‘সাধারণ ছাত্ররা’ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনশনরত ছাত্র সামিউলের ওপর শুধু নির্দয় হামলা ও মারধরের ঘটনাই ঘটাননি, তাঁর বিছানাপত্রেও আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। পত্রিকার খবর, তিন দফা দাবিতে ছয় দিন ধরে অনশনে থাকা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সামিউলকে বেধড়ক পেটানো হয়েছে। মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
বাম ও প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের কর্মী-সদস্যরা জানান, সামিউলকে রক্ষা করতে এলে তাঁদেরও পেটানো হয়। এমনকি ছাত্রীদের গায়েও হাত তোলা হয়। পত্রপত্রিকাগুলো এখন খানিকটা সোজাসাপটা লিখছে। লিখেছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের নেতৃস্থানীয়রাই সামিউলের ওপর হামলা করেছেন।
কারা নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের নামধামও পত্রিকার পাতায় উঠে এসেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি জানান, সাধারণ শিক্ষার্থীরা মীর মশাররফ হোসেন হলের অনশনরত ওই শিক্ষার্থীর ওপর হামলা করেছে।
গত কয়েক বছরে এই বিশেষ ধরনের ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ ফ্যাসিবাদী কাজকর্মের শিকার হয়েছেন ছাত্র-শিক্ষক অনেকেই। সামিউলের অপরাধ কী কী, যেগুলো ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের’ সংক্ষুব্ধ করেছে, হামলাকারীও বানিয়ে ছেড়েছে? কারণ কী এটিই যে সামিউল অসংখ্য নিত্য নির্যাতনের শিকার ও প্রকৃত ছাত্রদের পক্ষ নিয়ে ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য অনশনে নেমেছেন। তাঁর মূল দাবিটি কী? আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বের করে দিতে হবে। তাঁর আরও দুটি দাবি আছে। একটি গণরুম বিলুপ্ত করা এবং মিনি গণরুমে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের আসন নিশ্চিত করা।
তিনটি দাবিই সারা দেশের প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের, তাঁদের অভিভাবকদের এবং নাগরিকদের প্রাণের দাবি। তাহলে সাধারণ ছাত্রদের হয়ে সাহস করে নৈতিক দাবি তোলা একজনকে ‘সাধারণ ছাত্র’রাই কেন বেধড়ক পেটাতে যাবেন? তাঁর আন্দোলনটিও অহিংস ও পরোপকারী।
নিজে কষ্ট সয়ে নিলেও কারও ক্ষতি করছে না, দেশের সম্পদ নষ্ট করছে না। তবুও তাঁকে আক্রান্ত হতে হবে কেন? দেশজুড়ে চলছে অসহনীয় দাবদাহ। তারই মধ্যে অনশনে কে নামে? নিশ্চয়ই দেয়ালে পিঠ এমনভাবে ঠেকে গেছে, দাবদাহকেও তুচ্ছ মনে হচ্ছে সামিউলের।
আসা যাক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ভূমিকায়। প্রক্টর অফিসের প্রাণপণ চেষ্টা থাকার কথা দল-মত-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব ছাত্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। অপরাধীদের চিহ্নিত করার। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, প্রত্যক্ষদর্শী, পত্রপত্রিকার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি—সবাই চেনেন-জানেন পিটুনিদাতারা কারা, কী তাঁদের নাম-ধাম-পরিচয়-কীর্তি। তবু প্রক্টর অফিস কাউকে চিহ্নিত করতে পারে না।
পত্রিকাগুলো জানাচ্ছে, ঘটনার এক ঘণ্টা পর রাত সাড়ে ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ঘটনাস্থলে গেলেন। তাঁর সহজ ভাষ্য, যেসব শিক্ষার্থী হামলা করেছেন, তাঁদের শনাক্ত করা যায়নি। তাঁরা ছাত্রলীগ করে কি না, এটাও তিনি জানেন না। কারা হামলা করেছেন, তাঁরা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন। সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠন ছাড়া ভিন্নমতাবলম্বীদের বেলায় অবশ্য বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর অফিসগুলোর দক্ষতা ও যোগ্যতায় কখনোই কোনো ঘাটতি দেখা যায় না। নিরীহ ছাত্রদের এই আশ্রয়ের জায়গাও এখন অনেকটাই বেহাত।
দুই.
