বাংলাদেশের জ্বালানি প্রেক্ষাপটে যে চ্যালেঞ্জটি কয়েক বছরের মধ্যে হঠাৎ করে আবির্ভাব হতে পারে, তা অতীতের যেকোনো সংকটকে ম্লান করে দেওয়ার ইঙ্গিত বহন করে। আগে থেকেই নিজস্ব গ্যাসসম্পদের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতা বেড়ে উঠেছে। বর্তমানে মোট ব্যবহৃত বাণিজ্যিক জ্বালানির ৫০ শতাংশ হলো দেশীয় গ্যাসনির্ভর। কয়েক বছরের মধ্যে দেশে উৎপাদিত গ্যাস সরবরাহে ব্যাপক ধস নামার যে পূর্বাভাস পাওয়া যায়, তা এই সংকট সৃষ্টি করবে বলে মনে করা হয়।
বাংলাদেশে বর্তমানে গ্যাস উৎপাদনকারী গ্যাসক্ষেত্রের সংখ্যা ২০। যেগুলোর অধিকাংশেরই উৎপাদন হার দৈনিক ১০০ ইউনিটের (এমএমসিএফটি) কম। কেবল চারটি গ্যাসক্ষেত্র (বিবিয়ানা, তিতাস, জালালাবাদ ও হবিগঞ্জ) দেশের গ্যাস সরবরাহের মধ্যমণি হিসেবে বিবেচিত। এই চার গ্যাসক্ষেত্র থেকে সম্মিলিতভাবে দেশে মোট দৈনিক উৎপাদিত গ্যাসের ৮৪ শতাংশ পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে দুটি গ্যাসক্ষেত্র বিবিয়ানা (প্রতিদিন উৎপাদন ১ হাজার ১০০ ইউনিট গ্যাস) এবং জালালাবাদ (প্রতিদিন উৎপাদন ১৭৬ ইউনিট গ্যাস) যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন অয়েল কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত। এদিকে দেশীয় কোম্পানি দ্বারা পরিচালিত তিতাস (প্রতিদিন উৎপাদন ৪০০ ইউনিট) এবং হবিগঞ্জ (দৈনিক উৎপাদন ১৩০ ইউনিট) ৫০ বছর ধরে বাংলাদেশের গ্যাস সরবরাহে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে।
এখন দেখা যাক এ চারটি গ্যাসক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ বা আরও সুনির্দিষ্টভাবে নিকট ভবিষ্যৎ কী রকম হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিতাস এবং বিবিয়ানা যথাক্রমে দেশের বৃহত্তম ও দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্র। সাম্প্রতিক সরকারি সূত্র অনুযায়ী, বিবিয়ানায় প্রাথমিক মজুত ৫ হাজার ৭৫৫ বিসিএফ থেকে কমে বর্তমানে অবশিষ্ট মজুত রয়েছে মাত্র ২৭০ বিসিএফ (হাইড্রোকার্বন ইউনিট মাসিক প্রতিবেদন মার্চ ২০২৩)। অর্থাৎ বিবিয়ানার মোট গ্যাস মজুতের ৯৫ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন করা হয়ে গেছে। একই সূত্রমতে, জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্র থেকে প্রায় শতভাগ গ্যাস উত্তোলিত হয়েছে। হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রেও মোট গ্যাস মজুতের ৯৪ শতাংশ গ্যাস উত্তোলিত হয়েছে। আর পেট্রোবাংলার নিজস্ব সূত্র অনুযায়ী, তিতাসের মোট মজুত ৬ হাজার ৩৬৭ বিসিএফের ৮০ শতাংশ উত্তোলিত হয়েছে। (পেট্রোবাংলা বার্ষিক রিপোর্ট ২০২১)
এটি প্রতীয়মান যে কয়েক বছরের মধ্যে দেশীয় গ্যাসের সরবরাহ ব্যাপকভাবে হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কার বিপরীতে বড় ধরনের গ্যাসের মজুত বাড়ানো বা অবশিষ্ট মজুত থেকে বড় ধরনের উৎপাদন বাড়ানোর বৃহৎ কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। পেট্রোবাংলা সম্প্রতি বাপেক্সের মাধ্যমে কিছু নতুন অনুসন্ধান কূপ, উন্নয়ন কূপ ও ওয়ার্ক ওভার কূপ খননের যে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথে রয়েছে, তা ওপরের সংকট মোকাবিলায় যথেষ্ট নয়। প্রশ্ন হলো, গ্যাস উৎপাদন বড় আকারে কমে যাওয়ার কারণে দেশে জ্বালানি সরবরাহে যে বৃহৎ সংকট সৃষ্টি হবে, তা মেটানোর জন্য বিকল্প ব্যবস্থা কি রয়েছে? দেশের নীতিনির্ধারণী মহলে এটির সমাধান খুঁজতে কতটা উদ্বেগের সৃষ্টি করে?
