গত কয়েক দিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও অনেক মানুষ দেখে ফেলেছে। বৃহস্পতিবার রাতে ভিডিওটা দেখতে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে থাকলাম। সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত কী নির্মম মৃত্যু!
এই ঢাকা শহরে অলিগলিতে রাস্তাঘাটে ফুটপাতে কত ধরনের-রকমের মৃত্যু লুকিয়ে আছে, তা আসলে বলা মুশকিল। একটি ইট পড়েও মুহূর্তের মধ্যে উড়ে যেতে পারে প্রাণপাখিটা। বৃহস্পতিবার দীপু সানার মৃত্যুটা এভাবেই ঘটেছে। চোখের পলকে ঘটে যাওয়া তার মৃত্যু আমরা দেখলাম সেই ভিডিওতে।
দীপান্বিতা বিশ্বাস দীপু (দীপু সানা)। ৩৭ বছর বয়সী এ নারী একজন ব্যাংক কর্মকর্তা। বৃহস্পতিবার ঘরে ফিরতে পারলেই দুই দিনের আরেকটি সাপ্তাহিক ছুটি। কিন্তু তার আগেই দীপু সানার জীবনের ক্যালেন্ডার থমকে গেছে। একটি ইট সেই ক্যালেন্ডারকে আজীবনের তরে চাপা দিয়ে দিয়েছে।
দীপু সানা পড়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। ছিলেন ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। বিসিএসের পর বেশির ভাগ বেকার তরুণেরা যে জায়গাটিতে চাকরির স্বপ্ন দেখেন, সেটি হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। নিয়োগ পরীক্ষার বিশাল যুদ্ধ শেষে দীপু সানা ২০১৭ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নিয়োগ পেয়েছিলেন।
ব্যাংকটিতে তাঁর এক সহকর্মী জাহাঙ্গীর ফিরোজের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি জানালেন, দীপু সানা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সদরঘাট শাখায় কর্মরত ছিলেন। অফিসার পদে তিনি যোগদান করেছিলেন। দুই বছর পর পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পরিচালক হয়েছিলেন।
প্রতিদিনের মতো অফিস শেষে বাসায় ফিরছিলেন দীপু। অফিসের গাড়ি করেই আসা-যাওয়া। অফিসের বাসে করে নামেন শান্তিনগর। এরপর সেখান থেকে হেঁটেই মগবাজারের গাবতলায় বাসায় ফেরেন। ওজন বেড়ে যাওয়ায় প্রতিদিন এতটুকু পথ তিনি হেঁটে আসতেন। বৃহস্পতিবার তেমনি হেঁটে বাসায় ফেরার সময় মৌচাক মার্কেট সংলগ্ন ফখরুদ্দীন পার্টি সেন্টারের সামনে আচমকা একটি ইট এসে পড়ে তাঁর মাথায়।
আমরা ভিডিও ফুটেজে দেখলাম, ব্যস্ত ফুটপাতে আরো অনেকের মতোই হেঁটে যাচ্ছিলেন দীপু। হঠাৎ তার মাথায় ওপর থেকে একটা ইট পড়ে, সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়েন তিনি। আশপাশ থেকে কয়েকজন মানুষ দৌড়ে আসেন তখন। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন না তাঁরা। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে দীপুকে ঘিরে ভিড় জমে যায়। একটা রিকশায় নিথর দীপুকে তুলে দেন তাঁরা।
পরে সংবাদমাধ্যম বলছে, কেউ একজন তাঁকে পাশের একটি হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক দীপুকে মৃত ঘোষণা করেন।
অনেক সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইটটি ছুড়ে এসে পড়ে। তবে পুলিশ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না, ইটটি কোথা থেকে এসে পড়েছে। তাদের ধারণা, পাশের উড়ালসড়ক থেকে সে ইট উড়ে এসেছে। হয়তো কোনও ট্রাক তিরপল দিয়ে ঢাকা ছিল, তার ওপর ইট ছিল, সেটিই বাতাসের ধাক্কায় উড়ে এসে পড়েছে। যেখান থেকেই উড়ে এসে পড়ুক না কেন, সেই ইটের গায়েই লেখা ছিল দীপু সানার মৃত্যু।
দীপুর স্বামী তরুণ কুমার বিশ্বাসের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বললাম। এমন পরিস্থিতিতে একটা মানুষের সঙ্গে কথা বলার মতো কঠিন আর কিছুই হতে পারে না। তবুও এটা–সেটা জিজ্ঞাসা করে তাঁদের সম্পর্কে জানতে চাইলাম।
