ইসলাম সাম্য, শান্তি ও মানবতার ধর্ম। ইসলাম সব মানুষকে ব্যক্তিস্বাধীনতা, পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক শৃঙ্খলা এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা লাভের অধিকার দিয়েছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব, মানবতার মুক্তির দূত, সর্বশেষ নবী ও রাসুল হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর প্রতি মহাগ্রন্থ আল কোরআন নাজিল হয়েছে রমজান মাসে। আল কোরআন মানবতার মুক্তির সনদ।
রমজান মাসেই মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) মানবতার মুক্তি ও স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সে স্বাধীনতা আত্মার মুক্তির স্বাধীনতা, মানুষের গোলামি বা দাসত্ব থেকে মুক্তির স্বাধীনতা। জালিম শাহি ও জুলুমের জিঞ্জির থেকে মুক্তির স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা তাগুতি শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তির। সকল শয়তানি শক্তির বাঁধন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে এক আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য করার স্বাধীনতা।
‘রহমাতুল লিল আলামিন’ বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে বলেন, ‘হজের বা আরাফাতের দিবস যেমন সম্মানিত, মক্কা নগরী যেমন পবিত্র, কাবাঘর যেমন মর্যাদাপূর্ণ; সব মানুষের জীবন, সম্পদ–সম্মান তেমনি সম্মানিত ও সুরক্ষিত।’ (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া) ইসলাম ব্যক্তিস্বাধীনতার পাশাপাশি মানবাধিকার সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। ব্যক্তিস্বাধীনতার সীমানা অন্যের অধিকারের প্রাচীর দ্বারা সীমাবদ্ধ।
ইসলামি দর্শনে রমজান মাস যেমন স্বাধীনতার মাস, তেমনি বিজয়েরও মাস। ইসলামের প্রথম জয় বদর বিজয় হয়েছিল দ্বিতীয় হিজরির রমজান মাসের ১৭ তারিখ। অষ্টম হিজরিতে ১৯ রমজান ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ জয় মক্কা বিজয় হয়েছিল।
শুধু জাগতিক স্বাধীনতা ও বিজয় নয়, বরং আত্মিক মুক্তি ও বিজয় সম্ভব এই রমজান মাসেই। যার জন্য প্রয়োজন যথাযথ উপায়ে সিয়াম সাধনা। তাকওয়া, সংযম ও আত্ম–নিয়ন্ত্রণ স্বাধীনতা ও বিজয়ের পূর্বশর্ত।
কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য—এ ষড়রিপুর প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারলেই প্রকৃত মুক্তি বা আত্মার স্বাধীনতা নিশ্চিত হয়। আত্মা বা নফস মোহমুক্ত ও স্বাধীন হলেই প্রকৃত অর্থে দুনিয়ার বিজয় বা সফলতা এবং পরকালের মুক্তি বা জীবনের সার্থকতা লাভ হয়।
কোরআন নাজিলের মাস রমজান। মহাগ্রন্থ কোরআনুল কারিমে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা বর্ণনা করেন, ‘রমজান মাস, এ মাসে মানুষের দিশারি, সৎ পথের স্পষ্ট নিদর্শন ও সত্যাসত্যের পার্থক্য নিরূপণকারী হিসেবে কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যারা এই মাস পাবে, তারা যেন এই মাসে সাওম পালন করে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৫) সংযম আত্মনিয়ন্ত্রণ তথা তাকওয়ার মাস রমজান।
মনোজগতে মুক্তি ও আত্ম–নিয়ন্ত্রণ, ধৈর্য, সংযম এবং নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য ও আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসাই মানুষকে সব ক্ষেত্রে সফলতা এনে দেয়। কোরআনুল কারিমে এ বিষয় বোঝাতে স্বৈরাচারী জালুতের বিপুল সৈন্যদের সঙ্গে হজরত তলুতের স্বল্পসংখ্যক মুজাহিদ বাহিনীর সফলতা ও বিজয়ের কাহিনি উল্লেখ হয়েছে।
‘অতঃপর তলুত যখন সেনাবাহিনীসহ অভিযানে বের হলো, সে তখন বলল, ‘আল্লাহ একটি নদী দ্বারা তোমাদের পরীক্ষা করবেন। যে কেউ উহা হতে পান করবে, সে আমার দলভুক্ত নয়, আর যে কেউ উহার স্বাদ গ্রহণ করবে না, সে আমার দলভুক্ত; এ ছাড়া যে কেউ তার হাতে এক অঞ্জলি পানি গ্রহণ করবে সেও (আমার দলভুক্ত থাকবে)।’
‘অতঃপর অল্পসংখ্যক ব্যতীত তারা উহা হতে পান করল। সে (তলুত) এবং তার সঙ্গী ইমানদারগণ যখন উহা অতিক্রম করল, তখন তারা বলল, জালুত ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মতো শক্তি আজ আমাদের নেই। কিন্তু যাদের দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, আল্লাহর সঙ্গে তাদের সাক্ষাৎ ঘটবে, তারা বলল, আল্লাহর হুকুমে কত ক্ষুদ্র দল কত বৃহৎ দলকে পরাভূত করেছে। আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন। তারা যখন যুদ্ধার্থে জালুত ও তার সেনাবাহিনীর সম্মুখীন হলো, তখন তারা বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের ধৈর্য দান করুন, আমাদের দৃঢ়পদ ও অবিচল রাখুন এবং কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদের সাহায্য করুন।’
‘সুতরাং তারা আল্লাহর হুকুমে উহাদের পরাভূত করল, দাউদ (আ.) জালুতকে সংহার করল, আল্লাহ তাকে রাজত্ব ও হিকমত দান করলেন এবং যা তিনি ইচ্ছা করলেন, তা তাকে শিক্ষা দিলেন। আল্লাহ যদি মানবজাতির এক দলকে অন্য দল দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তবে পৃথিবী বিপর্যস্ত হয়ে যেত। কিন্তু আল্লাহ জগতের প্রতি অনুগ্রহশীল। এসব আল্লাহর আয়াত, আমি তোমার নিকট উহা যথাযথভাবে উপস্থাপন করছি; আর নিশ্চয়ই তুমি রাসুলদের অন্তর্ভুক্ত।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ২৪৯-২৫৩)
মুফতি মাওলানা শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী যুগ্ম মহাসচিব: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতি সহকারী অধ্যাপক: আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজম
[email protected]