সবের বাইরেও এলএনজি আমদানি ব্যবস্থাপনা থাকলে নিজস্ব গ্যাস সরবরাহ কম হওয়া সাপেক্ষে তা সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারে। এলএনজি আমদানি একটি ব্যয়বহুল ব্যবস্থাপনা এবং দেশের নিজস্ব গ্যাস জোগান বজায় রাখা সাপেক্ষে তা পরিহার বা সীমিত করাই বাঞ্ছনীয়। ব্যাপকভাবে আমদানি করা এলএনজি-নির্ভরতা যে আর্থিক চাপ সৃষ্টি করবে, তা সরকার ও জনগণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সমাধানের সম্ভাব্য পথ নিয়ে আলোচনার আগে বাংলাদেশে উপরিউক্ত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোকপাত করা যৌক্তিক বটে। অতীতে কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ নিজস্ব গ্যাসসম্পদের ওপর ভর করে এগিয়ে যেতে পেরেছে। এমনকি ২০১০ সালেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা ছিল ৯০ শতাংশ। গ্যাসের উৎপাদন হার ২০১৬ সাল পর্যন্ত ক্রমে বেড়েই চলেছিল। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে দেশে গ্যাস উৎপাদন কমে যেতে থাকে, যা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। গ্যাস উৎপাদনের হার ধীরগতিতে কমতে থাকলেও তার প্রভাব হয় ব্যাপকতর। কারণ, ইতিমধ্যে দেশের শিল্প, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য খাতে গ্যাসের ব্যবহার অনেক বৃদ্ধি পায়। এটি দৃশ্যমান হয় যখন সরকার বিদ্যুৎ, শিল্প ও আবাসিক খাতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ বা সীমিত করে। গ্যাস-সংকট লাঘবের জন্য বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে বিদেশ থেকে উচ্চ মূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু করে। কিন্তু এলএনজির উচ্চ মূল্য পরিশোধে সরকারের আর্থিক চাপ পরিশেষে জনগণের কাঁধে এসে পড়ে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির মাধ্যমে।
প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের মতো বদ্বীপ গঠিত গ্যাস সম্ভাবনাময় এলাকায় এ রকম গ্যাস-সংকট হলো কেন? এর কারণ, অতীতে বছরের পর বছর গ্যাসের মজুত কমে যাওয়ার বিপরীতে কমে যাওয়া গ্যাসটুকু পূরণ করার জন্য যথেষ্ট অনুসন্ধানকাজ করা হয়নি। বাংলাদেশের মূল ভূখণ্ডের কেবল পূর্বাংশে এলাকাবিশেষে অনুসন্ধান জোরালো দেখা গেলেও দেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর অংশে গ্যাসের অনুসন্ধান ছিল সামান্য। এমনকি পূর্বাংশের পার্বত্য চট্টগ্রামও জোরালো অনুসন্ধানের আওতায় আসেনি। সর্বোপরি দেশের সম্ভাবনাময় সমুদ্রবক্ষও জোরালো গ্যাস অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়নি; যদিও পার্শ্ববর্তী মিয়ানমার ও ভারত একই সাগরে তাদের অংশে জোরালো অনুসন্ধান করে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছে।
এ অবস্থায় দেশের আসন্ন জ্বালানিসংকট কাটিয়ে ওঠা বা তা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হলে যে জরুরিভিত্তিক কার্যক্রম হাতে নেওয়া যায়, তার পর্যালোচনা নীতিনির্ধারণী মহলে বিবেচিত হওয়া প্রয়োজন।
