছে, দেশে অনেক জায়গায় এখন কার্যত থানা-পুলিশ নেই। টহল পুলিশ নেই। ছাত্র আন্দোলনের সময় গুলি চালানোর জের ধরে পাবলিক পুলিশকে আগের মতো সমীহ করে না।

তারা পুলিশের কথা আগের মতো শুনতে চায় না। পাবলিক এখন আইনমতো চলার বদলে নিজেদের ‘মনমতো’ চলতে চাচ্ছে। 

সারা দেশের এখনকার ‘উন্মুক্ত গোপনীয়’ বিষয় হলো, পুলিশের চেইন অব কমান্ড কাজ করছে না। পুরো কমান্ড ভেঙে পড়েছে।

ঊর্ধ্বতন অফিসার নিচের দিকে অফিসারদের ডানে যেতে বললে তাঁরা যে ডানেই যাবেন, সে নিশ্চয়তা আর কেউ দিতে পারছে না। 

এত দিন বিষয়টি ‘জনধারণা’ বা ‘পারসেপশন’ হিসেবে ছিল।

কিন্তু গত রোববার ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সারোয়ার জাহানকে যখন মোবাইল ফোনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বলতে শোনা গেল, ‘এভাবে ফোর্স চালানো যায় না, স্যার। কেউ কথা শুনছে না। এভাবে পুলিশ চলতে পারে না’; তখন আর সাধারণ লোকের কিছু বুঝতে বাকি থাকল না। 

প্রথম আলোর খবরে দেখলাম, কাকরাইলে অডিট ভবনের সামনে রাস্তা আটকে বিক্ষোভ করা অডিটরদের সরিয়ে দিতে অধীনস্থ এসআই, কনস্টেবলদের অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন সারোয়ার জাহান।

কিন্তু ক্লাইভ বাহিনীর সামনে সিরাজের বাহিনীর দাঁড়িয়ে থাকার মতো করে তখন সারোয়ারের অধীনস্থ পুলিশ বাহিনী দাঁড়িয়ে ছিল। 

খবর বলছে, অডিটররা রাস্তা আটকে দিয়েছিলেন। তাঁদের সড়ক থেকে সরে যেতে হ্যান্ডমাইকে দফায় দফায় অনুরোধ করার পরও তাঁরা সরছিলেন না।

তখন সারোয়ার তাঁদের পাঁচ মিনিটের মধ্যে সরে যেতে বলেছিলেন। এরপরও না সরায় পুলিশ সদস্যদের তিনি আন্দোলনকারীদের দিকে এগিয়ে যেতে বলেন।

কিন্তু তাঁর সঙ্গে থাকা হাতে গোনা কয়েকজন পুলিশ ছাড়া আর কাউকে এগিয়ে যেতে দেখা যায়নি। 

ডিসি সারোয়ার বারবার তাড়া দেওয়ার পর কয়েকজন কনস্টেবল ও এসআই সরাসরি তাঁকে জানিয়ে দেন, ‘স্যার, আমরা অ্যাকশনে যেতে পারব না।’ ডিসি তাঁদের বলেন, ‘তোমরা কি আমার কথা শুনবা না?’ জবাবে একজন বলেন, ‘আমরা যেতে পারব না, স্যার।’ 

এ সময় অনেক পুলিশ নিজেদের মধ্যে আলাপ করে বলছিলেন, যা-ই হোক, তাঁরা কেউ সামনে যাবেন না। একজন এসআইকে এ সময় কনস্টেবলদের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘স্যার যা বলে বলুক, চুপ করে থাকো।’

বিরক্ত হয়ে ডিসি সারোয়ার ওপরের কোনো এক কর্মকর্তাকে ফোন করে বলেন, ‘স্যার, কেউ কথা শুনছে না। বারবার বলছি, কেউ এগিয়ে যাচ্ছে না।’ 

এটি মোটেও কোনো মামুলি ঘটনা না। এটি অবশ্যই একটি ভয়ংকর ঘটনা। কারণ, পুলিশ একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। চেইন অব কমান্ডই এই বাহিনীর সংহত হওয়ার মূল শক্তি।

কমান্ডের বাইরে গিয়ে কোনো কর্মীর কাজ করার কোনো সুযোগ এখানে নেই।

এই বাহিনীর একজন এসপি পদমর্যাদার উপকমিশনারের মুখের ওপর যখন একজন কনস্টেবল বলে ফেলেন, ‘আপনার কথা শুনতে পারব না’, তখন বুঝতে হবে, বাহিনীর চেইন অব কমান্ড বলে এখন আসলেই কিছু নেই। বাহিনীতে মহা বিশৃঙ্খলা চলছে। 

হাসিনা সরকারের পতনের দিন কয়েক আগে থেকেই পুলিশ ও জনতার সম্পর্ক ক্ষেত্রবিশেষে সাপে-নেউলের সম্পর্কের জায়গায় চলে গিয়েছিল।

ওই সময় পুলিশের গুলিতে কয়েক হাজার লোক হতাহত হয়েছে। আন্দোলনকারীদের হাতে পুলিশেরও বহু সদস্য হতাহত হয়েছেন।

জনগণের সঙ্গে পুলিশের তখন যে ‘শত্রুতার’ সম্পর্ক দাঁড়িয়েছিল, তা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। 

বাস্তবতা হলো, পুলিশ এখনো সাধারণ মানুষের কাছে সহজভাবে হাজির হতে পারছে না। তাদের মনে আশঙ্কা রয়ে গেছে, সাধারণ মানুষ আর তাদের সমীহ করছে না।

এই অনুভূতি যেকোনো আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সামনে মানসিকভাবে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। 

তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘ঢাকায় পুলিশের অধস্তন পর্যায়ের সদস্যদের বড় অংশই শেখ হাসিনা সরকারের সময়ের। তাই তারা কথা শুনতে চায় না।’

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মুহাম্মদ নুরুল হুদাও বলেছেন, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পুলিশের কর্মকর্তাদের অতি ঘনিষ্ঠতাই পুলিশের আজকের দশার জন্য দায়ী। 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শুধু কনস্টেবল, এসআই ও সার্জেন্ট পদে নিয়োগ দেওয়া হয় ১ লাখ ১৯ হাজার ৯১৯ জনকে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে তাদের ব্যবহার করা হয়েছে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে।

কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের প্রতি কোনো পুলিশ সদস্যের ঝুঁকে পড়াটা নতুন কিছু নয়। তবে গোটা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য যদি শৃঙ্খলার বাইরে চলে যান এবং ‘স্যার, আপনার কথা মানতে পারব না’ বলে ফেলেন, তাহলে তা বড় ভয়ের কথা। 

এই অবস্থাকে দ্রুত বদলাতে না পারলে সুশৃঙ্খল পুলিশ বাহিনী বিশৃঙ্খল বাহিনীতে রূপ নিতে পারে।

 ● সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

[email protected]