দীপু ও তরুণ—দুজনের গ্রামের বাড়িই খুলনাতে, আলাদা আলাদা উপজেলায়। তরুণ পড়েছেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর দীপু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুজনের মধ্যে ছিল কয়েক বছরের প্রেমের সম্পর্ক। পরবর্তীতে পারিবারিক সম্মতিতে বিয়ে করেন তাঁরা।
ক্যারিয়ারের দিক দিয়েও দুজনে ছিলেন সফল। তরুণ একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে। তাঁদের ভালোবাসার ঘরে আলো করে আসে একটি সন্তান—ঋষিরাজ। প্রেম, বিয়ে, ক্যারিয়ার—সবকিছু মিলিয়ে দারুণ একটি সংসার। কিন্তু সেখানে আজ নেমে এসেছে অন্ধকার।
তরুণের কণ্ঠে শোক লেগে আছে। যে শোক আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে তাঁকে। একটি ইট খুবই সামান্য হতে পারে, কতইবা তার ওজন, কিন্তু এর আঘাতে যে মৃত্যু, তার ভার বহন করা কি কারও পক্ষে সম্ভব।
যে প্রেমের বাঁধনে জড়িয়েছিলেন দুজন, সেখানে এখন বেদনার বসবাস। প্রিয় মানুষ হারানোর যন্ত্রণা নিয়ে কথা বলে যাচ্ছেন তিনি।
জানালেন, গ্রামেই হয়েছে দীপুর শেষকৃত্য। ছেলের বয়স তিন বছরেরও কম। এখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। মাকে খুঁজলেও তাকে নানাভাবে ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার ঘরে ফেরার সময় দীপুর হাতে একটি প্যাকেট ছিল। সেই প্যাকেটে ছিল মুড়ির মোয়া। তরুণ জানালেন, ছেলে ঋষিরাজ মুড়ির মোয়া খেতে পছন্দ করে। সিদ্ধেশ্বরীর মন্দিরের পাশের একটি দোকান থেকে প্রায় সময়ই সেই মোয়া কেনেন দীপু। সেদিনও কিনেছিলেন।
মায়ের কেনা সেই মোয়া আর খাওয়া হলো না ঋতুরাজের। ‘ছেলের হাতের মুড়ির মোয়ার’ মতোই ছিল যেন দীপুর মৃত্যু।
ঢাকায় ইট পড়ে মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। এই ‘জাদুর শহরে’ ইটের আঘাতে আরও কত মানুষের প্রাণ গেছে, খুঁজেও তার কোনো পরিসংখ্যান পেলাম না। ফুলের টব পড়ে মৃত্যু, লোহার রড পড়ে মৃত্যু, দেয়াল পড়ে মৃত্যু, লোহার গেট পড়ে মৃত্যু—আরও কত ‘বিচিত্র’ সব মৃত্যুর খবর ঘেঁটে পেলাম। তবে এসব অপঘাতে মৃত্যুর মধ্যে ইটের আঘাতে প্রাণহানির ঘটনাই বেশি।
২.
ঢাকায় ইট পড়ে মৃত্যুর ঘটনা নতুন নয়। এই ‘জাদুর শহরে’ ইটের আঘাতে আরও কত মানুষের প্রাণ গেছে, খুঁজেও তার কোনো পরিসংখ্যান পেলাম না। ফুলের টব পড়ে মৃত্যু, লোহার রড পড়ে মৃত্যু, দেয়াল পড়ে মৃত্যু, লোহার গেট পড়ে মৃত্যু, ম্যানহোলে পড়ে মৃত্যু—আরও কত ‘বিচিত্র’ সব মৃত্যুর খবর ঘেঁটে পেলাম। তবে এসব অপঘাতে মৃত্যুর মধ্যে ইটের আঘাতে প্রাণহানির ঘটনাই বেশি।
২০২৩ সালের ৫ জুন পল্লবীতে মাথায় ইট পড়ে মারা যান এক যুবক, ২০২২ সালে ২৯ অক্টোবর মোহাম্মদপুর ঢাকা উদ্যান এলাকায় ইট পড়ে স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়, একই বছরে ৩০ মে মিরপুরে মেট্রোরেল স্টেশন থেকে ইট পড়ে মারা যান এক পথচারী, ২০২১ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি যাত্রাবাড়ীতে ইট পড়ে এক নারী পোশাকশ্রমিকের মৃত্যু হয়, একই বছরের ২৭ আগস্ট ইট পড়ে আরও এক নারী মারা যান একই এলাকায়, ২০১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি মিরপুরে একটি ভবনের ওপর থেকে ইটের টুকরো পড়ে মারা যায় ১৬ দিনের এক শিশু।
এখানে উল্লেখিত একটি ছাড়া সবগুলোই নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়া ইটের কারণে মৃত্যুর ঘটনা।
খুঁজতে গিয়ে ঢাকার বাইরে এমন আরও অনেক মৃত্যুর খবর চোখে পড়ল। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এসব মৃত্যুর জন্য দায়ী কে?