১. দেশে দুটি বৃহৎ গ্যাসক্ষেত্র কৈলাসটিলা ও রশিদপুর—যেগুলোর প্রতিটির প্রাথমিক মজুত ২ টিসিএফের বেশি এবং প্রতিটির অবশিষ্ট মজুতও ২ টিসিএফের বেশি, অথচ সে তুলনায় বর্তমান উৎপাদনের হার খুব কম, অতিশিগগির তাদের উৎপাদন হারে বিরাট বৃদ্ধি আনা বাঞ্ছনীয়। উল্লেখ্য, এ দুটি গ্যাসক্ষেত্রের কাছাকাছি অবস্থিত বিবিয়ানায় উৎপাদনের হার দৈনিক ১ হাজার ১০০ ইউনিট, জালালাবাদে দৈনিক ১৭০ ইউনিট, তিতাসে ৩৯০ ইউনিট; অথচ প্রায় একই আকারের হয়েও কৈলাসটিলা গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন দৈনিক মাত্র ৩০ ইউনিট ও রশিদপুরে দৈনিক ৪৫ ইউনিট। এই গ্যাসক্ষেত্রে যথেষ্টসংখ্যক নতুন উন্নয়ন কূপ খনন ও পুরোনো কূপে ওয়ার্কওভার কাজ করে উচ্চহারে উৎপাদন বৃদ্ধি সম্পন্ন করা সম্ভব। অপেক্ষাকৃত স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এর ফলাফল পাওয়া যেতে পারে।
২. ২০১১ সালে পেট্রোবাংলা কর্তৃক বিদেশি পরামর্শক মেসার্স স্লামবার্জার কোম্পানিকে দেশীয় গ্যাসকূপের উৎপাদন হার বৃদ্ধিকরণের উপায় নির্ধারণের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। পরামর্শক কোম্পানি তার পরীক্ষা শেষে ৭টি গ্যাসক্ষেত্রের ৪৯টি কূপ শনাক্ত করে এবং এই সুপারিশ করে যে ওই কূপগুলোর কিছুটা মেরামত, কিছুটা সংস্কার ও কিছু নতুন যন্ত্রাংশ সংযোজনের মাধ্যমে প্রতিটি গ্যাসক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি সম্ভব। ওই সুপারিশ আজও কাজে লাগানো হয়নি। সুতরাং অনতিবিলম্বে সুপারিশগুলোকে পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমেই এর ফলাফল পাওয়া সম্ভব।
৩. অল্প অনুসন্ধানকৃত বাংলাদেশে প্রতিবছর অনুসন্ধান কূপের সংখ্যা অনেক বাড়াতে হবে। দেশের মূল ভূখণ্ডে এখনো দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় জোরালো অনুসন্ধান হয়নি। অতিসম্ভাবনাময় সমুদ্রবক্ষে কেবলই অল্প অনুসন্ধানের আওতায় এসেছে; যদিও তা কেবল অগভীর সমুদ্রে। গভীর সমুদ্রে এখনো একটি কূপও খনন করা হয়নি। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অধীনে এটি চলমান থাকা সামগ্রিকভাবে গ্যাস-সংকট সমাধানের মোক্ষম উপায়।
৪. দেশে আইনি বা কারিগরি কারণে আটকে পড়া গ্যাস, (যেমন ছাতক, ফেনী বা অন্যান্য) ত্বরিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে উৎপাদনে নিয়ে আসা প্রয়োজন। এ ছাড়া বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করে বাংলাদেশে প্রাপ্ত অ-সনাতনী গ্যাসস্তরগুলোকে (যেমন টাইট গ্যাস স্যান্ড, থিন বেড রিজার্ভার ইত্যাদি) উৎপাদনে নিয়ে আসা উচিত।
৫. ওপরের চারটি পন্থা টেকসই ও দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এগুলো আমদানিনির্ভরতা কমাবে এবং দেশে নিজস্ব কারিগরি ও ব্যবস্থাপনা সক্ষমতাকে বাড়াবে। তবে এসবের বাইরেও এলএনজি আমদানি ব্যবস্থাপনা থাকলে নিজস্ব গ্যাস সরবরাহ কম হওয়া সাপেক্ষে তা সম্পূরক ভূমিকা পালন করতে পারে। এলএনজি আমদানি একটি ব্যয়বহুল ব্যবস্থাপনা এবং দেশের নিজস্ব গ্যাস জোগান বজায় রাখা সাপেক্ষে তা পরিহার বা সীমিত করাই বাঞ্ছনীয়। ব্যাপকভাবে আমদানি করা এলএনজি-নির্ভরতা যে আর্থিক চাপ সৃষ্টি করবে, তা সরকার ও জনগণের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ড. বদরূল ইমাম অধ্যাপক, ভূতত্ত্ব বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়