এটা এখন স্পষ্ট, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হতে যাচ্ছেন গান্ধী পরিবারের বাইরের কেউ। ভারতীয় লোকসভায় দলটির যা শক্তি, তাতে এ খবর যতটা মনোযোগ পাওয়ার কথা, পাচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি। একদিকে রাহুল গান্ধীর চলমান পদযাত্রা, অন্যদিকে দলের সভাপতি বাছাইয়ে গণতন্ত্রচর্চার দৃঢ় চেষ্টা কংগ্রেসকে হঠাৎ বাড়তি ভারতীয় মনোযোগে নিয়ে এসেছে।
সাংগঠনিক সংস্কারের দ্বার খুলে দিল কংগ্রেস?
মনোনয়নপত্র জমাদানের সময় শেষ হওয়ায় এখন পরিষ্কার, সভাপতি পদে লড়াই হতে চলেছে মূলত দুজনের মধ্যে। বিভিন্ন সময় রাজস্থানের অশোক গেহলট, মধ্যপ্রদেশের দিগ্বিজয়ী সিং প্রমুখের নাম এলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার ময়দানে আছেন শশী থারুর এবং মল্লিকার্জুন খাড়গে।
১৭ অক্টোবর ভোট শেষ হওয়ার ৪৮ ঘণ্টা পরই বোঝা যাবে, এই দুজনের মধ্যে কে এখন থেকে তেরো দশক পুরোনো দলটির সাংগঠনিক নেতৃত্ব দেবেন। খাড়গে কর্ণাটকের লোক। বর্তমানে রাজ্যসভার সদস্য। একসময় লোকসভায়ও ছিলেন। কর্ণাটকের বিধানসভায় ৯ দফা জিতেছেন।
কংগ্রেসে আছেন ৫৩ বছর হলো। অন্যদিকে, শশী থারুর কংগ্রেসের হয়ে প্রথম নির্বাচন করেন ২০০৯ সালে। কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দেড় দশকের বেশি নয়। তারুণ্যদীপ্ত আধুনিক মনোভাবের জন্য তিনি দ্রুত দলটির একজন আলোচিত নেতা হয়ে উঠতে পেরেছেন।
২০২০ সালে কংগ্রেসের ভেতর যে ২৩ জন নেতা দলকে অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে সাংগঠনিকভাবে গণতন্ত্রচর্চার ওপর গুরুত্ব দিতে থাকেন, তাঁদের একজন শশী। ‘জি-২৩’ নামে পরিচিত ওই গোষ্ঠীর নেতৃত্বে ছিলেন গোলাম নবী আজাদ, কপিল সিবালসহ বিভিন্ন রাজ্যের কংগ্রেসপন্থী সাবেক পাঁচ মুখ্যমন্ত্রী। তাঁরা দলে সাংগঠনিক সংস্কারের জন্য সোনিয়া গান্ধীকে চিঠি লিখেও প্রচারমাধ্যমে বিশেষ সাড়া ফেলেন। ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে জম্মুতে এই উপদল একটা সভাও করে।
অনেকেই তখন ‘জি-২৩’-কে গান্ধী পরিবারের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের ভেতরকার বিদ্রোহ হিসেবে দেখছিল। শশী থারুর সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বী অনেকটা জি-২৩-এর সেই বিদ্রোহের রেশ। শশী থারুর আসন্ন দলীয় নির্বাচনে জিতবেন কি না, সেটা জি-২৩-এর পরবর্তী ভাগ্যও নির্ধারণ করবে। এই গোষ্ঠীভুক্ত গোলাম নবী আজাদ এবং কপিল সিবাল ইতিমধ্যে দল ছেড়ে চলেও গেছেন।
খাড়গে ও শশীর যোগ্যতার তুলনা খোঁজা হচ্ছে যেভাবে
খাড়গের (৮০) তুলনায় শশী থারুর বয়সে ১২ বছর ছোট। বয়সের এই ফারাকের বাইরে উভয়ের আরেক পার্থক্য খাড়গে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী এবং দলিত। শশী ধর্ম পালনে সক্রিয় হিন্দু এবং উচ্চবর্ণ নাইয়ার সম্প্রদায়ভুক্ত। খাড়গে নির্বাচিত হলে কংগ্রেসের ইতিহাসে একজন দলিত-বৌদ্ধের সভাপতি হিসেবে অভিষেক অনন্য ঘটনা হবে। সে কারণে কেউ কেউ তাঁকে জগজ্জীবন রামের সঙ্গে তুলনা করছেন।
দলিত সমাজ থেকে যিনি কংগ্রেসের সর্বোচ্চ পদে উঠতে পেরেছিলেন আপন যোগ্যতায়। বৌদ্ধ খাড়গের প্রতি গান্ধী পরিবারের নীরব সমর্থন কাজ করছে বলেও গুজব আছে। কেউ কেউ তাঁকে ‘দপ্তর মনোনীত প্রার্থী’ হিসেবে উল্লেখ করছেন! এটা সত্য হলে অবশ্যই তাঁর বেশি ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার কংগ্রেসের মাঝে এমন মনোভাব থাকাও বিচিত্র নয়, হিন্দুত্ববাদী বিজেপির মোকাবিলায় একজন বৌদ্ধের চেয়ে একজন হিন্দুই কৌশলগতভাবে সঠিক নেতা হতে পারেন। শশী ও খাড়গে উভয়ে দক্ষিণ ভারতের।
তার মানে কংগ্রেস এবার দক্ষিণ ভারতের একজন পরিচালকের হাতে যাচ্ছে। অথচ তারা বিশেষভাবে দুর্বল উত্তর ভারতে।
কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে নবীন হওয়া ছাড়া শশী যোগ্যতার অন্যান্য বিবেচনায় বেশ এগিয়ে। জাতিসংঘে উচ্চ পদে কাজ করেছেন দীর্ঘ সময়। শেষ দিকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল হতেও লড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতায় সে লড়াইয়ে জিততে পারেননি।
