হামাসের হামলা শুধু ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বিরোধের গতিপথ পরিবর্তন করেনি, বরং পাল্টে দিয়েছে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের হিসাব-নিকাশ। এই অঞ্চলে উত্তেজনা প্রশমনে নেওয়া মার্কিন কৌশল দুর্বল হয়ে গেছে। গ্যাঁড়াকলে পড়েছে আরব সরকার ও ইরান। সম্পৃক্ততার সুযোগ বেড়েছে চীন ও রাশিয়ার।
তিন বছর ধরে বাইডেন প্রশাসন মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কর্মকাণ্ড কমিয়ে চীনের দিকে নজর দিতে চাইছিল। এগোচ্ছিল এশিয়ায় তাদের দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপনের কৌশল নিয়ে। পররাষ্ট্রনীতির অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের উদ্যোগ নিয়েছিল। একই সঙ্গে ইরানে উত্তেজনা কমিয়ে আনতে চেয়েছিল। তাদের প্রত্যাশা ছিল চীনের প্রভাব কমিয়ে এই অঞ্চলে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সঙ্গে ভারতের একটি অর্থনৈতিক করিডর স্থাপিত হবে।
প্রস্তাবিত প্রকল্পের দুটি অংশ ছিল, একটি পূর্ব দিককার করিডর। এর মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে আরব ও উপসাগরীয় অঞ্চলের একটি নিবিড় যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার কথা ছিল। অন্যটি ছিল জর্ডান ও ইসরায়েল হয়ে ইউরোপের সঙ্গে উপসাগরীয় অঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপন। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা জবাব ছিল এই।
হামাসের আচমকা হামলা সব পরিকল্পনা ভেস্তে দেয়। প্রথমে স্থগিত হয় ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের প্রক্রিয়া।
দ্বিতীয়ত, এই হামলার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক স্থাপনার বড় সমাবেশ ঘটিয়েছে। বলা হচ্ছে আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পর এটাই তাদের সবচেয়ে বড় সামরিক আয়োজন। পেন্টাগন একটি রণতরি পাঠিয়েছে পূর্ব ভূমধ্যসাগরে, অন্যটি পাঠিয়েছে উপসাগরীয় অঞ্চলে। এই দুটি রণতরি থেকে হামলা চালাতে সক্ষম এমন ১০০টির বেশি বিমান উড্ডয়ন ও অবতরণ করতে পারে। পাশাপাশি এখান থেকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া সম্ভব। ওয়াশিংটন বলছে, চলমান যুদ্ধে তৃতীয় কোনো পক্ষ যেন অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা।
গাজায় ফিলিস্তিনিদের হত্যায় সমর্থনের কারণে মুসলিম বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দুর্বল হয়েছে। আর শক্তিশালী হয়েছে রাশিয়া ও চীনের অবস্থান। দেশ দুটি গাজায় তাৎক্ষণিক যুদ্ধ বন্ধের কথা বলেছে। মনে হচ্ছে ধ্বংসাত্মক এই যুদ্ধে সমর্থন জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজের পায়ে নিজেই গুলি করছে। মধ্যপ্রাচ্যে চীন ও রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখার বদলে যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করছে।
তৃতীয়ত, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা প্রশমনের যে উদ্যোগ, তা–ও এখন নিবু নিবু। মাত্র এক মাস আগে দুই দেশ বন্দিবিনিময়ে ঐকমত্যে পৌঁছায়। বন্দিমুক্তি সম্ভব করতে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের জব্দকৃত ছয় বিলিয়ন ডলারও ছাড় করে। আশা করা হচ্ছিল এই চুক্তির ফলে সিরিয়া ও ইরাকে মার্কিন সেনাদের ওপর মিলিশিয়াদের হামলার রাশ টেনে ধরতে সহায়তা করবে ইরান।
গেল কয়েক সপ্তাহের পরিস্থিতিতে এটা পরিষ্কার যে উদ্যোগগুলো আর এগোচ্ছে না। ইরানপন্থী সিরিয়া ও ইরাকের সশস্ত্র দলগুলো মার্কিন সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন সেনাসদস্য আহত হন। মার্কিন কর্মকর্তারা আরও দাবি করেছেন যে উত্তর লোহিত সাগরে মার্কিন বাহিনীর দিকে ছোড়া ড্রোন তাঁরা প্রতিহত করেছেন। ইয়েমেনের হুতিরা এই ড্রোন তাঁদের দিকে ছুড়েছিল।
এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকিতে আছে।
হামাসের এই হামলা এবং গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ আঞ্চলিক সরকারগুলোকেও বেকায়দায় ফেলেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র তার আরব মিত্রদের ওপর চাপ দিচ্ছে তারা যেন হামাসের হামলার নিন্দা জানায়। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন তেমন একটি বিবৃতিও দিয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব সরকারগুলোর ওপর একজোট হওয়ার চাপ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে যে জনদাবি উঠেছে, তাতে আরব সরকারগুলোর কোনো কোনোটি ইতিমধ্যে তাদের অবস্থান বদলেছে।
১৭ অক্টোবর আল-আহলি ব্যাপটিস্ট হাসপাতালে হামলার পর সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ একযোগে আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলি হামলার নিন্দা জানায়। এর দিন কয়েক পর ২১ অক্টোবর কায়রোর পিস সামিটে জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ ইসরায়েলি নীতির কঠোর সমালোচনা করে বক্তব্য দেন। উল্লেখ্য, ১৯৯৪ সালে এই জর্ডানই ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করেছিল।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ২৪ অক্টোবর গাজা পরিস্থিতি নিয়ে বিতর্ক হয়। ওই বিতর্কে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র মিসর, জর্ডান, সৌদি আরব ইসরায়েলের কঠোর সমালোচনা করে এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতির পক্ষে মত দেয়। এর এক দিন পর চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত মার্কিন অবস্থানে ভেটো দেয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিক যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব তোলেনি।