৫ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাদা দলের শিক্ষকেরা অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করেছেন। সেই মানববন্ধনে অংশগ্রহণকারীদের ভয়ভীতি দেখানো ও মানসিক চাপে রাখার জন্য ঘেরাও মহড়া ও অবস্থানের ঘটনা ঘটেছে। একধরনের আতঙ্কগ্রস্ত ভীতিকর পরিবেশে সাদা দলের শিক্ষকেরা মানববন্ধনটি করেছেন। এটি ছিল সাদা দলের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি। দাবিগুলোও ছিল সাধারণ, গতানুগতিক এবং নির্দোষ প্রকৃতির। যেমন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন চাওয়া এবং নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ও হামলা-মামলার মাধ্যমে বিরোধী রাজনৈতিক দমনপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
মানববন্ধনের পুরো সময় ভীতি-আতঙ্ক তৈরির উদ্দেশ্যে ১৫ জনের যে দল মহড়া দিয়েছে, তাদের হাতে ছিল ব্যানার-ফেস্টুন। মুখে স্লোগান। মানববন্ধনের মানুষদের উদ্দেশে ‘শেইম শেইম’সহ কটূক্তি-ব্যঙ্গোক্তিরও কমতি ছিল না। মানববন্ধন শেষ হওয়া পর্যন্ত পুরো সময়ই তাঁরা সেখানে অবস্থান করছিলেন। শিক্ষকদের রাজনীতির বিপরীতে শিক্ষকেরা দাঁড়ালে হয়তো চলত। অসুন্দর দেখালেও অস্বাভাবিক মনে হতো না। শিক্ষক-রাজনীতিকদের কর্মসূচিতে ছাত্রদের রাজনীতিকে ব্যবহার নিতান্তই অনৈতিক চর্চা। দুনিয়ার কোথাও এমনটি ঘটে না। সে অর্থে নজিরবিহীন তো অবশ্যই। শিক্ষার্থীরা সমাবেশ ঘিরে রেখেছেন।
পত্রিকাগুলো লিখেছে, এমনকি প্রত্যক্ষদর্শীরা দেখেছেনও মানববন্ধন ঘিরে রাখা সবাই সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের কর্মী। কিন্তু সাংবাদিকেরা তাঁদের পরিচয় জানতে চাইলে জানিয়েছেন, তাঁরা ‘সাধারণ ছাত্র’। অর্থাৎ, আটঘাট বেঁধে পরিকল্পনা করেই তাঁরা মাঠে নেমেছেন। প্রক্টর অফিসের কর্মকর্তারা তাঁদের এই অনধিকার রাজনীতিচর্চায় বাধা দেননি। নিদেনপক্ষে সরে যেতেও বলেননি। ন্যূনতম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে আমলে নিলেও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কথা বলার সুযোগ দিতে হয়।
সরকারপন্থী নীল দলের শিক্ষকদের বিভিন্ন কর্মসূচি হরহামেশাই হয়। সেখানে কখনো ‘সাধারণ ছাত্রদের’ দেখা যায় না কেন? ‘সাধারণ ছাত্র’রা কেনইবা এতই সরকার-অন্তঃপ্রাণ যে সামান্য সরকারবিরোধিতা সহ্য করার সহনশীলতাও তাঁরা দেখাতে পারেন না। দুনিয়াজুড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই সরকারবিরোধিতার মূল প্রাণকেন্দ্র। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ভাষার মর্যাদাসহ বাংলাদেশের অতীতের সব গৌরবাত্মক অর্জনও বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্রদের সরকারবিরোধিতার মাধ্যমেই পাওয়া।
তিন.