এরপর ২০০৯ থেকে তিনি কেরালা থেকে লোকসভায় এমপি হিসেবে আছেন। ভারতের খ্যাতনামা লেখকদেরও একজন তিনি। দেশটির প্রথম সারির প্রতিটি ইংরেজি কাগজে নিয়মিত লেখেন তিনি। ২৩টি বহুল পঠিত গ্রন্থের লেখক তিনি। লেখক হিসেবে বাংলাদেশেও তাঁর অনেক গুণমুগ্ধ আছে।
দলে তিনি তারুণ্যের প্রতীক। দেশের মধ্যবিত্ত সমাজের কাছে তিনি বিশেষ পছন্দের বলেও মনে করা হয়। কিন্তু গান্ধী পরিবারের সঙ্গে সংগঠন পরিচালনার প্রশ্নে তাঁর ভিন্নমত ও দূরত্ব আছে। এটা অবশ্যই তাঁর বড় ‘দুর্বলতা’। সাংগঠনিকভাবেও তাঁর অভিজ্ঞতা কম। যুক্তি-তর্কে দক্ষ হলেও হিন্দিতে অস্বাচ্ছন্দ্যও হয়তো তাঁর জন্য কিছুটা বিব্রতকর।
সভাপতি নির্বাচন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে শক্তি জোগাবে
বিজেপিকে থামানোর প্রশ্নে শশী থারুর বা খাড়গের মধ্যে কেউ নরমপন্থী নন। কারণ, বিজেপির সামনে কংগ্রেসের মতো তাঁদেরও রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে আছে। তবে শশী মনে করছেন, বিজেপিকে রুখতে পরিবারতন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের পুনর্জাগরণ দরকার।
তবে শশী সভাপতি হলে ভবিষ্যতে দল পরিচালনায় সোনিয়া, প্রিয়াঙ্কা এবং রাহুলের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মতদ্বৈধের শঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এতে দলে গান্ধী পরিবার এবং সভাপতিকেন্দ্রিক সাংগঠনিক দুটি ভরকেন্দ্র তৈরি হওয়ার ঝুঁকি আছে। আবার খাড়গে প্রেসিডেন্ট হলে এমন ইঙ্গিতও মিলবে Ñগান্ধী পরিবারের প্রতি অধিক অনুগত একজনই নির্বাচিত হলেন। সভাপতি হিসেবে তিনি গান্ধী পরিবারের ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে যেতে পারবেন না বলেই মনে করা হয়।
যেমনটি ঘটেছিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহন সিংয়ের ক্ষেত্রে ২০০৪ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত। ব্যক্তিগত ইমেজ ভালো হওয়া সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি সিদ্ধান্তের জন্য নয়াদিল্লিতে ১০ নম্বর জনপথের (সোনিয়া গান্ধীর বাসভবন) মুখাপেক্ষী থাকতেন বলে সমালোচনা ছিল।
কংগ্রেসকর্মীদের বাইরে বিজেপিও এই নির্বাচনের দিকে বিশেষ নজর রাখছে। তারা বরাবরই কংগ্রেসের পরিবারতন্ত্রের তীব্র সমালোচক। ফলে কংগ্রেসে দলীয় গণতন্ত্রের চলতি চর্চা তাদের জন্য একটা হাতিয়ার খোয়ানোর মতো। গান্ধী পরিবারের বাইরের যেকোনো একজনকে সভাপতি হিসেবে পাওয়া ২০২৪-এর জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেসের জন্য এটা ইতিবাচক উপাদান হিসেবে থাকবে। পুরোনো নেতৃত্ব এবং পুরোনো আদলের কংগ্রেসের পক্ষে বিজেপিকে পরাস্ত করা দুরূহ—এটা ইতিমধ্যে ভারতে স্বীকৃত।
বিশেষ করে গান্ধীদের নিজস্ব নির্বাচনী জায়গা উত্তর প্রদেশে দলটির নিঃস্বতা চূড়ান্ত এক বার্তা দিচ্ছে। এ রকম অবস্থায় গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অ-গান্ধী সভাপতির অধীনে ভবিষ্যতে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বিতার জোর কিছুটা হলেও বাড়বে। তবে বিজেপিও বসে নেই।
তারা খাড়গে ও শশী উভয়কে হিন্দুত্ববিরোধী রাজনীতিবিদ হিসেবে বক্তৃতা বিবৃতি দিচ্ছে। তবে বিজেপি খুশি হবে খাড়গে প্রেসিডেন্ট হলে। পুরোনো ধাঁচের প্রতিপক্ষই রাজনীতিতে তাদের চলতি শক্তিশালী স্থিতাবস্থা ধরে রাখতে সক্ষম। ২০১৪ থেকে তারা এ রকম এক কংগ্রেসকে নিয়ে সুখেই আছে। তবে ভারতীয় রাজনীতির এ রকম ‘স্থিতাবস্থা’ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদের জন্য সুখকর না-ও হতে পারে। বরং সেখানে জাতিবাদবিরোধী ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির উত্থান প্রতিবেশী অন্যদের জন্য অধিক স্বস্তিকর।
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক