বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সাধ্যের মধ্যে থাকা সব পদক্ষেপ নিয়ে নিজেকে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের সবচেয়ে আধিপত্য বিস্তারকারী, সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং সবচেয়ে নৃশংস একনায়ক হিসেবে দাঁড় করিয়েছিলেন।
তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের এতটা নির্দয় ও বাছবিচারহীনভাবে জেলে পুরেছিলেন, নির্বাসিত করেছিলেন এবং নির্মূল করেছিলেন, যা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে অন্য কোনো শাসক আজ পর্যন্ত করেননি। তিনি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির প্রত্যেকটি স্তম্ভ ও শাখাকে এতটাই ‘দক্ষতার’ সঙ্গে পদানত করেছিলেন যে এক পর্যায়ে তিনি স্বয়ং রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিলেন।
সেই হাসিনাকে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন (শুরুতে যার কোনো নেতাই ছিল না) প্রচণ্ড বিক্রম নিয়ে মিছিল–সমাবেশের তারিখ ও স্থান ঘোষণা করে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল। মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তরুণ বিপ্লবীরা তাদের সঙ্গে গোটা জাতিকে এমনভাবে সম্পৃক্ত করে রাজপথে নামিয়েছিল যে শেষ পর্যন্ত হাসিনাকে হেলিকপ্টারে চড়ে পালাতে হয়েছে।
এই ছাত্ররা এমন কিছু অর্জন করেছে যা সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা এক দশক ধরে অর্জন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। যদিও তরুণ বিপ্লবী ও তাঁদের সমর্থকদের এই বিজয় উদ্যাপন করার অনেক কারণ আছে, তবে তাঁদের সামনে যে পথ পাড়ি দিতে হবে, তা মোটেও চ্যালেঞ্জমুক্ত হবে না।
২০০৬ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের পর হাসিনা এবং তাঁর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী খালেদা জিয়া উভয়েই বাংলাদেশের রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার অধিকার হারাতে বসেছিলেন। সে সময় খালেদা জিয়া নির্বাসনে যেতে অস্বীকৃতি জানান এবং হাসিনা বাংলাদেশে গৃহবন্দী ছিলেন। এরপর হাসিনা নিরাপদে দেশ ছেড়ে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে সময় কাটিয়েছেন এবং ফিরে এসে ২০০৮ সালের নির্বাচনে দাঁড়ান এবং বিপুল ভোটে জয়ী হন। কিন্তু ২০০৮ সালে হাসিনা যেভাবে ক্ষমতায় ফিরতে পেরেছিলেন, সেই বিজয়ী প্রত্যাবর্তনের পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
জনতার ক্রোধের মুখে হাসিনার মতো উচ্চ মর্যাদার অন্য কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে কখনো দেশ ছেড়ে পালাতে হয়নি—এই নির্মম সত্যটি একজন অদম্য নেতা হিসেবে তাঁর খ্যাতিকে স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। হাসিনার দেশ ছাড়ার তিন দিন পর বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার শপথ নিয়েছে।
তিনি যে ১৬ জনের উপদেষ্টা প্যানেল (কেবিনেট মন্ত্রীদের সমতুল্য) বেছে নিয়েছেন, তাতে সুশীল সমাজের আলোকিত ব্যক্তিরা রয়েছেন, যাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসা পেয়েছেন। উপদেষ্টাদের মধ্যে ছাত্র আন্দোলনের দুজন নেতৃস্থানীয় সমন্বয়কও রয়েছেন। তাঁদের সামনে যে পথ পাড়ি দিতে হবে, তা সন্দেহাতীতভাবে অত্যন্ত কঠিন।
আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অন্যান্য দলকেও আইনি জটিলতায় পড়তে হতে পারে। হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নির্বাচনে অযোগ্য করার জন্য যেসব গুরুতর ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, সেই অভিযোগ নিষ্পত্তি সাপেক্ষে তাঁদের নির্বাচনে আসতে হতে পারে। একটি বিষয় পরিষ্কার যে বিপুল প্রতিবন্ধকতার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারে সময় লাগবে।
এই মুহূর্তে ছাত্র সংগঠকেরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে শুধু হাসিনার শাসনামলের নয়, তাঁর আগেকার সরকারগুলোর দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত রাজনীতিবিদদেরও মুছে ফেলার দাবি করছেন। এখন সমস্যা হলো, দেশের প্রতিটি আনাচ-কানাচে হাসিনার রেখে যাওয়া রাজনৈতিক ডিএনএ পাওয়া যাবে। তাঁর নিয়োগ করা বিচারক, আমলা, পুলিশ এবং সামরিক কমান্ডাররা এখনো দেশ চালাচ্ছেন।
নতুন সরকারকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে আবশ্যিকভাবে প্রশাসনে রদবদল আনতে হবে। দলান্ধ কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা থেকে শুরু করে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত হাসিনার কর্মীদের সরাসরি গ্রেপ্তার করতে হবে। প্রক্রিয়াটি অবশ্য ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে।
এই প্রক্রিয়া অবশ্য দীর্ঘ হবে এবং এটি এই সরকারের দায়িত্ব পালনকালে শেষ করা যাবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। ভবিষ্যতে যেকোনো নির্বাচনে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পুলিশ, বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং সামরিক কমান্ডে সংস্কার আনতে হবে। তার জন্য সময় লাগবে।
ড. ইউনূসকে বাংলাদেশের দুই বড় প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। বিশ্বমঞ্চে হাসিনার প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসা ভারত হাসিনার এই পতনে ধাক্কা খেয়েছে। সেটি নতুন সরকারকে বিবেচনায় রাখতে হবে। আইনশৃঙ্খলার সম্ভাব্য ভাঙন এবং হিন্দু নাগরিকদের নিশানা করে নিপীড়ন চালানোর বিষয়ে উদ্বেগ রয়ে গেছে।
ভারত বাংলাদেশের যে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে মনে করে, তারা যাতে ক্ষমতায় ফিরতে না পারে, সে জন্য বর্তমান উপদেষ্টাদের মন্ত্রিসভা এবং সাধারণভাবে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর ভারতীয় চাপ আসতে পারে।
এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে ভারতের সঙ্গে সমঝোতায় আসা জটিল হবে। ভারতের নিরাপত্তা শঙ্কা প্রশমন করে এবং চীনের ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে অংশীদারি সম্পর্ক বজায় রেখে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার–সংক্রান্ত উদ্বেগ মোকাবিলা করাই ছিল হাসিনার ভূরাজনৈতিক কৌশল। তবে এখন বর্তমান সরকার চীন সম্পর্কে আমেরিকানদের উদ্বেগ বারবার সামনে এনে ভারতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক উদ্বেগকে ভোঁতা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়তে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ হবে সুষ্ঠুভাবে সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করা। তবে হাজার হাজার বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের জন্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে একটি ট্রাইব্যুনাল গঠনের দাবি ভবিষ্যতের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণকে জটিল করে তুলতে পারে। এই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলে সেটি হাসিনার প্রত্যাবর্তনকে আরও কঠিন করে তুলতে পারে।
আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য অন্যান্য দলকেও আইনি জটিলতায় পড়তে হতে পারে। হাসিনা তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নির্বাচনে অযোগ্য করার জন্য যেসব গুরুতর ফৌজদারি অভিযোগ দায়ের করেছিলেন, সেই অভিযোগ নিষ্পত্তি সাপেক্ষে তাঁদের নির্বাচনে আসতে হতে পারে। একটি বিষয় পরিষ্কার যে বিপুল প্রতিবন্ধকতার পরিপ্রেক্ষিতে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কারে সময় লাগবে।
সবখানেই একটি ভালো ভবিষ্যতের আশায় উচ্ছ্বাস দেখা যাচ্ছে। তবে সেই আশাবাদ প্রকাশের সঙ্গে সতর্ক হওয়া উচিত। এই সর্বশেষ বিপ্লব শেষ পর্যন্ত একটি ন্যায্য, মুক্ত এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে ধারণ করেছে কি না, তা নতুন প্রশাসনের দক্ষতার ওপর নির্ভর করবে।
শাফকাত রাব্বি বাংলাদেশি-আমেরিকান ভূরাজনৈতিক কলাম লেখক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