আপাতত মার্কিনপন্থী আরব সরকারগুলো জনরোষ ঠেকাতে ইসরায়েলি হামলার বিরুদ্ধে কঠোর ভাষার ব্যবহার করছে। কিন্তু ইসরায়েল যদি গাজার ওপর হামলা অব্যাহত রাখে, তাহলে আর কথার কথায় কাজ হবে না। ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণে যে সম্মতি তারা দিয়েছে, সেখান থেকে দেশগুলোর বেরিয়ে আসতে হবে।
ফিলিস্তিনিদের সুরক্ষায় যথেষ্ট তৎপরতার অভাব থাকলে তা আঞ্চলিক স্থিতিশীলতাও বিনষ্ট করবে। আরব জনগোষ্ঠী এমনিতেই তাদের ব্যর্থ অর্থনৈতিক নীতি নিয়ে ক্ষুব্ধ। এর মধ্যে ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচার হামলা তাদের আরও ক্ষুব্ধ করবে। আবার গাজার ওপর ইসরায়েলি বর্বরতায় যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা আরব সরকারগুলোর গ্রহণযোগ্যতা কমাবে।
ইরানও খুব স্বস্তিতে নেই। তবে তার অস্বস্তির কারণ আলাদা। ইরানের নেতৃত্বে হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার প্রশংসা করে। একই সঙ্গে ওই হামলায় নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করে।
হামাসকে সমর্থন দিলেও ইসরায়েল বা তার মিত্র কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে জড়াতে চায় না তেহরান। তারা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে।
ইসরায়েল বলেছে, গাজায় তাদের যুদ্ধের উদ্দেশ্য ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়া এবং গাজায় নতুন সরকারকে বসানো। এর অর্থ তেহরান এই অঞ্চলে তাদের একটি মিত্রকে হারাবে।
এখন বিকল্প হচ্ছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা অথবা হামাসকে ইসরায়েলের হামলায় দুর্বল বা নির্মূল হতে দেখা অথবা লেবাননভিত্তিক হিজবুল্লাহর আবির্ভাব এবং উত্তর সীমান্ত থেকে ইসরায়েলের ওপর হিজবুল্লাহকে চাপ দিতে দেখা। যা–ই ঘটুক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের ওপর এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্র সতর্কতা দিয়ে রেখেছে যে ইসরায়েলের ওপর হামলা হলে হিজবুল্লাহকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। পুরোদমে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়ে ইসরায়েল হয়তো লেবাননের এই গোষ্ঠীর ওপর হামলা চালাবে। এতে করে লেবাননে আবার অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে। এই অস্থিতিশীলতা ইরানের পছন্দ নয়।
দুই সপ্তাহ ধরে বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যে ওয়াশিংটনের এই রক্তপাতমূলক সংঘাতে জড়ানোয় রাশিয়া ও চীনের লাভ হয়েছে। ‘সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের’ কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এমনিতেই এই অঞ্চলে খারাপ। স্বাভাবিকভাবেই মুসলিমদের মধ্যে রাশিয়া ও চীন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা আছে।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতা, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জন্য অতিরিক্ত রসদের জোগান, মার্কিন কূটনীতিকদের ইসরায়েলের প্রতি বাড়তি মনোযোগের অর্থ হলো ইউক্রেন ও এশিয়ার যে দেশগুলো চীনা প্রভাব থেকে উঠে দাঁড়াতে চাইছে, তাদের কাছ থেকে মার্কিনিদের দূরে সরে আসা।
উপরন্তু, গাজায় ফিলিস্তিনিদের হত্যায় সমর্থনের কারণে মুসলিম বিশ্বের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান দুর্বল হয়েছে। আর শক্তিশালী হয়েছে রাশিয়া ও চীনের অবস্থান। দেশ দুটি গাজায় তাৎক্ষণিক যুদ্ধ বন্ধের কথা বলেছে। মনে হচ্ছে ধ্বংসাত্মক এই যুদ্ধে সমর্থন জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজের পায়ে নিজেই গুলি করছে। মধ্যপ্রাচ্যে চীন ও রাশিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখার বদলে যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে তাদের অবস্থানকে সুদৃঢ় করছে।
প্রকৃতপক্ষে, ৭ অক্টোবর হামাসের হামলাকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের হিসাব-নিকাশ বদলে গেছে। মধ্যপ্রাচ্য তাদের নীতিতে কী ধরনের পরিবর্তন আনবে, তা নির্ভর করছে ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা এবং সদিচ্ছার ওপর। গাজায় যুদ্ধ বন্ধে, অবরোধ তুলে নিয়ে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে আলোচনায় ইসরায়েল সরকার যত দিন পর্যন্ত না বসছে, তত দিন পর্যন্ত এই অঞ্চলের আগুন নিভবে না।
আশঙ্কা আছে, এই বিরোধ হয়তো লেবানন, সিরিয়া, ইয়েমেন এবং ইরাকে পৌঁছাবে। আরব বিশ্বে গণ-অভ্যুত্থান ঘটবে। এতে করে শুধু এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষতিতে পড়বে তা-ই নয়; রাশিয়া ও চীনের সম্পৃক্ততা বাড়বে।
মারওয়ান কাবালান আরব সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজের পরিচালক। আল–জাজিরায় প্রকাশিত। ঈষৎ সংক্ষেপিত অনুবাদ