দেশে ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২ প্রচলিত আছে। এ ছাড়া ২০০৬ সালে প্রণয়ন করা হয়েছে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা। এই আইন ও বিধিমালা অনুসারে ভবন নির্মাণে পথচারীদের নিরাপত্তাসহ অন্যান্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
এ বিধিবিধান না মানলে সরকারের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ওই ইমারত ভেঙে ফেলার বা অপসারণের নির্দেশ দিতে পারবে। আবার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে অবৈধ ইমারত ভেঙে ফেলতে বা অপসারণ করতে পারবে। আইন অমান্যকারীকে কোনো রকম পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ কর্তৃপক্ষ গ্রেপ্তার করতে পারবে। (দালান নির্মাণে পথচারীর নিরাপত্তা আছে তো? ১৯ জুলাই ২০১৭, প্রথম আলো)
কিন্তু এত মৃত্যুর পরেও কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন, শুনেছেন? চট্টগ্রাম নগরীতে ভবন ভাঙার সময় দেয়াল পড়ে এক মৃত্যুর ঘটনা থানায় বসে লেনদেনের মাধ্যমে আপসরফা হয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমার আগের একটি লেখা লিখেছিলাম।
অধিকাংশ মানুষ ইমারত নির্মাণের এই আইন-বিধিমালা সম্পর্কে জানেন বলেও আমার মনে হয় না। এমন মৃত্যুকে সবাই কপালের লিখন বলেই ধরে নেন।
তবে ২০১১ সালের একটি ঘটনায় ক্ষতিপূরণ আদায়ের নজির আছে। সে বছর ১৬ জুলাই রাজধানীর পান্থপথ এলাকায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে ইট পড়ে মারা যায় এক কলেজছাত্র।
এ ঘটনার পর স্বপ্রণোদিত হয়ে হাইকোর্ট বিভাগ ডেভেলপার কোম্পানির চেয়ারম্যান, রাজউকের চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে আদালতের হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে আদালতের নির্দেশে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয় নির্মাণপ্রতিষ্ঠানকে।
তরুণ কুমারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, যে ইটের আঘাতে দীপুর মৃত্যু ঘটেছে, সে ইটটি কোথা থেকে উড়ে এসেছে জানতে পেরেছেন কী? তিনি বলেন, পুলিশ যা বলেছে, তা-ই আমরা জানি।
এখন পুলিশও সন্দিহান ইটটি কি আসলে নির্মাণাধীন ভবন থেকে উড়ে এসে পড়েছে? সেটি যদি না-ই ঘটে, তাহলে এ মৃত্যুর জন্য কাকে দায়ী করা যায়? কারো শাস্তি হবে বা কোনো জরিমানা বা কোনো ক্ষতিপূরণ?
দীপু সানার স্বামী বললেন, তিনি একটি মামলা করেছেন। কী ধরনের মামলা জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তর দেন, আমার তখন হুঁশ ছিল না, স্বাক্ষর করতে বলেছে তা–ই করে দিয়েছি। ফলে মামলা সম্পর্কে কিছু জানি না।
তবে সংবাদমাধ্যম বলছে, সেটি একটি হত্যা মামলা। আসামি অজ্ঞাত। পুলিশ তদন্ত করছে। এরপর কি আমরা আসলে আর কিছু জানতে জানব? নাকি এ শহরে এমন মৃত্যুই নিয়তি, সেটিই ধরে নিতে হবে? এটি তো স্রেফ হত্যাকাণ্ড। কিন্তু হত্যার শিকার হয়েও কি এটিই মেনে নিতে হবে যে—নো ওয়ান কিল্ড দীপু সানা!
রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী। ই–মেইল: [email protected]