‘সাধারণ ছাত্র’ লেবেল ব্যবহারের এই প্রতারণামূলক পদ্ধতিটিই বলে দেয় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্ররাজনীতি সৎ বা নৈতিক, কোনো অবস্থানে আর নেই। বিষয়গুলো ওপেন সিক্রেট—সবাই জানছে কাদের কাজ, তবু ‘সাধারণ ছাত্র’ নামের মিথ্যা পরিচয় দিতে তরুণ-যুবারা গ্লানি বোধ করেন না কেন—এ প্রশ্ন করার সময় হয়েছে।
বড়দের রাজনীতি মিথ্যায় ভরপুর। বিশাল জনসভায় দায়িত্বশীল নেতারা হরদম মিথ্যা কথা বলে চলেন কোনো রকম গ্লানিবোধ না করেই। একই চর্চা ছাত্ররাজনীতি পর্যায়েও সংক্রমিত হবে, সেটিই স্বাভাবিক। রাজনীতির চরিত্রই প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে নির্বিকার মিথ্যা ও ছলচাতুরী চর্চার বড় পাটাতন হিসেবে।
গত বছরের ৩১ মে প্রথম আলোয় সুজয় চৌধুরীর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: ছাত্রলীগ করলে হলে আসন, সাধারণ ছাত্রের ঠাঁই নেই’। ছাত্রদের ৭টি হলের ১ হাজার ৮০টি কক্ষের মধ্যে ১ হাজারটি ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণে। এই ‘সাধারণ ছাত্র’ মানে সেসব ছাত্র, যাঁরা ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত নন।
প্রকৃত ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’রা কখনোই নিপীড়ক হন না। তাঁদের অবস্থান সব সময়ই নিপীড়নবিরোধী। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির কলুষমুক্তি প্রয়োজন। যেসব তরুণ-যুবা বিবেকবর্জিত ও গ্লানিবিবর্জিত অজুহাত তৈরিকে রাজনীতির স্বাভাবিক ও অপরিহার্য অনুষঙ্গ ভেবে চলবেন, তাঁরা নৈতিকভাবে স্খলিত হতেও দ্বিধাগ্রস্ত হবেন কি? অন্যায়-অপরাধে অনুতাপ-অনুশোচনাপীড়িত হবেন কি? উত্তর—না।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ছাত্র অধিকার পরিষদের পঞ্চম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ছিল। পরিষদের কর্মী-সমর্থকেরা টিএসসি পৌঁছামাত্রই তাঁদের ওপর হামলা হয়। ‘কুমিল্লা, কুমিল্লা, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ানসের জয়’ স্লোগানটি ছিল ছুতো। সব পত্রিকাতেই খবর হয়েছে সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনটির সদস্যরাই বিনা উসকানিতে শান্তিপূর্ণ একটি কর্মসূচিতে হামলাটি করেছে। যথারীতি দোষ দেওয়া হলো ‘সাধারণ ছাত্র’দের।
২০২২ সালের ২৬ মে ছাত্রদলের সদস্যরা পূর্বঘোষিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে গেলে বেধড়ক হামলার শিকার হন। পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন, আলোকচিত্র—সবকিছুই নির্দেশ করে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের মারমুখী হয়ে ওঠার দৃশ্যত কোনো কারণ ছিল না। ছাত্রলীগ প্রথমে দাবি করেছিল , ‘সাধারণ ছাত্ররা’ সন্ত্রাসীদের ঠেকিয়ে দিয়েছেন। পরদিন দাবি করে, প্রগতিশীল ছাত্ররা কাজটি করেছেন।
২৮ মে একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীও বললেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের মতো জাতির গৌরবোজ্জ্বল অর্জনের আনন্দকে ধূলিসাৎ করতে গিয়েছিল ষড়যন্ত্রকারীরা। ‘সাধারণ ছাত্ররা’ তাদের প্রতিহত করেছেন। নেতৃত্বের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও ‘সাধারণ ছাত্র’ মোড়কে অগণতান্ত্রিক আচরণকে বৈধতা দিয়ে বসেন বলেই ছাত্রসংগঠনগুলো একই অজুহাত তৈরি করায় ন্যূনতম গ্লানিও বোধ করে না।
প্রকৃত ‘সাধারণ শিক্ষার্থী’রা কখনোই নিপীড়ক হন না। তাঁদের অবস্থান সব সময়ই নিপীড়নবিরোধী। বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির কলুষমুক্তি প্রয়োজন। যেসব তরুণ-যুবা বিবেকবর্জিত ও গ্লানিবিবর্জিত অজুহাত তৈরিকে রাজনীতির স্বাভাবিক ও অপরিহার্য অনুষঙ্গ ভেবে চলবেন, তাঁরা নৈতিকভাবে স্খলিত হতেও দ্বিধাগ্রস্ত হবেন কি? অন্যায়-অপরাধে অনুতাপ-অনুশোচনাপীড়িত হবেন কি? উত্তর—না।
সবচেয়ে বড় কথা, প্রতারণার ধারা ছেড়ে ছাত্ররাজনীতির সততার ধারায় ফেরা প্রয়োজন। ছাত্রসংগঠনগুলোয় অন্তত এই শুদ্ধিটুকু আসুক, যাতে বাংলাদেশের মানুষ আবার আশায় বুক বাঁধতে পারে। এ বিশ্বাস ফিরে পেতে পারে—ছাত্ররাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্য থেকেই ভবিষ্যতের সৎ ও নির্ভরযোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসা সম্ভব।
হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।